সম্পত্তিজনিত মামলা-মোকদ্দমায় সাফল্য প্রাপ্তি। কর্মে দায়িত্ব বৃদ্ধিতে মানসিক চাপবৃদ্ধি। খেলাধূলায় সাফল্যের স্বীকৃতি। শত্রুর মোকাবিলায় সতর্কতার ... বিশদ
উঁকি মেরে দেখি দাদাভাই কী উপহার লুকিয়ে রেখেছে!
ভাইফোঁটাকে দিল্লিতে সবাই হিন্দিতে বলে ‘ভাইদুজ’। তবে আমি ভাইফোঁটাই বলি। বাবা-মা, দাদু-ঠাম সেটাই শিখিয়েছেন। প্রতিবার এই দিনে খুব মজা হয়। দিল্লিতে শীত বেশি। তাও সকালে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে পড়ি ভাইফোঁটার দিন। স্নান সেরে নতুন জামা পরি দাদাভাই, আমি দু’জনেই। পুজোর সময় যে জামা উপহার পাই, তার থেকে বাঁচিয়ে রাখি এই দিনে পরব বলে। দাদাভাই তৈরি হয়ে বসার আগে উঁকি মেরে দেখে নেয়, কী দেওয়া হচ্ছে। আমিও উঁকি মারি, দাদাভাই পিছনে ভাইফোঁটার কী উপহার লুকিয়ে রেখেছে!
মেঝেতে ঠামের হাতে বোনা আসনে বসেই ফোঁটা দিই। ঠাকুরমাকে আমি আদর করে ঠাম বলি। দাদাকে ডাকি দাদাভাই। ফোঁটা দেওয়ার সময় মজা হয়। দাদাভাই লাড্ডু খেতে খুব ভালোবাসে। মিষ্টি খুব পছন্দ ওর। আর থাকে প্যাটিস। গোলাবজামুন। পিতলের থালায় চন্দন, ধান, দূর্বা, দই থাকে। পাশে জ্বলে প্রদীপ। তবে মন্ত্র পড়ে ফোঁটা দেওয়া শেষ হওয়ার আগেই দাদাভাই বলতে থাকে, তাড়াতাড়ি কর। ওর চোখ থাকে প্লেটের দিকে। কতক্ষণে ফোঁটা শেষ হলে কামড় দেবে লাড্ডুতে।
আমিও বলি, একটু তো ধৈর্য ধর। তুই-ই তো খাবি। তার আগে বল, আমার জন্য কী আছে! ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা, যমের দুয়ারে পড়ল কাঁটা.....মন্ত্রও বলি। মা শিখিয়েছে। দুজন দুজনকেই আর যা উপহারই দেওয়া নেওয়া হোক, এবার করোনার জন্য দাদাভাই আর আমি মাস্ক আর পকেট হ্যান্ড স্যানিটাজার রাখছি। যাতে বাইরে খেলতে যাওয়ার সময় পরে যেতে পারি। অস্বস্তি হলেও মাস্ক মাস্ট, বলে দিয়েছেন বড়রা।
ভাইফোঁটা একটা মজার দিন
আমার যখন দেড় বছর বয়স তখন আমার দাদামশাই আমাদের বাড়ি বেড়াতে এসেছিলেন। আমরা বরোদায় থাকি, দাদা আর দিদান থাকেন শান্তিনিকেতনে। সেই সময়ে দাদাকে ফোঁটা দিয়েছিলাম ভাইফোঁটার দিন। তবে সেই স্মৃতি আমার নেই। ছবিতে দেখেছি দাদাই ফোঁটার থালা হাতে ধরে আমার কাছে ফোঁটা নিচ্ছেন। তারপর আমায় আশীর্বাদ করে অল্প একটু মিষ্টি খাইয়ে দিচ্ছেন। এরপর কয়েক বছর কেটে গিয়েছে। আমিও একটু বড় হয়েছি। আমার এখন চার বছর বয়স। দাদা আর নেই, এখন আমার ভাইফোঁটা তাই পাড়ার দাদাদের সঙ্গে। রুদ্র দাদা, পাবলো দাদা এদেরই ফোঁটা দিই আমি। ওরা আমার থেকে অনেকটাই বড়। ভাইফোঁটা একটা মজার দিন। কত কাজ থাকে সকাল থেকে। ফোঁটার থালা তৈরি করি মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে। দই, ঘি, কাজল, চন্দন সাজানো হয় থালায়। তারপর সেগুলো আঙুলে লাগিয়ে আবার দাদাদের কপালে ফোঁটা দিতে হয়। তার সঙ্গে আবার মন্ত্রও বলতে হয়। আমি তো কোনও মন্ত্রই মনে রাখতে পারি না, ছোট তো তাই। তবে মা যেমন বলেন তেমনই বলি। ভাইফোঁটার দিন বাড়িতে অনেক ভালো ভালো রান্না হয়। এখন সেগুলো আমি একটুআধটু খাই। তবে মেনুর মধ্যে মিষ্টিটাই আমার সবচেয়ে ভালো লাগে। এবছর অবশ্য ভাইফোঁটায় আরও মজা হবে। বরোদা থেকেই ভার্চুয়াল ভাইফোঁটায় বেঙ্গালুরুতে আমার মেঘদাদাকে ফোঁটা দেব এই প্রথম।
