যে কোনও ব্যবসায় শুভ ফল লাভ। বিশেষ কোনও ভুল বোঝাবুঝিতে পারিবারিক ক্ষেত্রে চাপ। অর্থপ্রাপ্তি হবে। ... বিশদ
একদিন তপন সিংহের বাড়ি এসে প্রযোজক অসিত চৌধুরী একটি ছবি তৈরির প্রস্তাব দিলেন। কী গল্প প্রযোজক বেছে নিয়েছিলেন? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘কাবুলিওয়ালা’। এমন প্রস্তাবে তো না বলাই যায় না। কাজে নেমে পড়লেন তপন সিংহ। প্রখ্যাত সাহিত্যিক প্রেমেন্দ্র মিত্রকে সঙ্গে নিয়ে চিত্রনাট্য লেখার কাজ শুরু করলেন। তখনকার সময় রবীন্দ্রনাথের গান বা গল্প নিয়ে কিছু করতে গেলে বিশ্বভারতীর অনুমোদন লাগত। যথারীতি চিত্রনাট্য অনুমোদনের জন্য পাঠানো হল। কিন্তু চিত্রনাট্য অনুমোদিত হল না। কারণ চিত্রনাট্যের শেষে মিনির মায়ের হাত দিয়ে কাবুলিওয়ালাকে টাকা দেওয়ার ব্যাপারটা রাখা হয়েছিল। কিন্তু মূল গল্পে রয়েছে মিনির বাবা-ই কাবুলিওয়ালার হাতে টাকা দিয়েছিলেন। ওই অংশ বদল করে পাঠানো হল। অনুমোদন মিলল। প্রথম ঝঞ্ঝাট কাটতে না কাটতে নতুন ভাবনা কে করবে ছোট মিনির চরিত্রে অভিনয়। এই ছবিতে যে তার বড় ভূমিকা। অনেক খোঁজাখুঁজির পর পাওয়া গেল ঠাকুরবাড়ির মেয়ে টিঙ্কু ঠাকুরকে (ভালো নাম ঐন্দ্রিলা, অভিনেত্রী শর্মিলা ঠাকুরের বোন) । তার মিষ্টিমুখ আর আধো আধো বলা কথা একেবারে চরিত্রের উপযোগী। তবু তাকে গড়েপিঠে তৈরি করলেন এই ছবিতে মিনির মায়ের চরিত্রে যিনি অভিনয় করেছিলেন, সেই মঞ্জু দে। এমনকী ‘খরবায়ু বয় বেগে চারিদিক ছায় মেঘে’ গানের সময় ছোট্ট মিনির নাচের মুদ্রাগুলিও ক্যামেরার পাশ থেকে শট চলাকালীন মঞ্জু দে-ই দেখিয়ে দিয়েছিলেন। ছোট্ট টিঙ্কু নিজের গলায় নাচের মুদ্রাসহ গেয়েছে ‘কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা মনে মনে।’ ছবিতে নাম ভূমিকায় ছবি বিশ্বাস। নকল দাড়ি-গোঁফে ছবি বিশ্বাসের বরাবরের এলার্জি। স্পিরিট গাম এসব তিনি সইতে পারতেন না। তবুও চরিত্রের খাতিরে ছবির মেকআপম্যান মদন পাঠক এত সুন্দর করে ছবি বিশ্বাসের মেকআপ করলেন যেন গল্পের রহমত পর্দায় উঠে এল। মিনি ও রহমতের খুনসুটি দর্শকদের মন ছুঁয়ে গেল। এই তপন সিংহই পরবর্তীকালে পরিচালনা করেছিলেন ‘সবুজ দ্বীপের রাজা’, ‘সফেদ হাতি’র
মতো ছবি।
‘কাবুলিওয়ালা’র পরে তপনবাবু রবীন্দ্রনাথের আরও একটি গল্প নিয়ে ছবি তৈরি করেছিলেন— ‘অতিথি’। নিউ থিয়েটার্সের এই ছবিতে তারাপদ আর চারুশশী এই দু’টি চরিত্রের জন্য রোজ প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডের স্টুডিওতে প্রচুর ছেলেমেয়ের অডিশন নিচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু মনে ধরছিল না কাউকেই। একদিন দুই ভাই হাজির হলেন তপনবাবুর কাছে। দাদা সৌমেন মুখোপাধ্যায় অডিশন দেবেন। সঙ্গে এসেছেন ভাই পার্থ। কিন্তু পরিচালকের নজর পড়ল ভাইয়ের দিকে। তিনি পার্থর অডিশন নিলেন। সেইসঙ্গে পার্থ খালি গলায় শোনালেন ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে...’। তাঁকেই পছন্দ হয়ে গেল পরিচালকের। অভিনেতা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কন্যা বাসবী কীভাবে এই ছবিতে চারুশশী হয়ে উঠলেন, সেই ঘটনা তিনি নিজেই বলেছিলেন, ‘১৯৬৫ সালের পয়লা জানুয়ারি নিউ থিয়েটার্স স্টুডিওতে বাবার হাত ধরে গিয়েছিলাম। সেখানে সবাইকে নতুন ইংরেজি বছরের উইশ করছি। অভিনেতা তরুণকুমারকে উইশ করেছি। তরুণকুমার তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ভদ্রলোককে উইশ করতে বললেন। কিন্তু সেই ভদ্রলোককে চিনতাম না। তবুও উইশ করলাম। পরে জানলাম তিনিই তপন সিংহ। তার কয়েকদিন পরে পরিচালকের দুই