যে কোনও ব্যবসায় শুভ ফল লাভ। বিশেষ কোনও ভুল বোঝাবুঝিতে পারিবারিক ক্ষেত্রে চাপ। অর্থপ্রাপ্তি হবে। ... বিশদ
উত্তরাখণ্ডের উত্তরকাশীতে সুড়ঙ্গে আটকে পড়া ৪১ জন কর্মী যখন অবশেষে মুক্তি পেলেন, তখন গোটা দেশবাসী স্বস্তি পেলেন। ১৭ দিন পর খোলা আকাশের বাতাস পেলেন তাঁরা। দেশে এল দমবন্ধ করা অপেক্ষার অবসান। এই আটকে পড়া নির্মাণকর্মীদের সঙ্গে বুধবার ফোনে কথা বলছিলেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। মোদি ছিলেন দিল্লিতে। নিজের দপ্তরে। আর ওই কর্মীরা ছিলেন উত্তরাখণ্ডে। ফোন ছিল স্পিকারে। যাতে উভয়ের কথা সকলেই শুনতে পায়।
প্রধানমন্ত্রী তাঁদের কাছে নিজের উদ্বেগ এবং স্বস্তির বার্তা দেওয়ার পর তাঁদের মনোভাব জানতে চেয়েছিলেন। একটি ইঞ্জিনিয়ারিং সংস্থার কর্মী ওই সুড়ঙ্গ নির্মাণে যুক্ত শাবা আহমেদ বলছিলেন, স্যার, আমরা প্রথমে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। যখন থেকে খাবার পাওয়া গেল পাইপের মাধ্যমে তারপর থেকে আমাদের মধ্যে কোনও ভয় ছিল না। আর স্যার, আর কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যও মনোবল হারাইনি। কেন জানেন স্যার? কারণ আমরা ৪১ জন একসঙ্গে ছিলাম। এই ৪১ জন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা। ভাষা আলাদা। কিন্তু আমরা সব একজোট ছিলাম প্রতিটি মুহূর্তে। কারও কোনও সমস্যা তৈরি হলে, আমরা সবাই একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়তাম। তার পাশে দাঁড়াতাম। একসঙ্গে খাওয়ার পর রাতে টানেলের মধ্যে কয়েক কিলোমিটার হাঁটতাম শরীর সুস্থ রাখার জন্য। সকালে যোগব্যায়াম করতাম। এই যে একসঙ্গে ছিলাম, এই কারণেই আমাদের মনের জোর কমেনি।
কারা ছিলেন সুড়ঙ্গে আটকে পড়া ওই ৪১ জনের মধ্যে? বিহারের এই শাবা আহমেদ, উত্তরাখণ্ডের গব্বর সিং নেগি, পশ্চিমবঙ্গের জয়দেব প্রামাণিক, মনির তালুকদার, শৌভিক পাখিরা, ওড়িশার তপন মণ্ডল, ঝাড়খণ্ডের বিশ্বজিৎ কুমার...। শাবা আহমেদরা ১৭ দিন একটি পাহাড়ি এলাকায় সুড়ঙ্গের মধ্যে থেকে উপলব্ধি করেছেন যে, একতার কী শক্তি। আমরা খোলা আকাশের নীচে কিন্তু সেটা বুঝতে পারছি না। আমরা বিভাজনের ফাঁদে পা দিচ্ছি। আর রাজনৈতিক দল ধর্মীয় বিভাজনের জাল ছড়াচ্ছে বারংবার।
