ভাবতে অবাক লাগলেও এটা কিন্তু একেবারেই সত্যি যে, পাখিরা ডাইনোসর থেকে এসেছে। তার মানে এটাও সত্যি যে ডাইনোসররা পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত হয়নি। তারা কিন্তু আজও পাখি রূপে আমাদের চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে! আসলে পাখি আর ডাইনোসরের মধ্যে অনেক কিছু মিল রয়েছে। যার মধ্যে আছে পালক এবং পালকের মতো বস্তু। যা পাখি এবং অনেক ধরনের ডাইনোসরের একটি সাধারণ পূর্বপুরুষকে নির্দেশ করে। পাখিরা ডাইনোসর থেকে ধীরে ধীরে বিবর্তিত হয়েছে বলেই অনুমান করা হয়।  
পরতে পরতে রহস্য ভরা, পৃথিবীর আদি কাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বিস্তৃত  সুবিশাল এই ভূতাত্ত্বিক সময়কালটি। অসাধারণ এর ঘটনাবলি, জৈব বৈচিত্র্য আর বিবর্তনের ইতিহাস। আমাদের গ্রহটি সৃষ্টি হয়েছিল আনুমানিক ৪৫০ কোটি বছর আগে। আর আনুমানিক ৩৭০ কোটি বছর আগে পৃথিবীর বুকে প্রথম অণুজীবদের উপস্থিতি টের পাওয়া যায় বলে জানা যাচ্ছে ওয়াশিংটন ডিসির ‘ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রি’ সূত্রে। অবশ্য এর বহু বহু কোটি বছর পর পৃথিবীতে আসে বিশালদেহী ডাইনোসররা। সত্যি, প্রাগৈতিহাসিক কালের এক বড় অদ্ভুত প্রাণী ছিল এই ডাইনোসর। ১৮৪২ সালে  পুরাজীববিদ রিচার্ড ওয়েন, ‘ডাইনোসরিয়া’-নামে ট্যাক্সনটির  নামকরণ করেন।
গ্রিক শব্দ ‘দেইন্স’ বা ভয়ঙ্কর এবং ‘সাউরোস’ বা গিরগিটি শব্দ দু’টি জুড়ে ‘ডাইনোসর’ শব্দটি তৈরি হয়েছে। যদিও আদতে, সরীসৃপ শ্ৰেণিভুক্ত একটি আলাদা গোষ্ঠীর প্রতিনিধি এই প্রাণীটি পৃথিবীতে  এসেছিল আজ থেকে অন্তত ২৩ কোটি বছর আগে। প্রায় ১৬ কোটি বছর ধরে পৃথিবীতে দাপিয়ে বেড়ানোর পর আনুমানিক সাড়ে ৬ কোটি বছর আগে কোনও রহস্যময় কারণে গোটা পৃথিবী থেকেই বিলুপ্ত হয়ে যায় ডাইনোসরের দল। তাই ভূতাত্ত্বিক সময়কাল ট্রায়াসিক, জুরাসিক ও ক্রিটেসিয়াস যুগ জুড়ে পৃথিবীতে ডাইনোসরের অস্তিত্ব লক্ষ করা যায়।  তবে ডাইনোসরদের  একটি শাখা আজকের  পাখিদের মধ্যেই রয়ে গিয়েছে বলে বিজ্ঞানীদের দৃঢ় অনুমান! কারণ, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার মিউজিয়াম অব প্যালিয়ন্টোলজির তথ্য অনুযায়ী, পাখি আসলে ছোট, না উড়তে পারা থেরোপড ডাইনোসরদেরই  বংশধর। থেরোপড ডাইনোসর হল দ্বিপদ সওরিশিয়ান ডাইনোসরের একটি গোষ্ঠী। এদের টি রেক্স, ডিনোনিকাস ইত্যাদি বিশালদেহী মাংসাশী ডাইনোসরেরা একসময় পৃথিবী কাঁপিয়েছে। যাই হোক, সেই সময়, কিছু ডাইনোসরের কিন্তু পাখা ছিল, উড়তেও পারত। