কল্যাণকুমার দে: কয়েক বছর আগেও কালীপুজোর মুখে সন্ধেবেলায় ঘরে আলো জ্বালানোই যেত না, একধরনের পোকার অত্যাচারে। টিউবলাইট বা বাল্ব জ্বালালেই দলে দলে ছোট ছোট সবুজ পোকা আলোর চারপাশে জড়ো হতো। শরৎ গিয়ে হেমন্তের আগমনে তাদের আসাটাই যেন বুঝিয়ে দিত শ্যামাপুজো আসছে। হয়তো এমন সম্পর্কের জন্যই তাদের নাম ‘শ্যামাপোকা’ বলে অনেকে মনে করেন। অনেকে আবার এদের দেওয়ালি পোকাও বলেন। হেমন্তে এদের আবির্ভাব বলে ‘হেমন্তী পোকা’ বলেও ডাকা হয়। তবে শ্যামাপোকা নামটাতে বেশি পরিচিত। এদের গায়ের রং উজ্জ্বল সবুজ। পিঠের দিকে ডানার মাঝামাঝি দুটো কালো রঙের বিন্দু দেখা যায়। আবার ডানার শেষাংশ কালো রঙের হয়।
দিনের আলোয় এদের উপস্থিতি একদম টের পাওয়া যায় না। সন্ধে হলেই আলোর টানে ওরা ঝাঁকে ঝাঁকে হাজির হয়। আলোটা যদি প্রদীপ বা মোমের হয়, তা হলে সেই প্রদীপ বা মোমের লকলকে শিখায় লাফিয়ে পড়ে ঝলসে মারা যায় তারা। আলোর কাছাকাছি গেলে আমাদের জামাকাপড়ের ফাঁকফোকর দিয়ে ঢুকে পড়ে শরীরের আনাচে কানাচে। অস্বস্তি লাগে এদের কামড়ে। পোকা থেকে বাঁচতে সন্ধে হলেই ঘরের আলো নিভিয়ে রাখা হয়। রাস্তার আলোর চারপাশে তৈরি হয় একদল উদ্‌ভ্রান্ত পোকার স্তম্ভ। আলোর চারপাশে ঘুরে, পরের দিন সকালে সারা ঘরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকত অগুন্তি মরা শ্যামাপোকা। ক্ষণজীবী এই শ্যামাপোকারা মরবার জন্যই যেন জন্মায়।
তেলেভাজা বা মিষ্টির দোকানে জ্বলতে থাকা টিউব লাইটের নীচে শ্যামাপোকারা যাতে আটকে যেতে পারে, সে জন্যে মশারি কিংবা স্বচ্ছ প্লাস্টিকের টুকরো বা পাতা সমেত গাছের ডাল বেঁধে দেওয়াটা ছিল অত্যন্ত পরিচিত দৃশ্য। সেই শ্যামাপোকারা বেশ কয়েক বছর ধরে সেভাবে আর চোখে পড়ছে না। বর্তমান প্রজন্মের কাছে তো এখন বেশ অপরিচিত এই শ্যামাপোকারা। এখন তো এইসব পোকার বাস শুধুমাত্র গল্পের বইয়ের পাতায়। সত্যজিৎ রায়ের ‘টিনটোরেটার যিশু’ গল্পে দেওয়ালে টাঙানো টিনটোরেটার যিশুর ছবিটা যে নকল, আর তা যে গত দু’এক দিনের মধ্যেই আঁকা হয়েছিল, তা ফেলুদা ধরেছিলেন ছবিতে যিশুর কপালে আটকে থাকা একটা শ্যামাপোকা দেখে। রাতের অন্ধকারে মোমবাতি বা কেরোসিনের বাতি জ্বালিয়ে ছবিটা আঁকার সময় ওই শ্যামাপোকা সদ্য প্রলেপ দেওয়া তেলরঙে আটকে গিয়েছিল। আর সেই সূত্র ধরেই রহস্যভেদ।
শ্যামাপোকাদের হারিয়ে যেতে বসার রহস্য অনুসন্ধান করতে গেলে প্রথমেই জানতে হবে তাদের জীবনকথা। জানতে হবে কী তাদের পরিচয়?
