যে কোনও কর্মেই একটু বাধা থাকবে। তবে উপার্জন মন্দ হবে না। ললিতকলায় ব্যুৎপত্তি ও স্বীকৃতি। ... বিশদ
ব্যস্ততা তুঙ্গে উত্তর কলকাতার কুমারটুলি সর্বজনীনের পুজো মণ্ডপেও। ১৯৩১ সালে এই পুজোর সূচনা। কুমোরটুলি অঞ্চলের মৃৎশিল্পীদের নিজস্ব পুজো এটি। তবে এবার তাঁদের উৎসাহ উদ্দীপনা সীমাহীন। কারণ এবছর পুজো কমিটির সভাপতি হয়েছেন দেশবরেণ্য এক ব্যক্তি। শারদোৎসবের মাধ্যমে দেশবাসীকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উদ্দীপ্ত করতে চাইছেন তিনি। তাঁর নির্দেশে পরাধীন দেশের যন্ত্রণাময় ছবিতে মণ্ডপ সেজে উঠছে। অবশ্য এতে ক্ষুব্ধ হয়ে পুজো কমিটির প্রাক্তন সভাপতি স্যার হরিশঙ্কর পাল ঢিলছোড়া দূরত্বে পৃথক আর একটি পুজোর আয়োজন করলেন (বর্তমানে এটি হাটখোলা গোঁসাইপাড়ার পুজো হিসেবে পরিচিত)। কিন্তু এ ঘটনায় বিন্দুমাত্র না দমে বিশ্বকর্মার বরপুত্রেরা দিনরাত এক করে শিল্পের নিদর্শন রাখছেন মণ্ডপ জুড়ে। প্রতিমা গড়েছেন স্বনামধন্য ভাস্কর গোপেশ্বর পাল। জি পাল নামে যিনি দেশে-বিদেশে সমধিক পরিচিত। প্রতিমা মণ্ডপে স্থাপন হয়ে গিয়েছে।
আচমকা ছন্দপতন! পঞ্চমীর রাতে হঠাৎই আগুন লেগে গেল কুমারটুলি সর্বজনীনের পুজো মণ্ডপে। অনেক চেষ্টায় আগুন নেভানো গেল। মণ্ডপের খুব বেশি ক্ষতি না হলেও লেলিহান অগ্নিশিখায় সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়ে গেল একচালার মাতৃপ্রতিমা।
কী হবে এবার! পুজো কি তবে বন্ধ হয়ে যাবে? পুজো গ্রহণ করবেন না মা দুর্গা? এ যে ঘোর অনাচার! উদ্যোক্তারা দিশেহারা। কান্নায় ভেঙে পড়লেন অনেকেই।
সঙ্কট নিরসনে আলোচনায় বসলেন প্রতিমাশিল্পী গোপেশ্বর এবং পুজো কমিটির সভাপতি। গোপেশ্বর জানিয়ে দিলেন নতুন করে কাঠামো বানিয়ে প্রতিমা প্রস্তুত করতে খুব কম হলেও দু’দিন সময় তো লাগবেই।
কিন্তু অত সময় কোথায়! রাত পোহালেই যে মহাষষ্ঠী। দেবীর বোধন। এখন উপায়?
উপায় বাতলে দিলেন স্বয়ং সভাপতি। জলদগম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ‘যদি একচালায় সম্পূর্ণ প্রতিমা না গড়ে প্রতিটি প্রতিমা আলাদা আলাদা করে পৃথক চালায় গড়া হয়? তাহলে তো অনেক কম সময়ে পাঁচটি প্রতিমা একাধিক মৃৎশিল্পী নির্মাণ করতে পারবেন।’
চমকে গেলেন প্রথিতযশা মৃৎশিল্পী গোপেশ্বর। সত্যিই তো! এভাবেই তো সম্ভব রাতারাতি সম্পূর্ণ দুর্গা প্রতিমা নির্মাণ! পূর্ণ উদ্যমে সহকারী শিল্পীদের নিয়ে সৃষ্টিকর্মে মেতে উঠলেন তিনি। দেবী দুর্গার প্রতিমা গড়লেন তিনি নিজে। অন্য মূর্তিগুলি তৈরি করলেন তাঁর সহকর্মীরা। একচালার প্রতিমার চিরকালীন রীতি ভেঙে দেবী দুর্গা ও তাঁর সন্তানদের পৃথক পৃথক চালায় অবস্থান সেই ১৯৩৮ সালেই প্রথমবার।
ছকভাঙা এই পুজোর সাক্ষী রইল শহর কলকাতা। যদিও গোঁড়া ব্রাহ্মণেরা এটা নিয়ে তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। তাঁরা এই প্রতিমা শাস্ত্র বিরোধী বলে কটাক্ষ করে প্রথমে পৌরোহিত্য করতে রাজি হননি। তখন উদ্যোক্তারা যুক্তি দিলেন, মা যখন যুদ্ধে অসুর নিধনে রত তখন সন্তানদের রণভূমি থেকে দূরে থাকাই যুক্তিযুক্ত। পরিবারের ছোটদের সঙ্গে নিয়ে তো কেউ সত্যিই যুদ্ধক্ষেত্রে যান না। হয়তো এই রূপেই এখানে পুজো গ্রহণ করা মায়ের অভিপ্রায়। কারণ তাঁর ইচ্ছে অনুযায়ী যে এই জগৎ সংসার চলে। সবই মায়ের লীলা!
শেষ পর্যন্ত সভাপতির দৃঢ়তায় ও মৃৎশিল্পীদের ঐকান্তিক প্রয়াসে সেবার পুজো সম্পন্ন হল। পরের বছর এই পুজোয় মা দুর্গার পরনে ছিল সত্যিকারের বাঘছাল! এও এক অভিনবত্ব। কে ছিলেন ১৯৩৮ সালে কুমারটুলি সর্বজনীনের সভাপতি? কার বলিষ্ঠ অনুপ্রেরণায় আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মৃৎশিল্পী গোপেশ্বর পালের হাত ধরে এই প্রথাভাঙা অভিনব প্রতিমার চলন হল দেশজুড়ে? এভাবে এখনকার জনপ্রিয় ‘থিম পুজো’র পথ প্রকৃতপক্ষে দেখিয়েছিলেন কে? তিনি আমাদের সকলের প্রিয় ভারতমাতার বীর সন্তান নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু।