যে কোনও ব্যবসায় শুভ ফল লাভ। বিশেষ কোনও ভুল বোঝাবুঝিতে পারিবারিক ক্ষেত্রে চাপ। অর্থপ্রাপ্তি হবে। ... বিশদ
আজ বাজার বন্ধ নাকি! তাহলে তো বাজারের গেট বন্ধ থাকত! গান শুনতে শুনতে চারদিকে তাকিয়ে দেখলেন। বাজার বসেনি। মাংসের দোকানের ঝাঁপ বন্ধ। কেবল তিনটে বেড়াল ঘুরে বেড়াচ্ছে। এমন সময় দেখতে পেলেন ফুলওয়ালা ঝুনু পোস্টারের মতো একটা কিছু নিয়ে বাজারে ঢুকল। ঝুনুকে ডাকলেন। ঝুনু ফিরে তাকাল, ‘আজ বাজার বন্ধ মাস্টারমশাই।’ যামিনীবাবু অবাক, ‘বন্ধ! কেন!’ ঝুনু বলল, ‘কাল দুপুরে পচা মারা গেছে। তাই।’
বাজারের কোনও দোকানি মারা গেলে একদিনের জন্য বাজার বন্ধ রাখা হয় । বাজারের গেটে তালা দেওয়া হয়। বাজারের পাশের রাস্তায় ইট দিয়ে একটা বেদী করা হয়। আর একটা পোস্টারে শোকসংবাদটি থাকে। তাতে সাঁটা থাকে মৃত ব্যক্তিটির ছবি। এখন ঝুনুর হাতে হয়তো ওইরকমই একটা পোস্টার। যামিনীবাবু অবাক, ‘পচা!’ ঝুনু বলল, ‘হ্যাঁ। গোপাল মাখাল।’
পচার ভালো নাম গোপাল মাখাল সেটা তাঁর জানা ছিল না। পচা মাছ বিক্রি করত। অ্যাডভোকেট রতন বক্সী বাজারে ঢুকে প্রথমে পচার সামনে এসে দাঁড়াতেন, ‘এই পচা মাছ দে।’ পচা হাসতে হাসতে বলত, ‘কী যে বলেন উকিলবাবু। সব মাছ টাটকা। এই তো পাতিপুকুরের মাছের আড়ত থেকে এক্ষুনি নিয়ে এলাম।’ রতন বক্সী রসিক মানুষ, ‘তোকে মাছ দিতে বলেছি। অন্য কিছু তো বলিনি।’
যামিনীবাবু ঝুনুর দিকে তাকালেন, ‘এবার কি শোক বেদী বাজারের ভেতরেই হবে?’ ঝুনু বলল, ‘হ্যাঁ, মাস্টারমশাই। পচা আমাদের বলে গেছে সে মারা গেলে যেন তাকে বাজারের ভেতরেই স্মরণ করি। ওই দেখুন দক্ষিণ চাতালে বেদী তৈরি হয়েছে। এবার গিয়ে এই পোস্টারটা ওখানে লাগাব।’ তখনও গান চলছে। হাসি হাসি পরব ফাঁসি...। যামিনীবাবু জিজ্ঞেস করলেন, ‘কে গান গাইছে?’ ঝুনু হাসতে হাসতে বলল, ‘কে আবার! পাগলা নিতাই। আসুন না আমার সঙ্গে।’ পাগলা নিতাই আবার কে! হয়তো এই বাজারের কোনও বিক্রেতা। সবার নাম তো তিনি জানেন না।
ওখানে পৌঁছতে পৌঁছতে গান শেষ হয়ে গেল। বেদিতে ফ্রেমে বাঁধানো পচার ফোটোগ্রাফ। ছবিতে একটা রজনীগন্ধার মোটা মালা। ঝুনু এবার পোস্টারটা লাগাল। তাতে লেখা পরলোকে চলে গেলেন গোপাল মাখাল।
যামিনীবাবু দেখলেন বছর পনেরোর একটি অচেনা ছেলে বেদীর পাশে বসে আছে। ছেলেটির দিকে ঝুনু বলল, ‘মাস্টারমশাই এই হল পাগলা নিতাই।’ ছেলেটি আবার শুরু করতে যাচ্ছিল সেই একই গান। একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি। যামিনীবাবু হাত তুলে ওকে নিরস্ত করলেন, ‘থাক। থাক।’ পাগলা নিতাই থমকে গেল। তারপর চাতাল থেকে নেমে যামিনীবাবুকে ঢিপ করে একটা প্রণাম করে বলল, ‘আমার নাম নিতাই। কিন্তু সবাই আমাকে পাগলা নিতাই বলে। পচাকাকাও বলতেন। আমি কিন্তু পাগলা নই। পাতিপুকুরের মাছের আড়তে কাজ করি। আর আমি ওই গান ছাড়া আর কোনও গান জানি না।’ যামিনীবাবু দেখলেন ছেলেটার গায়ে ডোরাকাটা শার্ট। পরনে খাকি ফুলপ্যান্ট। দুটোই ময়লা। কিন্তু ছেলেটার চোখ দুটো বড় নিষ্পাপ এবং উজ্জ্বল।