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা সূত্রে জানা যায় যে, ড্রোমাইওসর সহ কিছু প্রজাতির ডাইনোসরদের পাখা ছিল। তবে ওড়ার থেকেও  শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ, ছদ্মবেশ ধারণ ও দৌড়োনোর সময় ভারসাম্য রক্ষার কাজে এগুলি বেশি সাহায্য করত। প্যালিওবায়োলজি ডেটাবেস অনুযায়ী, ২০২১ সাল পর্যন্ত মোট ১ হাজার ৫৪৫টি ডাইনোসরের প্রজাতি বিজ্ঞানভিত্তিকভাবে  শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। যদিও ২০২২ সালে ৭টি নতুন প্রজাতি এবং সম্প্রতি ৪০০টি দাঁত বিশিষ্ট আরও একটি নতুন প্রজাতির কথা জানা গিয়েছে। এদের কেউ তৃণভোজী, কেউ মাংসাশী আবার কেউবা সর্বভুক। বেশিরভাগ ডাইনোসরই নাকি গাছপালা খেত। কিছু ডাইনোসর আবার টিকটিকি, কচ্ছপ, ডিম, তৎকালীন স্তন্যপায়ী প্রাণী দিয়ে উদরপূর্তি করত। তবে শুধু খাদ্যাভ্যাস নয়, আকার-আয়তন ও দৈহিক বৈশিষ্ট্যতেও ডাইনোসরদের 
ব্যাপক বৈচিত্র্য ছিল। ভাবা যায়, ডাইনোসরদের সবচেয়ে ছোট প্রজাতিগুলোর আকার নাকি ছিল অনেকটা পায়রার মতো! আবার, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো থেকে পাওয়া তৃণভোজী অ্যামফিকোলিয়াস ফ্র্যাগিলিমাস প্রজাতির শরীরের দৈর্ঘ্য  ছিল নাকি আনুমানিক ২২৩ ফুট এবং ওজন ছিল নাকি প্রায় ১ লক্ষ ৩৬ হাজার ৭৭ কেজি! এরাই ছিল এখনও পর্যন্ত জানা ডাইনোসরদের মধ্যে সবচেয়ে লম্বা ও ভারী প্রজাতি। অন্যদিকে সবচেয়ে বড় মাংসাশী প্রজাতি ছিল স্পিনওসরাস। যার দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় ৬০ ফুট এবং ওজন ছিল প্রায় ৮ হাজার ১৫০ কেজি। দলবদ্ধভাবে বিচরণ করত ডাইনোসররা। প্রজাতি ভেদে ডাইনোসরের ডিমের আকার-আয়তনের কিন্তু রকমফের হতো। যেমন— মাংসাশী ডাইনোসরদের ডিম হতো একটু লম্বাটে। আবার, তৃণভোজী ডাইনোসরদের ডিম তুলনামূলকভাবে গোলাকার হতো। অন্যদিকে, অনেকটা পাখিদের মতো ডাইনোসরদেরও নানা রঙের ডিমের প্রমাণ মিলেছে! আবার আশ্চর্যের বিষয়, এতদিন পর্যন্ত ধারণা ছিল যে, বিশালদেহী ডাইনোসরগুলি নাকি ছিল শীতল রক্তের প্রাণী। কিন্তু সম্প্রতি ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির গবেষণা থেকে জানা গিয়েছে যে, অধিকাংশ ডাইনোসরেরাই নাকি পাখিদের মতোই উষ্ণ রক্তের প্রাণী ছিল! সম্প্রতি, মধ্যপ্রদেশের ডাইনোসর ফসিল ন্যাশনাল পার্কে সন্ধান পাওয়া গিয়েছে টাইটানোসরাসের ১০টি প্রস্তরীভূত  ডিম। এর থেকে জানা যায়, ডাইনোসরের এই প্রজাতিগুলি পাখিদের মতোই বাসা তৈরি করত। সম্প্রতি আবিষ্কৃত মঙ্গোলিয়ার