শাবা আহমেদের ওই কথাগুলো শুনে আমরা বুঝতে পারছি যে, উত্তরাখণ্ডের ওই সুড়ঙ্গটি আদতে ওই ৪১ জনের কাছে একটি মিনি ভারতবর্ষ হয়ে উঠেছিল। তাঁরা একটি অন্ধকারে আটকে পড়েছিলেন। সেখানে থেকে আলোর দিকে বেরতে হবে। এই ছিল লক্ষ্য। সেই আলোর দিকে আসার লক্ষ্য পূরণ করতে সর্বাগ্রে তাঁরা সকলেই ওই মিনি ভারতবর্ষের প্রত্যেক নাগরিক স্থির করেছিলেন জাত, ধর্ম, ভাষার ব্যবধানকে সরিয়ে দিতে হবে। সকলের আগে দরকার একে অন্যের হাত ধরে থাকা। দুর্বলকে শক্তি জোগানো। শক্তিমানকে নানাভাবে সাহায্য করা। এভাবে একসঙ্গে খেয়েছেন। একসঙ্গে হেঁটেছেন। একসঙ্গে যোগব্যায়াম করেছেন। একসঙ্গে কেউ হিন্দু দেবতাকে, কেউ আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছেন। ঐক্যই শক্তি তাঁরা প্রমাণ করে দিয়েছেন।
এই ৪১ জন তো সুড়ঙ্গের মধ্যে ছিলেন। কিন্তু তাঁদের বাইরে বের করে আনার অসাধ্য সাধন যাঁরা করলেন সেই র্যাট হোল মাইনিং শ্রমিকরা কারা? ৬ জন দিল্লির। ৬ জন উত্তরপ্রদেশের। যখন ড্রিল মেশিন ব্যর্থ হল সুড়ঙ্গ খুঁড়তে, তখন এই ৬ জনের উপর এসে দায়িত্ব পড়ল। ২০ থেকে ৪৫ বছর বয়সি তাঁরা।
তাঁদের নাম কি? হাসান, মুন্না কুরেশি, নাসিম মালিক, মনু কুমার, সৌরভ, যতীন কুমার, অঙ্কুর, নাসির খান, দেবেন্দ্র, ফিরোজ কুরেশি, রশিদ আনসারি এবং ইরশাদ আনসারি। দিল্লি জল বোর্ডের কর্মী। তাঁদের কাজই হল পাইপে ঢুকে ইঁদুরের মতো মাটি খোঁড়া।
ওই কর্মীরা বলেছেন, সাধারণ সময়ে এই কাজটি অন্তত ১০ থেকে ১৫ দিন সময় লাগার কথা। কিন্তু এক্ষেত্রে তো অত সময় নেওয়া যাবে না। কারণ, তাঁরা তো আর জলের পাইপ বসাচ্ছেন না। মানুষের প্রাণ রক্ষা করছেন। সুতরাং অমানুষিক পরিশ্রমে ২৭ ঘণ্টায় সাফল্য এসেছে।
আমরা নামগুলো লক্ষ্য করেছি তো? যাঁরা ভিতরে আটকে পড়েছেন! যাঁরা বাইরে থেকে রক্ষা করার কাজে নেমেছেন! আমাদের কাজী নজরুল ইসলামের কবিতাটি মনে পড়েছে তো? ‘হিন্দু না মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন? কাণ্ডারী! বল ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মার’। এই যে ৪১ প্লাস ১২। অর্থাৎ মৃত্যুগুহায় আটক ও উদ্ধারকর্তা মোট ৫৩ জন ভারতবাসী ১৪০ কোটি দেশবাসীকে কী শিক্ষা দিলেন? সুড়ঙ্গই হোক অথবা দেশ, সঙ্কট এলে বিভাজন কাজে দেয়? নাকি ঐক্য? তাঁরা শেখালেন যেকোনও অসাধ্য সাধন করা যায় যদি দেশ ঐক্যবদ্ধ থাকে। যদি মানুষের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস আর মৈত্রী থাকে। বিভাজন এলে ঘনিয়ে আসে মুষলপর্ব। যদুবংশ ধ্বংস হয়। আর ঐক্যের শক্তি চিরন্তন।
এই সুপারহিরোদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কথা বললেন। আমরা কি তাঁর কাছে এবার একটা কঠোর সতর্কবার্তা আশা করতে পারি না যে, ধর্মের নামে ভোট চাওয়া, ধর্মীয় প্ররোচনা দিয়ে রাজনৈতিক লাভ, দেশবাসীর মধ্যে কোনওরকম জাত পাত ধর্ম ভাষার বিভাজন, কোনওটাই সহ্য করা হবে না? কঠোর আইন এনে যে দলেরই নেতা কর্মী হোক, তাদের চরম শাস্তি দেওয়া হবে?
