সম্পত্তিজনিত মামলা-মোকদ্দমায় সাফল্য প্রাপ্তি। কর্মে দায়িত্ব বৃদ্ধিতে মানসিক চাপবৃদ্ধি। খেলাধূলায় সাফল্যের স্বীকৃতি। শত্রুর মোকাবিলায় সতর্কতার ... বিশদ
বাংলাদেশের ঢাকা জেলার ময়মনসিংহের রাড়িখাল গ্রামে ১৮৫৮ সালের ৩০ নভেম্বর জন্ম হয় তাঁর। বাবা ভগবানচন্দ্র ফরিদপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হওয়া সত্বেও চেয়েছিলেন জগদীশচন্দ্র যেন গ্রামের পাঠশালাতেই তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু করেন। দেশপ্রেমী ভগবানচন্দ্র আসলে চেয়েছিলেন মাতৃভাষা ও দেশীয় ধ্যানধারণার সঙ্গে শৈশব থেকেই ছেলের পরিচয় ঘটাতে। বাবার কাছ থেকে তিনি যেমন উত্তরাধিকারসূত্রে স্বদেশপ্রেম পেয়েছিলেন, তেমনই মায়ের কাছ থেকে পেয়েছিলেন উদারতা। ছেলেবেলায় পাঠশালায় তাঁর সহপাঠী ছিলেন মুসলমান জেলেদের ছেলেরা, এমনকী তাঁদের বাড়ির দাসদাসীদের ছেলেরাও। বিকেলে যখন তিনি তাঁদের সঙ্গে বাড়ি ফিরতেন, তখন তাঁর মা কিন্তু সমান যত্ন করে তাঁদের সবাইকে একসঙ্গে খেতে দিতেন। তাই জাতধর্মের কোনও গোঁড়ামি তাঁকে কখনও ছুঁতেও পারেনি। ছেলেবেলার এই গ্রাম্য সহপাঠীদের প্রভাব তাঁর জীবনে অনেক। এঁদের কাছ থেকেই তিনি পশু পাখি গাছপালা সম্বন্ধে অনেক তথ্য জানতে পেরেছিলেন এবং এর ফলেই প্রকৃতির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিলেন। বাংলা মাধ্যমে পড়ার ফলে পরবর্তীকালে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চা বিষয়ক লেখা তাঁর বইগুলো নতুন দরজা খুলে দিয়েছিল।
পাঠশালার শিক্ষা শেষে তিনি কলকাতার হেয়ার স্কুলে প্রথমে ভর্তি হন। পরে সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষা দেন। এরপর সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে বিএ পাশ করে বিলেতে যান। এই সময় তিনি পদার্থবিদ্যায় বিখ্যাত অধ্যাপক ফাদার লাফোঁর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আসেন। কেমব্রিজ থেকে পদার্থবিদ্যা, রসায়নবিদ্যা ও উদ্ভিদবিদ্যায় ট্রাইপ্স সহ বিএ ও লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে
বি এসসি পাশ করেন।
দেশে ফিরে পদার্থবিদ্যার শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন প্রেসিডেন্সি কলেজে। কিন্তু এখানে তিনি শিকার হন বর্ণবৈষম্যের! তখন ইউরোপীয় অধ্যাপকদের থেকে অর্ধেক বেতন ধার্য ছিল ভারতীয় অধ্যাপকদের জন্য। এর প্রতিবাদে তিনি বিনা বেতনে তিন বছর অধ্যাপনা করেন। অবশেষে কলেজ কর্তৃপক্ষ হার মেনে এই নিয়ম তুলে দিয়ে সবাইকে সমান বেতন দেওয়া স্থির করেন। একদিকে প্রবল অর্থসংকট ও পরিকাঠামোর অসুবিধা, অন্য দিকে পরাধীন দেশের বিজ্ঞানী হওয়ার জন্য নানা বাধা সত্ত্বেও তিনি কিন্তু তাঁর বিজ্ঞান গবেষণা ছাড়েননি। দিনে চার ঘণ্টা নিয়মিত শিক্ষকতা করার পর যেটুকু সময় পেতেন, গবেষণার কাজে তা ব্যয় করতেন। অনেক সময় তখন স্বল্প খরচে স্থানীয় মিস্ত্রিদের শিখিয়ে পড়িয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষার উপকরণও তাঁকে তৈরি করিয়ে নিতে হতো।
