যে কোনও কর্মেই একটু বাধা থাকবে। তবে উপার্জন মন্দ হবে না। ললিতকলায় ব্যুৎপত্তি ও স্বীকৃতি। ... বিশদ
সিঙুমামার রাগ হয়! ইচ্ছে করে পুঁচকেটার কান মলে দিয়ে ওঠবস করাতে। যতই চিড়িয়াখানায় থাকুক, আদতে তো জঙ্গলের রাজা। অবশ্য পেটটা সত্যিই ঠিক নেই। প্রতিদিন একই খাবার খেয়ে খেয়ে অরুচি। কিন্তু কাকে বলবে একথা? চিড়িয়াখানায় তার বন্ধু বলতে রয়েছে একটি ইঁদুর।
বহুযুগ আগে একবার জঙ্গলে নাকি জাল পেতে সিংহ ধরা হচ্ছিল। সেই সময় ইঁদুরই নাকি জাল কেটে সিংহদের এক পূর্বপুরুষকে বাঁচিয়েছিল। সেই থেকে সিংহ আর ইঁদুরদের বন্ধুত্ব। সিঙুমামার ইঁদুর বন্ধুর নাম ইঁদে। সেই ইঁদের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল সিঙুমামা। সে চিড়িয়াখানার সদস্য নয়। তবে, পাঁচিলের ফাঁকফোঁকর গলে ঢুকে পড়ে চিড়িয়াখানায়। ওর কাছে সব খবর থাকে। চিড়িয়াখানার বাইরে কী হচ্ছে তাও ও জানে।
‘কী করে কোথায় ছিলি? বেশ খুশি খুশি দেখাচ্ছে। ব্যাপারটা কী?’ গম্ভীর হয়ে বলল সিঙুমামা।
ইঁদে কোনও কথার উত্তর না দিয়ে খালি হা হা করে হাসতে লাগল।
সিঙুমামা রেগে গেল এবার। গলাটা আরও মোটা করে প্রশ্ন করল, ‘ফাজলামি না করে বল কেসটা কী।’
তাতেও হাসি থামে না ইঁদুরের। হাসতে হাসতে বলল— ‘এবার বড় গণ্ডগোল হয়েছে।’
ফের পেটে ব্যথা করছে সিঙুমামার। তাও যন্ত্রণা চেপে ভ্রূ কুঁচকে জানতে চাইল— ‘কী সমস্যা?’
—ভ্রান্তিপুরের বিভ্রম সঙ্ঘের পুজোয় ঠাকুর এসেছে। তবে বাহন নেই!
—মানে?
—আরে দুর্গাপুজো শুরু হয়েছে জানো না? আজ তো ষষ্ঠী। আর এখন তো সব থিম পুজো। আগের মতো ঠাকুরের পায়ের তলায় বাহন থাকে নাকি? তাদের আলাদা করে তৈরি করতে হয়। শিল্পী সেসব তৈরি করতে ভুলে গেছে। সেই নিয়ে বিভ্রম ক্লাবের সঙ্গে শিল্পীর ঝামেলা।
—যাহ বাবা!
সিঙুমামা অবাক হয়ে গেল। তারপরই মনে পড়ল আগের বছর দুর্গাপুজোয় বিভ্রম সঙ্ঘের তোফা ভোগ হয়েছিল। ইঁদেই বলেছিল, ভোগে ছিল ঘি দিয়ে ভুরভুরে গন্ধওয়ালা গোবিন্দভোগ চালের পোলাও। সঙ্গে কিশমিশ, কাজু। ইয়া বড় বেগুনি, আর ছিল আমাদা দিয়ে সোনামুগের ডাল, নারকোল কোরা দেওয়া বেগুন বাসন্তী, কচুর লতি, আলু পটলের ডালনা, খেজুর আমসত্ত্বের চাটনি, পাঁপড়, পায়েস, বোঁদে, রাবড়ি, হরেক মিষ্টি।
মায়ের ভোগ প্রসাদের কথা মনে করেই সিঙুমামার মুখটা কেমন করুণ হয়ে গেল। ইঁদে সেটা দেখে বলল— হলটা কী?
সিঙুমামার চোখ ছলছল করে উঠল। কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘ভাই, চিড়িয়াখানার খাবার খেয়ে জিভে চড়া পড়ে গেছে। একটু যে মায়ের ভোগ খেয়ে জীবন ধন্য করব তার উপায় কোথায়?’
‘শান্ত হও, শান্ত হও। তোমার কান্না শোভা পায় না। প্যাঁচা দেখে ফেললে কথাটা রাষ্ট্র করবে।’— সান্ত্বনা দিল ইঁদুর।
মামা শান্ত হল। ইঁদে বলল, ‘আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে। তবে আরও কয়েকজনকে লাগবে।’
সিঙুমামার কান খাড়া। বলল— ‘কাদের ডাকতে হবে বল। আমি এখনই তলব করছি।’
—শোনো। আমরা আজ রাতেই আমাদের অ্যাকশন। আমি আর কয়েকজন ইঁদুর বন্ধু মিলে চিড়িয়াখানার পিছনে একটা বড় গর্ত করব। ভোর নাগাদ গর্ত তৈরি হয়ে যাবে। ওই ফাঁক দিয়ে আমি, তুমি, ময়ূর প্যাঁচা আর রাজহাঁস বেরিয়ে যাব।
—কিন্তু ময়ূর, প্যাঁচা আর রাজহাঁস তো উড়তে জানে!