এই দিনটার জন্য আমি অপেক্ষায় থাকি
প্রতি বছর এই দিনটার জন্য আমি অপেক্ষায় থাকি। সারা বছর ভাইয়ের সঙ্গে ঝগড়া, মারপিট করলেও, ভাইফোঁটার দিন এসব কিছু করি না। আমার ভাই যুগ আমার থেকে আট বছরের ছোট। এদিন সকাল সকাল স্নান সেরে আমি নতুন একটা জামা পরি। আর ভাই ধুতি, পাঞ্জাবি পরে। কপালে চন্দনের ফোঁটা দিয়ে মিষ্টির থালা ওর হাতে তুলে দিই। ভাইফোঁটাতে আমাকেই সব সময় গিফ্ট দিতে হয়। ভাই ছোট বলে আমাকে কিছু দেয় না। তাই আমার খুব দুঃখ হয়। মা বলেছে ভাই বড় হয়ে চাকরি করে আমায় গিফ্ট দেবে। এবার আমি ওর জন্য একটা গাড়ি কিনে রেখেছি। ও গাড়ি খুব ভালোবাসে। তাই এই গিফ্টটা পেলে ভাই নিশ্চয় খুব খুশি হবে। প্রতি বছর এদিন নানান স্পেশাল খাবার থাকে। সকালে লুচি, আলুর তরকারি হয়। আর দুপুরে মাটন বিরিয়ানি, সঙ্গে পুডিং। রাতে আমরা বাইরে ডিনার করতে যাই। তবে এবার করোনার কারণে রাতে বাইরে খাওয়া হবে না। তাই একটু মন খারাপ। মা ভাইয়ের পছন্দের ‘পনির মাখানি’ বানাবে বলেছে। আমিও এটা খেতে খুব ভালোবাসি। এক বছর ভাইফোঁটার সময় আমি কলকাতায় ছিলাম। খুব মজা হয়েছিল। তখন ভাই আরও ছোট ছিল। আমি ঠাকুরদাকেও ফোঁটা দিয়েছিলাম। মামার বাড়ি গিয়ে দাদুকে ফোঁটা দিয়েছি। পিসির বাড়ি গিয়ে দাদামণিকেও ফোঁটা দিয়েছিলাম। সে বছর অনেক গিফ্ট পেয়েছিলাম। ভাইফোঁটা আমার কাছে অত্যন্ত আনন্দের এক দিন। সবাই যেন ভালোভাবে ভাইফোঁটা কাটায়।
ছোটবেলা থেকে মানাকে ফোঁটা দিই
আমি লখনউয়ের মেয়ে। আমার মানা (ঠাকুরদা) মাম (ঠাকুরমা) থাকেন লখনউতেই। কিন্তু বাবার চাকরি বদলের কারণে আমরা বারবার শহর বদল করে চলেছি। এখন আমরা থাকি সিমলায়। এর আগে ছিলাম এলাহাবাদে। তার আগে দিল্লিতে। তবে যখন যেখানেই থাকি না কেন দেওয়ালি ভাইফোঁটার সময়ে আমি লখনউ আসবই। কারণ মানাকে ফোঁটা দিতে হবে যে। একেবারে ছোট্টবেলা থেকে আমি আমার মানাকে ভাইফোঁটা দিই। মাম পায়েস তৈরি করে দেয়। মা অনেকরকম নোনতা আর মিষ্টি এনে দেয়। আমি প্লেটে সুন্দর করে সাজিয়ে আসন পেতে মানাকে বসাই। চন্দনের ফোঁটা দিই কপালে। ছোটবেলায় ভাইফোঁটার আগের দিন থেকে খুব উত্তেজনা হতো। মানা আমার জন্য গিফ্ট কিনে এনে লুকিয়ে রাখত। মামকে জিজ্ঞেস করলেও বলত না কী গিফ্ট এনেছে মানা। হঠাৎ করে মনের মতো উপহার পেয়ে খুব মজা হতো। এখন তো বড় হয়ে গিয়েছি। তবু ভাইফোঁটায় মানার কাছ থেকে কী গিফ্ট পাবো তা নিয়ে মনের মধ্যে চাপা উত্তেজনা থাকেই। এবার কোভিডের কারণে পুজোর সময় সিমলা থেকে লখনউ আসতে পারিনি। খুব টেনশনে ছিলাম, আদৌ ভাইফোঁটায় আসতে পারব কি না। যাই হোক, থ্যাঙ্ক গড পেরেছি আসতে! এবার আমি মানার জন্য একটা স্পেশাল গিফ্ট এনেছি সিমলা থেকে। কী এনেছি বলছি না, কারণ তোমাদের কাগজ পড়লেই মানা জেনে যাবে যে!
তোমরা কিন্তু ভেবো না যে শুধু বাঙালিদের মধ্যেই এই অনুষ্ঠান হয়। দিল্লিতে দেখেছি, সিমলাতেও দেখছি আমার বন্ধুরা তাদের ভাইকে তিলক পরিয়ে মিষ্টিমুখ করায়। ওরা বলে ‘ভাইদুজ’ আর আমরা বলি ভাইফোঁটা। ওরাও এই দিনটায় ভালোমন্দ খায়, মজা করে। সিমলায় তো ভালো মাছ পাওয়া যায় না, তাই মাম বলেছে এবার ভাইফোঁটায় জম্পেশ মেনু হবে—রুই মাছের কালিয়া, চিংড়ি মাছের মালাইকারি আর পোলাও। মানা আর আমি একসঙ্গে বসে খাব। এখনই জিভে জল আসছে।
এ বছর ভাইফোঁটায় আনন্দ সীমাহীন
আমার নিজের বোন নেই ঠিকই, তবু ছোট থেকেই আমি আমার মাসতুতো দিদি আর ঠাকুরমার কাছ থেকে ভাইফোঁটা নিতাম। তখন আমরা কলকাতায় থাকতাম। তারপর বাবা মায়ের সঙ্গে বেঙ্গালুরু চলে এলাম। আমার ভাইফোঁটাও বন্ধ হয়ে গেল। মনখারাপ করা সেইসব দিন কিন্তু আমি কাটিয়ে উঠেছি। এখন আবারও আমার ভাইফোঁটা উৎসবমুখর। বেঙ্গালুরুতে আমাদের আবাসনেই নতুন দিদি, বোন পাতিয়ে ফেলেছি যে। এখন আমি যাদের কাছে ফোঁটা নিই তারা কেউ আমার চেয়ে সামান্য বড় আর কেউ একটু ছোট। ওদেরও কারও দাদা বা ভাই থাকে না এখানে। তাই আমরাই একে অপরের ভাইবোন হয়ে উঠেছি। আরে ওদের নামগুলোই তো বলা হল না। অস্মিতা দে, সারা রায়চৌধুরী আর তিলোত্তমা চক্রবর্তী— এরাই আমার ভাইফোঁটার সঙ্গী। ভাইফোঁটার দিন ভীষণ আনন্দ হয় আমাদের। সক্কাল সক্কাল কারও একটা বাড়িতে জমায়েত হই আমরা সবাই। সেখানেই ফোঁটার থালা আর মিষ্টি সাজিয়ে ফোঁটার অয়োজন করা হয়। উপহারের মধ্যে চকোলেট প্যাক, চিপস হ্যাম্পার এইসবই থাকে। ভাইফোঁটা নেওয়ার পরেও সারাটা দিনই আমরা একসঙ্গে কাটাই। খেলাধুলো, গান-বাজনা আর গল্পের পরে খাওয়াদাওয়ার আয়োজন। মেনুও হয় নানা রকম। কখনও বিরিয়ানি, কখনও ফ্রায়েড রাইস চিলি চিকেন, কখনও বা ভাত মাংস। এবছর আবার ভাইফোঁটার এই আনন্দে একটা নতুন মজা যুক্ত হয়েছে। আজ সন্ধেবেলা ভার্চুয়ালি জুম অ্যাপে আমার দুই মাসির দুই মেয়ে কুহু আর মোয়ানা আমায় ফোঁটা দেবে। এবছর তাই আনন্দটা যেন সীমাহীন।