রুদ্রজিৎ পাল: কেন গিয়েছিলে তোমরা ছাদে?’ শার্মিন আর অনিকেতকে বড় কালো টেবিলটার সামনে দাঁড় করিয়ে গম্ভীর গলায় জিজ্ঞাসা করলেন মিস তলোয়ার। কপালে বিশাল লাল রঙের টিপ পরা মিস তলোয়ারকে দেখলেই স্কুলের সবার গলা শুকিয়ে আসে। আর সেই মিস তলোয়ারের সামনেই পড়ে গিয়েছে অনিকেত আর শার্মিন স্কুলের ছাদের সিঁড়ি দিয়ে নামার সময়ে। 
‘তোমরা জানো না যে, ছাদে ওঠা বারণ?’
শার্মিন মাথা নাড়ে। অনিকেত স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে আছে দেখে মিস তলোয়ার ওর দিকে ফিরেই জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী তুমি জানো না? নোটিস দেখনি?’
অনিকেত এবার আস্তে করে মাথা নাড়ল। 
‘তাহলে তোমরা ছাদে কী করছিলে?’
দু’জনের কেউ কোনও কথা না বলে চুপ করে তাকিয়ে রইল। মিস তলোয়ার বললেন, ‘তোমরা কি ভেবেছ যে, আমি কিছু জানতে পারি না?’ অনিকেত একবার হেড মিস্ট্রেসের ঘরের দেওয়ালে লাগানো সিসি টিভির স্ক্রিনের দিকে তাকাল। স্কুলের সব জায়গার ক্যামেরা লাগানো আছে। আর সেই ছবি সরাসরি আসছে মিসের ঘরে। অনিকেত ছাদের সিঁড়ির ক্যামেরাটার দিকে দেখল। এখন সিঁড়ি খালি, শুধু একটা পায়রা জানলা দিয়ে ঢুকে সিঁড়িতে ঘুরছে।
মিস তলোয়ার আবার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী হল? কী করছিলে তোমরা? ক্লাস নেই?’
শার্মিন বলল, ‘আমাদের ড্রয়িং ক্লাস ক্যান্সেল হয়েছে।’
‘পিরিয়ড ক্যান্সেল। তাই তুমি ছাদে যাবে? পরের পিরিয়ডের পড়া নেই?’
অনিকেত একবার শার্মিনের দিকে ফিরে ইশারা করল। মানে, চুপ করে থাক। 
‘কী হল? পড়া নেই? তোমাদের পরের পিরিয়ড তো অঙ্ক। তাই না?’
‘হ্যাঁ মিস।’
‘তাহলে? সব অঙ্ক শেখা শেষ হয়ে গেছে? আগেরবার ইউনিট টেস্টে কত পেয়েছিলে?’
শার্মিন চুপ করে থাকে। মিস তলোয়ার আবার বললেন, ‘তোমার মার্কশিটটা বের করব?’
শার্মিন মুখ নিচু করে থাকে।
এবার মিস তলোয়ার তাকালেন অনিকেতের দিকে। ‘আর তুমি, অনিকেত? সব অঙ্ক শেষ? যদি এক্ষুনি অঙ্ক করতে দিই পারবে তো?’
অনিকেতের মনে হল ওর পেটের মধ্যে একটা চামচিকে উড়ে বেড়াচ্ছে। 
মিস তলোয়ার আবার বললেন, ‘তোমরা বলবে? নাকি আমি গার্জিয়ান কল করব?’
অনিকেত এবার মুখ খুলল, ‘আসলে মিস ভূতটা আছে কি না দেখার জন্য...’
‘ভূত! কোথায়?’
‘ওই ছাদে মিস। কালকে স্কুল ছুটির পর যখন আমরা গেট দিয়ে বেরচ্ছিলাম, তখন দেখেছিলাম। ছাদে দাঁড়িয়ে আছে।’
‘এত মিথ্যে কথা? কোথায় শিখেছ এইসব?’
শার্মিন এবার বলে, ‘না মিস। ও সত্যি বলছে। আমিও দেখেছি। আমরা কয়েকজন কাল বিকেলে দেখেছি। একটা সাদা মুখ। চোখগুলো লাল লাল। মাথায় চুলটা কেমন কালচে মতন। ছাদের রেলিংয়ের ওপর।’
মিস তলোয়ার চুপ করে দু’জনের মুখের দিকে তাকালেন। ‘তোমরা জানো না ভূত বলে কিছু নেই? আগেকার দিনে এইসব সুপারস্টিশন ছিল। লেখাপড়া শিখে তোমরা কুসংস্কার বিশ্বাস কর!’