—হ্যাঁ তাই তো!
জিভ কাটল ইঁদুর। ‘বেশ বেশ তবু একসঙ্গে থাকা ভালো। আমি বরং সবাইকে খবরটা দিই গিয়ে।’ বলেই বেরিয়ে গেল সে।
...
ভোর রাত। নাক ডাকিয়েই ঘুমচ্ছিল সিঙুমামা। হঠাৎ কানে কে যেন কামড়ে দিল। তড়াক করে উঠে পড়ল মামা। দেখে পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে ময়ূর, প্যাঁচা, সাদা হাঁস আর ইঁদুর।
‘আরে চলো চলো। দেরি হয়ে যাবে তো?’— বলে উঠল ইঁদে।
সিঙুমামা চোখ কচলে বলল, ‘কোথাও যাব?’
—ফলো মি। গেলেই বুঝতে পারবে।
সিঙুমামা দেখল পাঁচিলের গায়ে ছোটখাট একটা সুড়ঙ্গ।
সবাই সুড়ঙ্গের মধ্যে দিয়ে বাইরের বড় রাস্তায় বেরিয়ে এল। তখনও সূর্য ওঠেনি। রাস্তায় লোকও নেই। হাঁটতে হাঁটতে সকলে পৌঁছে গেল বিভ্রম সঙ্ঘের প্যান্ডেলে। প্যান্ডেলে পৌঁছে দেখে ঢাকি আর তার ছেলে করুণ মুখে ঘুমিয়ে আছে। মামার ভারী মায়া হল ঢাকির ছেলেটাকে দেখে।
ইঁদে ফিসফিস করে বলল, ‘শোনো দাদা, ভাই ও বোনেরা। আমরা একটা মজার খেলা খেলব।’
‘কী খেলা?’ সবাই জিজ্ঞাসা করল।
—মা দুর্গা আর তার ছেলে-মেয়েদের মূর্তির দিকে তাকিয়ে দেখ। বাহন নেই! আজ থেকে আমরা বাহন হয়ে পায়ের তলায় দাঁড়িয়ে থাকব। সিঙুমামা দুর্গা মায়ের পায়ের তলায় থাকবে। আমি থাকব গণেশ ঠাকুরের পায়ের কাছে। প্যাঁচা থাকবে মালক্ষ্মীর পায়ের কাছে, ময়ূর থাকবে কার্তিকের পায়ের কাছে আর রাজহাঁস থাকবে দেবী সরস্বতীর পায়ের কাছে।
মুখ খুলল সাদা হাঁস, ‘বুঝেছি, সবাইকে স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।’
প্যাঁচা বলল, ‘সব ঠিক আছে। কিন্তু এর মধ্যে যদি শিল্পী ভদ্রলোক বাহন নিয়ে হাজির হন?’
‘সে তখন দেখা যাবে। নাও নাও সবাই পজিশন নাও। আর দেরি করা ঠিক হবে না,’ ইঁদে তাড়া দিল।
সিঙুমামা মনে মনে বলল, মা, মা গো, ক্ষমা কোরো মা। তোমার প্রসাদ যেন পাই।
ওদিকে সূর্য উঠে গিয়েছে। ক্লাবের লোকেরা প্যান্ডেলে ঢুকতে শুরু করেছে।
পুজোর উদ্যোক্তারা প্যান্ডেলে ঢুকেই হাঁ হয়ে গেল! এই তো গত রাতে কোনও বাহন ছিল না। আজ দেবদেবীর পায়ের তলায় বাহনরা হাজির। শিল্পী নিশ্চয়ই রাতে বাহন রেখে গিয়েছেন চুপিচুপি! সবার ভারী আমোদ হল।
শুরু হল সপ্তমী পুজো। অঞ্জলিও হল। সকলে চোখ বন্ধ করে অঞ্জলি দিচ্ছিল। সেইফাঁকে সিঙুমামা একটু কেশর চুলকে নিল। বাকিরাও একটু আড়মোড়া ভেঙে নিল।
তারপর হল ভোগ নিবেদন। কাপড় দিয়ে ভোগ আড়াল করা হল। এই ফাঁকে ঢাকিটাও গেল জল খেতে।