ছেলেটা বলল, ‘পচাকাকার কাছে আপনার কথা খুব শুনেছি। আপনি তো মাস্টারমশাই! বাজার থেকে বেরিয়ে বড় রাস্তার ধারে যে হলদে ইশকুলবাড়িটা দেখা যায় সেখানেই আপনি পড়ান তো!’ যামিনীবাবু বললেন, ‘পড়াতাম। এখন বুড়ো হয়ে গেছি। ইস্কুল বলল, আর নয়। এবার অবসর নাও। নিলাম।’ নিতাই হাসতে হাসতে বলল, ‘কী যে বলেন! মাস্টারমশাইরা কি কখনও বুড়ো হন!’ কথাটা বেশ অন্যরকম। স্নেহময় দৃষ্টিতে নিতাইয়ের দিকে তাকালেন। ঝুনু তখন ধূপদানিতে গোছা গোছা ধূপ গুঁজে দিচ্ছে।
হঠাৎ নিচু স্বরে নিতাই বলল, ‘একটু তফাতে আসবেন! কয়েকটা কথা বলার ছিল। একটা প্রশ্নের উত্তর কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছি না।’ যামিনীবাবু বললেন, ‘যা বলার এখানেই বল।’ নিতাই বলল, ‘একটু তফাতে আসুন না মাস্টারমশাই।’ নিতাইয়ের সঙ্গে খানিকটা তফাতেই গেলেন
যামিনীবাবু। বাজার বসেনি। তাই ফাঁকা। কেবল হাঘরে তিনটে বেড়াল
ঘুরে বেড়াচ্ছে।
নিতাই জিজ্ঞেস করল, ‘যে গানটা গাইছিলাম সেটা কি সত্যিই ক্ষুদিরামের লেখা গান? যাকে জিজ্ঞেস করি সে-ই বলে ক্ষুদিরামের।’ যামিনীবাবু বললেন, ‘তোমার কী মনে হয়? ক্ষুদিরামের নয়?’ নিতাই মাথা নাড়ে, ‘ক্ষুদিরামের নয়। চকদ্বীপের ইশকুলে ক্লাস সিক্স পর্যন্ত পড়েছি। তখন আমরা মেদিনীপুরে থাকতাম। আমাদের মাস্টারমশাই শৈলবাবু বলেছিলেন এই গান কার লেখা। তাঁর নামটা ভুলে গেছি।’ যামিনীবাবু জিজ্ঞেস করলেন, ‘কলকাতায় এসে কোনও স্কুলে ভর্তি হওনি?’ ম্লান হাসে নিতাই, ‘না। পড়াশোনাটাই ছেড়ে দিতে হল। বাবা মেদিনীপুর ছেড়ে কলকাতায় চলে এলেন। ছুতোরের কাজ করেন। ছেলেকে পড়ানোর খরচ আর জোগাতে পারলেন না। সামন্তমশাইকে বলেকয়ে আমাকে পাতিপুকুরের মাছের আড়তে ঢুকিয়ে দিলেন।’
যামিনীবাবু বললেন, ‘ওই গান কার লেখা তা জেনে কী হবে!’ নিতাই বলল, ‘আমার অনেক কিছু জানতে ইচ্ছে করে মাস্টারমশাই। আবার একটু একটু করে পড়াশোনা করতেও ইচ্ছে করে।’ কথা শেষ হল না। খবর পেয়ে অ্যাডভোকেট রতন বক্সীও চলে এসেছেন। যামিনীবাবু নিতাইকে নিয়ে পচার স্মরণ-বেদীর সামনে এসে দাঁড়ালেন। আর বাজারের দোকানি-বিক্রেতা কয়েকজন। মিনিট পনেরোর মধ্যে স্মরণসভা শেষ হয়ে গেল। যামিনীবাবু বাজার থেকে বেরিয়ে এলেন। খানিকটা হেঁটে শিবমন্দিরের কাছাকাছি গেলে রাস্তার একপাশে কিছু মানুষ আনাজপাতি নিয়ে বসে। ভাগ্যিস আজ শনিবার। বাড়িতে নিরামিষ রান্না হয়। সেটাই বাঁচোয়া।