সহকারী আমাদের বাড়িতে হাজির। তপনবাবু চারুশশীর চরিত্রে আমাকে পছন্দ করেছেন। প্রথমে বাবা মা রাজি হচ্ছিলেন না। পরে রাজি হলেন। তার আবার তিনটে কারণ ছিল— প্রথমত, এটি রবীন্দ্রনাথের গল্প নিয়ে ছবি। দ্বিতীয়ত, পরিচালক তপন সিংহ। আর তৃতীয়ত, এই ছবিতে আমাকে নায়িকার চরিত্র অফার করা হয়েছিল। তপনবাবু কথা বলতেন কম। তবুও প্রথম দিন চারুশশীর চরিত্রে লম্বা ফ্রক এবং নাকে নোলক পরে, দু’টি বিনুনি ঝুলিয়ে যখন ফ্লোরে এসে দাঁড়ালাম, তখন তপনবাবু বলেছিলেন, পারফেক্ট।’
তোমাদের প্রিয় একটি বই হল খগেন্দ্রনাথ মিত্রের লেখা ‘ভোম্বল সর্দার’। সেই গল্প নিয়ে পরিচালক নৃপেন গঙ্গোপাধ্যায় যখন ছবি তৈরির ভাবনা চিন্তা করছেন, তখন লেখক তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলেন যে, বইটি চারটি খণ্ড নিয়ে। তিনি কোন খণ্ড নিয়ে ছবি করতে চাইছেন? তখন নৃপেনবাবু জানালেন তিনি প্রথম খণ্ডটি নিয়ে ছবি করবেন। মূল যে শিশুচরিত্র তার আবিষ্কারের গল্পটিও অদ্ভুত। ছেলেটির নাম নীলাঞ্জন ভট্টাচার্য। সে তখন কলকাতা পাঠভবনে পড়ত। স্কুলে অভিনয় করত। তাদের শিক্ষক ছিলেন তীর্থঙ্কর। তিনিই পরিচালকের সঙ্গে নীলাঞ্জনের আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন। ক্যামেরাম্যান সৌমেন্দু রায় এবং পরিচালক দু’জনে মিলে তাকে দেখে ছবির জন্য নির্বাচন করলেন। তবে, আউটডোরে গিয়ে একটা সমস্যা হল। আসলে ছেলেটির চোখের সমস্যা ছিল। জোরালো আলোয় চোখ খুলে রাখতে পারত না। শরৎকালে শ্যুটিং হচ্ছে। প্রচণ্ড রোদ। রিফ্লেক্টর লাগালেই নীলাঞ্জন চোখ বুজে ফেলছে। মহাবিপদ। শেষ পর্যন্ত ঠিক হল ছায়ার মধ্যে শুটিং করা হবে। লাগানো হবে না রিফ্লেক্টর। সেইভাবেই শেষ পর্যন্ত কাজটা হয়েছিল। ‘ভোম্বল সর্দার’ জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিল ১৯৮৪ সালে।
বাংলা ছবির এক নামকরা প্রযোজক প্রমোদ লাহিড়ী। প্রখ্যাত পরিচালক ঋত্বিক ঘটক তাঁর দূর সম্পর্কের আত্মীয়। তাঁর প্রযোজনায় ঋত্বিকবাবু শিবরাম চক্রবর্তীর ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’ গল্পের চিত্ররূপ দেওয়ার কাজ শুরু করলেন। ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’ র প্রধান চরিত্র ছিল একটি দুরন্ত ছেলে কাঞ্চন। এই চরিত্রের জন্য পরিচালক এমন কাউকে খুঁজছিলেন, যে দু’চোখে অগাধ সরল বিস্ময় নিয়ে তাকাতে পারবে আজব কলকাতা শহরের দিকে। একদিন সকালে তিনি এসে জানালেন যে, কাঞ্চনের চরিত্রে অভিনেতা পেয়ে গিয়েছেন। প্রযোজক জিজ্ঞেস করলেন, ‘কে সেই বালক?’ বললেন, ‘আপনারই ছেলে পরম।’ বাবা সম্মত হলেন। সেই সূত্রেই পরমভট্টারক লাহিড়ী প্রথম অভিনয় করেছেন এই ছবিতে এবং এটি তাঁর শেষ অভিনয়ও বটে। এই ছবিতে ছিলেন কালী বন্দ্যোপাধ্যায়, জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায়, পদ্মা দেবী, কেষ্ট মুখোপাধ্যায়, জহর রায়। নামী শিল্পীদের মাঝখানে পরম এত সুন্দর করে অভিনয় করেছিলেন, বোঝাই যায়নি যে, এটি তাঁর প্রথম ছবি।
সত্যজিৎ রায় তোমাদের জন্য চারটি ছবি তৈরি করেছেন ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’, ‘সোনার কেল্লা’, ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ ও ‘হীরক রাজার দেশে’। এদের নির্মাণ পর্বের গল্প তোমরা কমবেশি সবাই জানো। কিন্তু একটা কথা শিশু চলচ্চিত্র সম্পর্কে এই বিশ্বখ্যাত পরিচালক বলেছিলেন, ‘শিশুচিত্রে যে তিনটি গুণ না থাকলেই নয় অর্থাৎ সারল্য, সাবলীলতা ও সর্বজনীনতা— এই তিনটি গুণের সমাবেশ সচরাচর দেখা যায় না। শিশু সাহিত্যের ক্ষেত্রেও এর
অভাব লক্ষ্যণীয়।’