যতই লোকসভা ভোট এগিয়ে আসছে, ততই আবার বেশি করে ধর্মীয় উগ্রতা প্রবেশ করছে রাজনীতিতে। আবার রাজ্যে রাজ্যে চলছে প্রচার, হিন্দু বনাম মুসলিম। উগ্র ধর্মীয় বিভাজন অন্যতম প্রধান হাতিয়ার শুধু নয়, হয়ে উঠছে যেন ব্রহ্মাস্ত্র। অথচ ১৪০ কোটি দেশের সম্মিলিত সর্বধর্মসমন্বয়ী জনতাই যে আসল অস্ত্র হয়ে উঠতে পারে তার প্রমাণ আমাদের এই আম জনতাই দিচ্ছে অবিরত।
প্রধানমন্ত্রী আটকে পড়া শ্রমিকদের জন্য অত্যন্ত দুশ্চিন্তায় ছিলেন। সেকথা তিনি নিজেই বলেছেন ওই মুক্তি পাওয়া শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলার সময়। কিন্তু তাঁর অথবা তাঁর সরকারের কাছে আরও একটু সংবেদনশীল আচরণ কি কাম্য ছিল না? ৪১ জন শ্রমিক যখন সুড়ঙ্গে আটকে রয়েছেন, তখন বেঙ্গালুরুতে গিয়ে তিনি তেজস নামক একটি ফাইটার জেটে বসে আকাশপথের অ্যাডভেঞ্চারাস উড়ানকে এয়ারফোর্সের ফুল ইউনিফর্ম পরিহিত অবস্থায় উপভোগ করছিলেন। হেলমেট হাতে ধরে দৃপ্ত পদক্ষেপে তিনি হেঁটে আসছেন ককপিটের দিকে।
তাঁর পা দেখানো হচ্ছে ক্যামেরায়। ঠিক যেন হিন্দি সিনেমা। বাতাসের গতিতে উড়ে চলা তেজসের সিটে বসে তাঁর সেই উৎফুল্ল হাসিমুখের স্মার্ট ভিডিও দিনভর ভারত সরকার প্রচার করেছে। প্রধানমন্ত্রীর এরকম সুপারম্যান ইমেজ কেন প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা হল ওরকম একটি সঙ্কটময় মুহূর্তে? ওই ইভেন্ট কি পিছিয়ে দেওয়া যেত না?
ঠিক উল্টোদিকে সুড়ঙ্গে আটকে পড়া ৪১ জনের মধ্যে অন্যতম গব্বর সিং নেগি কী বলেছিলেন আমরা মনে রাখছি তো? যখন উদ্ধারকার্যের সময় একে একে লাইন দিয়ে আটকে পড়া কর্মীদের বেরিয়ে আসতে বলা হচ্ছে বাইরে থেকে, তখন এই গব্বর সিং নেগি বলেছিলেন, আমি সবার বড়। তাই সবার শেষে বেরব। এই স্বার্থহীন অতি মানবিক আচরণ আমাদের হাই প্রোফাইল নেতাদের কাছে পাই না কেন? অবিরত নিজেদের প্রমোট করার এক অন্তহীন তাড়নায় তাঁরা দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য কেন? টিম অথবা দেশ। লিডার কেমন হওয়া উচিত? গব্বর সিং নেগির মতো নয়?
আমাদের বরাবর সঙ্কটের সময় পথ দেখান, শিক্ষা দেন এই ভারতের মহামানবের অত্যন্ত পিছনের সারিতে থাকা প্রান্তিক মানুষেরা। এই যেমন ধরা যাক ওই দিবারাত্রি পরিশ্রম করা র্যাট হোল মাইনিং করা শ্রমিকেরা। তাঁরা এই কাজটির জন্য পারিশ্রমিক নেবেন না বলেছেন! কোথা থেকে আসে এই শক্তি? ঐক্য থেকে! ভারতের চিরকালীন শক্তির নাম ঐক্য! বিভাজন নয়।