শ্যামাপোকা মূলত ধান বা ঘাস জাতীয় উদ্ভিদ নির্ভর পোকা। উদ্ভিদেই এদের ডিম পাড়া থেকে শুরু করে লার্ভা ও পিউপা দশা পেরিয়ে পূর্ণাঙ্গ দশা প্রাপ্তি হয়। শ্যামাপোকারা সাধারণত হেমন্তকালেই পূর্ণাঙ্গ হয় পরবর্তী প্রজন্মের জন্য ডিম পেড়ে রেখে মারা যায়। এদের চোষক প্রকৃতির মুখের উপাঙ্গ দিয়ে এরা ঘাসপাতা ফুটো করে রস খায়। এই পোকার বিজ্ঞানসম্মত নাম— নেফোটেটিক্স ভেরেসেন্স। সাধারণত মার্চ থেকে নভেম্বর পর্যন্ত এরা জীবনের বেশ কয়েকটা জীবনচক্র সম্পন্ন করে। মোটামুটিভাবে কালীপুজোর সময় থেকে তীব্র শীত পড়া পর্যন্ত সন্ধেবেলা আলোর চারপাশে এদের বেশি চোখে পড়ে। এই সময়টা হালকা শীতের নির্দিষ্ট উষ্ণতা এবং বৃষ্টি না হওয়ায় এদের বংশবিস্তারের জন্য উপযুক্ত সময়। সর্বোপরি, এই সময় মাঠে সদ্য শীষ আসা ধান গাছ থেকে প্রচুর খাবার খাওয়ার সুযোগ থাকে বলে এই সময়েই সবচেয়ে বেশি শ্যামাপোকাদের চোখে পড়ে বলে বিশেষজ্ঞদের মত। শীত বাড়লে শ্যামাপোকারা পিউপা অবস্থায় পুরো শীতকালটা ঘাস বা ধান গাছের গোড়ায় থেকে যায়, একে ডায়াপজ দশা বলে। শ্যামাপোকাদের হারিয়ে যেতে বসার কারণ হিসাবে বেশ কয়েকটি কারণকে দায়ী করা যায়। তার মধ্যে প্রধান কারণ হল— ফসলের ক্ষতি করে এমন পোকাদের সমূলে বিনাশ করতে এখন জমিতে অপরিকল্পিত ও যথেচ্ছ পরিমাণে কীটনাশক প্রয়োগ করা হচ্ছে। তাতেই বিপন্ন হয়ে পড়ছে শ্যামাপোকার অস্তিত্ব। তাছাড়া, জলবায়ুর পরিবর্তন তো একটা বড় কারণ। আবহাওয়া পরিবর্তনের জন্যই সম্ভবত ওদের জীবনচক্র পরিবর্তন হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। আর্দ্রতা, তাপমাত্রা, বৃষ্টির পরিমাণ— সব হিসেব করে দেখতে হবে আবহাওয়ার পরিবর্তন ওদের জীবনচক্রের উপর কতটা এবং কী কী প্রভাব ফেলছে। তাতেই বোঝা যাবে তাদের হারিয়ে যাওয়ার আসল রহস্যটা কী? তবে শ্যামাপোকা অদৃশ্য হওয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ শহরে সবুজের অভাব। শহর থেকে নির্মূল করে ফেলা হচ্ছে ঘাসজমি। তাই হারিয়ে যাচ্ছে শ্যামাপোকারা।আরও একটা কারণ হল এককালে শ্যামাপোকা ধান গাছের প্রধান ক্ষতিকারক পোকা ছিল। এখন অনেকটা তাদের মতোই আকৃতিবিশিষ্ট বাদামি চোষক পোকা (বৈজ্ঞানিক নাম নীলপার্ভাটা লুগেন্স) শ্যামাপোকাকে পিছনে ফেলেছে। তারাই ধানের প্রধান ক্ষতিকারক পোকার জায়গা দখল করেছে। একই ধরনের জীবদের ক্ষেত্রে নিজেদের আধিপত্য রক্ষার জন্য লড়াইকে বাস্তুবিদ্যায় ‘নিসে শিফটিং’ (Niche Shifting) বলে। তাই এখনও যেসব জায়গায় আলোর চারপাশে পোকারা ভিড় করে, সেখানে একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে শ্যামাপোকার সংখ্যা কম, বাদামি চোষক পোকাই বেশি। কারও কারও মতে, অতিবৃষ্টিতে ঘাসজমি ডুবে যাওয়াও শ্যামাপোকার সংখ্যা কমার একটা কারণ হতে পারে।
কোনও কোনও পতঙ্গবিদের মতে, শ্যামাপোকাদের হারিয়ে যাওয়ার পেছনে রয়েছে সিএফএল (কমপ্যাক্ট ফ্লুয়োরোসেন্ট ল্যাম্প) আলোর অবদান এবং তার পাশাপাশি শহরের বাতাসে ক্রমবর্ধমান দূষণ মাত্রা। এখন কম বিদ্যুৎ খরচে বেশি জোরালো আলো পাওয়ার জন্যে ঘরে ঘরে টিউব লাইটের জায়গা নিচ্ছে সিএফএল আলো। শ্যামাপোকাদের অন্য নাম হল ‘ফায়ার ক্যাচার’। এরা আলোর উজ্জ্বলতা ও নির্দিষ্ট উত্তাপের প্রতি আকৃষ্ট হয়। সিএফএল সেটা দিতে পারে না। ফলে ঝাড়ে-বংশে উধাও শ্যামাপোকার দল। নানান প্রতিকূলতায় শ্যামাপোকারা আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। জীবনযুদ্ধের লড়াইয়ে সত্যিই তারা পরাজিত এবং তাদের অস্তিত্ব বিপন্ন।