১৮৯৫ থেকে ১৮৯৯ সাল পযর্ন্ত তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল পদার্থবিদ্যায় বিদ্যুৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ। তিনি অতি ক্ষুদ্র তরঙ্গ বা মাইক্রোওয়েভ সৃষ্টি করেন এবং কোনও তার ছাড়া এক স্থান থেকে অন্য স্থানে তা পাঠানোতে সাফল্য পান। আধুনিক রাডার, টেলিভিশান, ওয়াইফাই, ব্লুটুথ, স্মার্টফোন, ল্যাপটপ এবং মহাকাশ যোগাযোগের ক্ষেত্রে এই তরঙ্গের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
লিভারপুলে ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশনের সভায় তিনি বক্তৃতা দেবার জন্য ডাক পান। এখানে তাঁর বক্তৃতার বিষয় ছিল ‘অন ইলেকট্রিক ওয়েভস’। তাঁর গবেষণা যে ইউরোপের জ্ঞানীগুণী মহলে আলোড়ন ফেলে দেয় সেই খবর প্রকাশিত হয়েছিল বিখ্যাত ‘পারমানস’ ও ‘স্পেক্টেটর’ পত্রিকায়। এখানে সফল বক্তৃতা শেষে তিনি ফ্রান্স ও জার্মানিসহ আরও বহু দেশে বক্তৃতা দেবার জন্য ডাক পান।
জগদীশচন্দ্রের পরবর্তী গবেষণার বিষয় ছিল প্রাণীবিদ্যা । তাঁর আবিষ্কৃত যন্ত্র ক্রেস্কোগ্রাফ প্রমাণ করে দেয় যে উদ্ভিদও বৈদ্যুতিক আঘাতে সাড়া দেয়। তাঁর আবিষ্কৃত যন্ত্র কোহিয়ারের মাধ্যমে তিনি জড়ের শরীরে চেতনা বা মেটালিক ফ্যাটিগের আভাস তুলে ধরেছিলেন। এই সংক্রান্ত তাঁর গবেষণাপত্রটির নাম ‘রেসপন্স ইন দি লিভিং অ্যান্ড নন লিভিং’। জগদীশচন্দ্রের এই আবিষ্কার বিশ্ববিজ্ঞানী মহলে আলোড়ন তুলে দিল। অনেকে আবার বিরোধিতাও করল। জগদীশচন্দ্রকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন ভগিনী নিবেদিতা। ইংলন্ডে ব্রিটিশ শরীরবিদরা যখন জগদীশচন্দ্রের এহেন আবিষ্কারের সমালোচনায় মুখর, তখন ভগিনী নিবেদিতা তাঁদের যোগ্য জবাব দিতেও পিছপা হননি। জগদীশচন্দ্রের আবিষ্কৃত অন্যান্য যন্ত্রের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল পোটোমিটার, স্ফিগমোগ্রাফ, ফোটোসিন্থেটিক -বাবল প্রভৃতি। তাঁর লেখা বইয়ের সংখ্যাও প্রচুর। ‘কম্প্যারিটিভ ফিজিওলজি’, ‘নার্ভাস মেকানিজম অফ প্লান্টস’, ‘অব্যক্ত’ ইত্যাদি।
জগদীশচন্দ্রকে ব্রিটিশ সরকার ‘নাইটহুড’ প্রদান করেছিলেন। তিনি পেয়েছিলেন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডি এসসি উপাধি। তিনি ছিলেন রয়্যল সোসাইটির সদস্য, লিগ অফ নেশন্সের ইন্টেলেকচুয়াল কোঅপারেশান কমিটির সদস্য,ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের সভাপতি, ভিয়েনার অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সের বৈদেশিক সদস্য, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সভাপতি।
১৯১৫ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘বসু বিজ্ঞান মন্দির’। আমৃত্যু সেখানে গবেষণা করে গেছেন এবং নিজের সঞ্চয়ের সতেরো লক্ষ টাকার মধ্যে তেরো লক্ষ টাকাই এখানে দান করে গিয়েছেন।
কালজয়ী বিজ্ঞানী আইনস্টাইন তাঁর সম্বন্ধে বলেছিলেন — ‘জগদীশচন্দ্র যে সব অমূল্য তথ্য পৃথিবীকে উপহার দিয়েছেন তার যে কোনওটির জন্য বিজয়স্তম্ভ স্থাপন করা উচিত।’
বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার পথপ্রদর্শক সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী আচার্য জগদীশচন্দ্রের জীবনাবসান হয় গিরিডিতে ১৯৩৭ সালের ২৩ নভেম্বর।