ইঁদুর এবার ভোগ খেতে খানিকটা এগিয়ে যেতেই সিংহ আটকাল। চাপা গলায় বলল, ‘এটা ঠিক হচ্ছে না। এটাকে চুরি করে খাওয়া বলে। দেখ, আমি পুজোয় এসে বুঝতে পারলাম, বাহন শুধু বাহন নয়। বাহনের অনেক অর্থ আছে। গণেশ ঠাকুর বুদ্ধি ও জ্ঞানের দেবতা। তার পায়ের তলায় থাকে মূষিক বা ইঁদুর। ইঁদুরের হাতটান স্বভাব আছে। তাই মূষিককে বাহন করে তিনি চুরি করার ইচ্ছাকে দমন করে ধৈর্য ধরে কাজ করতে বলছেন। সরস্বতী ঠাকুরের পায়ের তলায় সাদা হাঁস। আমরা জানি, জল দুধ একসঙ্গে মিশে গেলেও হাঁস শুধু দুধটুকুই গ্রহণ করে। অর্থাৎ খারাপটাকে বাদ দিয়ে ভালো টুকুই নেয়। হাঁসের বিবেকবোধ আর বিচার বোধ আছে। তাই সে সরস্বতীর পায়ের তলায়। মা দুর্গার পায়ের তলায় সিংহ। আমি হলাম পশুরাজ। দেবী বলছেন, মনের মধ্যে পশুর মতো হিংসা ত্যাগ করতে। বিনয়ী হতে। লক্ষ্মীদেবীর পায়ের তলায় প্যাঁচা। প্যাঁচা লক্ষ্মীদেবীর বাহন হয়েও কেমন ধনহীন। সকলের আড়ালে থেকে সাধনা করে। যেন তার কোনও লোভ নেই। আবার কার্তিকদেবের বাহন ময়ূর। ময়ূর সকালে ওঠে। বিষধর সাপের হাত থেকে আমাদের রক্ষা করে। দরকার পড়লে তবেই যুদ্ধ করে। এতগুলো গুণ থাকলে তবেই মায়ের ভক্ত হওয়া যায়। তাই আমরা এভাবে চুরি করে মায়ের ভোগ খাব না। এসো আমরা সকলে মায়ের কাছে প্রার্থনা করি চোখ বুজে। ক্ষমা চাই এভাবে আসার জন্য।’
মামার কথা শুনে সকলেই গড় হয়ে দুর্গা মায়ের কাছে ক্ষমা চাইতে লাগল।
ওরা যখন প্রার্থনা করছিল চোখ বন্ধ করে, ঠিক তখনই কাপড় সরিয়ে নেওয়া হল।
সবাই দেখল বাহনরা সবাই জ্যান্ত! অতবড় সিংহ দেখেই প্যান্ডেল ছেড়ে সবাই পালিয়ে গেল। নিমেষের মধ্যে চত্ত্বর ফাঁকা হয়ে গেল। শুধু ঢাকির ছেলেটা পালাতে পারল না। সিংহ দেখল ঢাকির পাঁচ বছরের ছেলেটা বাবাকে দেখতে না পেয়ে ভয়ে কাঁপছে। সিঙুমামা ঢাকির ছেলেটাকে কাঁধে চড়িয়ে নিয়ে এল বেদিতে। তারপর মায়ের ভোগ প্রসাদের সামনে ছেলেটাকে বসিয়ে দিল। ছেলেটা প্রথমে অবাক হল। তারপর থালা থেকে একটা মিষ্টি তুলে নিয়ে কুটুস করে কামড় দিল। তারপর একটা একটা করে মিষ্টি নিয়ে সিংহ, প্যাঁচা, ময়ূর, ইঁদুর আর হাঁসের মুখে তুলে দিল।
এদিকে শিল্পী ভদ্রলোক ঠিক ওই সময়েই হাজির হলেন ফাঁকা প্যান্ডেলে। তাঁর সঙ্গে ছিল মাটির বাহন। কিন্তু কোথাও কাউকে না দেখতে পেয়ে খুব অবাক হলেন। তারপর হঠাৎ জ্যান্ত বাহনদের দেখে মাটির বাহন ফেলে দৌড় দিলেন!
সিংহ বলল, ‘মায়ের প্রসাদ পেয়ে গেছি। চল এবার ফিরে যাই আমাদের অস্তানায়।’
ওদিকে ইতিমধ্যে চিড়িয়াখানা থেকে সিংহ পালানোর খবর রটে গিয়েছে সারা শহরে। শহরের রাস্তাঘাট ফাঁকা করে দিয়েছে পুলিস। সবাই প্রাণের ভয়ে ঘরে দোর এঁটে বসে আছে। তাই ফাঁকা রাস্তা পেয়ে ওরা নিশ্চিন্তেই চিড়িয়াখানায় ঢুকে গেল। চিড়িয়াখানায় ফের সিংহকে দেখে সকলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।
আর বিভ্রম সঙ্ঘের সদস্যরা লাঠিসোঁটা হাতে প্যান্ডেলে ফিরে দেখল, ঢাকির ছেলেটা মনের আনন্দে নাচতে নাচতে কাঁসর বাজাচ্ছে। আর মণ্ডপের মাঝে পড়ে রয়েছে মাটির সিংহ, প্যাঁচা, ময়ূর, হাঁস, ইঁদুর!