‘কিন্তু মিস আমি দেখেছি।’
‘আর কে দেখেছে তোমাদের সঙ্গে?’
‘রিনিতা ছিল, ঈশান ছিল...’
‘ডাকব ওদের?’
অনিকেতের এইসময়ে মনে পড়ল যে রিনিতা আজকে আসেনি ক্লাসে। ‘মিস, রিনিতা আজকে আসেনি।’
‘ঠিক আছে। ভূত না হয় দেখেছ। কিন্তু তোমরা ছাদে যাচ্ছিলে কেন? সে কি ওখানে বসে আছে?’
এই সময়ে শার্মিন বলে, ‘মিস, ওই মুখটা আমাদের দিকে তাকিয়েছিল। আর ওর চুলগুলো হাওয়ায় উড়ছিল।’
মিস তলোয়ার নিজের চুলটা হাত দিয়ে ঠিক করে বললেন, ‘ভূত বলে কিছু নেই। মনে রাখবে। তোমরা এত সায়েন্সের বই পড়ছ, এত হাতে হাতে এক্সপেরিমেন্ট করছ, আর এইসব কথা বলছ?’ ওরা দু’জন চুপ করে রইল। মিস তলোয়ার আবার বললেন, ‘কী অনিকেত? তোমার বাবাকে ডেকে বলব?’
দু’জনেই আবার চুপ। এই সময়ে শার্মিন বলে, ‘আচ্ছা মিস, ওই সিসি টিভিতে একবার দেখলে হয় না? যদি ভূত সত্যিই ছাদে উঠে থাকে, তাহলে...’
মিস তলোয়ার ওর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আবার বলছ ভূতের কথা? এবার কিন্তু গার্জিয়ান কল করব। আর কোনওদিন এইসব বলবে না। আমি এই ব্ল্যাক বুকে তোমাদের নাম লিখে নিলাম। এরপর যদি আবার ছাদে ওঠার চেষ্টা কর, তাহলে কিন্তু শাস্তি হবে। যাও।’
দু’জনেই প্রায় দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে নিজেদের সেকশনের দিকে রওনা হল। শার্মিন একবার বলে, ‘জানিস, মিস তলোয়ারের চুলটা ঠিক ওই ভূতটার মতো!’ অনিকেত বলল, ‘চুপ কর। এবার কিন্তু শুনলে আর রক্ষা নেই।’
....
ইতিমধ্যে ঘরে বসে মিস তলোয়ার নিজের ড্রয়ার খুলে একটা মুখোশ বের করেছেন। সাদা মুখোশ, চোখগুলো লাল লাল। ওঁর নাতি এটা এনে দিয়েছে ওঁকে ব্রাজিল থেকে। উনি কালকে এটা নিয়ে উঠেছিলেন স্কুলের ছাদে। দিনের শেষে ছাদে একবার উঠতে না পারলে ওঁর ভালো লাগে না। 
ছাদে উঠে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ তাঁর মধ্যে একটা ছেলেমানুষী খেলা করে। একবার মুখোশটা পরে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন রেলিংয়ের ধারে। অনেকক্ষণ ছুটি হয়ে গিয়েছে। সবার চলে যাওয়ার কথা। কিন্তু নীচে তাকিয়েই তিনি দেখেছিলেন যে, কয়েকজন ছাত্রছাত্রী গেটের কাছে দাঁড়িয়ে। উনিও রেলিং দিয়ে মুখ বাড়িয়েছেন আর ওরাও উপরে তাকিয়েছে। একপলক চোখাচুখি। তারপরেই মিস তলোয়ার সরে এসেছিলেন রেলিং থেকে। কিন্তু সেই ছাত্ররা যে সেটা দেখে পরের দিন অনুসন্ধান করতে আসবে, সেটা তিনি ভাবেননি।
এরপর থেকে আরও সাবধান হতে হবে।
মিস তলোয়ার একবার সিসি টিভি স্ক্রিনের দিকে তাকালেন। ভয় হল, এই রেকর্ড আবার কেউ দেখে ফেলবে না তো?