একটি ছোট এবং প্রায় হাঁসের মতো আকৃতির ন্যাটোভেনেটর ডাইনোসরের সাঁতার উপযোগী পাঁজর ও অন্যান্য বৈশিষ্ট্যগুলি দেখে বিজ্ঞানীরা অনুমান করছেন যে, পেঙ্গুইনদের মতো ডাইভিং পাখিগুলি আজ ডাইনোসরদের সেই উত্তরাধিকারই নাকি বহন করছে! আবার, হাঁটু এবং পায়ের মাঝখানে থাকা সামনের হাড় বা শিন বোনগুলির একটি অত্যাধুনিক বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ গবেষকদের আভাস দিয়েছে যে, কীভাবে কিছু ডাইনোসর পাখির মতো প্রাণীতে বিবর্তিত হয়েছিল। ডাইনোসররা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বড় বা ছোট হওয়ার জন্য একাধিক বিবর্তনীয় কৌশল ব্যবহার করেছিল! প্রাচীনতম পাখির জীবাশ্ম প্রায় ১৫ কোটি বছরের পুরনো। এই প্রাচীন পাখিগুলি দেখতে ছিল কিন্তু অনেকটা ছোট, পালকযুক্ত ডাইনোসরের মতো এবং তাদের মধ্যে অনেক মিলও ছিল। বিস্ময়ের কথা, পাখিদের মুখে তখন ধারালো দাঁতও ছিল। যদিও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাখিরা তাদের দাঁত হারিয়েছে আর বিবর্তিত হয়েছে ঠোঁট। সম্প্রতি, ‘চাইনিজ অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস’-এর বিজ্ঞানীরা সন্ধান পেয়েছেন ‘ক্র্যাটোনাভিস ঝুই’ নামের ডাইনোসর ও পাখির মধ্যবর্তী একটি প্রাণীর জীবাশ্মের। অদ্ভুতদর্শন প্রাণীটির মাথাটি ডাইনোসরের মতো , আর দেহটি পাখির মতো। ডাইনোসর থেকেই বিবর্তনের মাধ্যমে পাখির উৎপত্তি এমন ধারণাটি আরও দৃঢ় হয়েছে এই আবিষ্কারের ফলে।
কিন্তু একসময় প্রায় পৃথিবী জোড়া সাম্রাজ্য থেকে সাড়ে ৬ কোটি বছর আগে হঠাৎ কীভাবে উধাও হয়েছিল ডাইনোসরেরা? এ নিয়ে অনেক অনুমান, অনেক তত্ত্ব রয়েছে।  বিজ্ঞানীদের একটি অংশ মনে করেন যে, কোনও উল্কা বা গ্রহাণুর সঙ্গে সংঘাত এবং তার পরবর্তী বিপর্যয়ে লুপ্ত হয় ডাইনোসরের দল।  আবার, সম্প্রতি ‘নেচার’ পত্রিকার একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে যে, পৃথিবীর বুকে গ্রহাণু আছড়ে পড়ার সেই মারণ মুহূর্তের অনেক আগে থেকেই নাকি পরিবেশগত কারণে ডাইনোসরদের পতন শুরু হয়। সম্ভবত, বিশ্বব্যাপী জলবায়ু শীতলীকরণ এবং তৃণভোজী বৈচিত্র্য হ্রাস এই পতনে ইন্ধন জুগিয়েছিল। অন্যদিকে কেউ কেউ  আবার ভয়ঙ্কর অগ্ন্যুৎপাতকেও দায়ী করেন ডাইনোসরদের হারিয়ে যাওয়ার পিছনে।
তাই শেষমেশ একথা বলতেই হয়,  প্রাগৈতিহাসিক ডাইনোসর যেন আজ কোনও ‘ভয়ংকর লিজার্ড’ বা গিরগিটির থেকেও অনেক বেশি, একটি ‘অবিশ্বাস্য পাখি’ হিসাবে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় উঠে আসছে!