খানিকটা এগিয়ে যাওয়ার পর তাঁকে থমকে দাঁড়াতে হল। কে যেন নিচু হয়ে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘স্যর, ভালো আছেন? আমাকে চিনতে পারছেন?’ যামিনীবাবু হাসলেন, ‘চিনতে পারব না কেন! কেমন আছ প্রিয়াংশু? গভর্নমেন্ট কলেজে পড়াচ্ছ তো! হঠাৎ এ পাড়ায়! সে বলল, ‘কলকাতার কলেজে বদলি হয়ে এসেছি। কাছেই থাকি। লেকটাউনে।’ যামিনীবাবু বললেন, ‘বেশ। বেশ। তুমি তো ইতিহাসের অধ্যাপক!’ প্রিয়াংশু বলল, ‘হ্যাঁ। স্যর।’ উনি বললেন, ‘তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে ভালোই হল। একবার বিদায় দে মা গানটি কি ক্ষুদিরামের লেখা?’ প্রিয়াংশু বলল, ‘না, না।’ উনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘তবে কার লেখা!’ প্রিয়াংশু বলল, ‘সেটা তো জানি না।’ যামিনীবাবু বললেন, ‘ঠিক আছে। অনেকদিন পরে তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে ভালো লাগল।’
প্রিয়াংশু চলে গেল। ইতিহাসের অধ্যাপক জানে না। পাগলা নিতাইও জানে না। তবে দু’জনের মধ্যে পার্থক্য আছে। প্রিয়াংশু জানে না বলে লজ্জিত নয়। পাগলা নিতাই নামটা জানার জন্য হাঁকপাঁক করছে। বাঁকুড়ার লোককবি পীতাম্বর দাস এই গানের গীতিকার এবং সুরকার। ইতিহাসের অধ্যাপক জানে না। তিনি মনে বড় ব্যথা পেলেন।
সেদিন সন্ধেবেলায় ফ্ল্যাটবাড়ি থেকে রাস্তায় যামিনীবাবু দেখলেন নিতাই দাঁড়িয়ে আছে।
যামিনীবাবু জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী ব্যাপার নিতাই তুমি!’ নিতাই বলল, ‘ঝুনুকাকা আপনার ঠিকানাটা দিয়েছেন। আপনার ফ্ল্যাটেই যাচ্ছিলাম।’ উনি অবাক, ‘কেন!’ নিতাই বলল, ‘রবিবার বিকেলটুকু আমাকে একটু সময় দিতে পারবেন? আমাকে একটু যদি পড়ান মাস্টারমশাই। আপনাকে অবশ্য বেশি টাকা বেতন দিতে পারব না। সাধ্যমতো দেব। এখন এই বয়সে আমাকে ইশকুলে তো নেবে না। পড়াশোনা করার আমার খুব ইচ্ছে।’
রবিবার বিকেলে যামিনীবাবু স্বামী বিবেকানন্দ স্টাডি সেন্টারে যান। ওখানে সুন্দর সুন্দর বক্তৃতা হয়। তাই রবিবার বিকেলের জন্য উনি উন্মুখ হয়ে থাকেন। বললেন, ‘রবিবার ছাড়া অন্য কোনও দিন হলে হবে?’ নিতাই বলল, ‘না। রবিবার বিকেলেই যা একটু সময় পাই।’ খানিকক্ষণ ভেবে বললেন, ‘বেশ। তাই এসো। তোমাকে টাকা-পয়সা দিতে হবে না।’ পাগলা নিতাইয়ের চোখে আনন্দের অশ্রু। সে ঢিপ করে একটা প্রণাম করল। যামিনীবাবুর মনে হল এতদিন তিনি এই পাগলা নিতাইদেরই খুঁজছিলেন।