সম্পত্তিজনিত মামলা-মোকদ্দমায় সাফল্য প্রাপ্তি। কর্মে দায়িত্ব বৃদ্ধিতে মানসিক চাপবৃদ্ধি। খেলাধূলায় সাফল্যের স্বীকৃতি। শত্রুর মোকাবিলায় সতর্কতার ... বিশদ
ভার্সাই-এর প্রাসাদের সামনে সেদিন তিলধারণের জায়গা নেই। হাজার হাজার মানুষ ছুটে আসছেন প্রাসাদের দিকে। উত্তেজনায় ফুটছে সকলে। ভারী আজব জাদু দেখানো হবে প্রাসাদের সামনে বিশাল ময়দানে। এমন জাদু আগে কোনওদিন হয়নি। এই ম্যাজিক আকাশে ওড়ার ম্যাজিক! একেবারে সামনের সারি থেকে সেই ম্যাজিক দেখার জন্য ভোরবেলাতেই সঙ্গের ব্যাগে শুকনো রুটি নিয়ে পৌঁছে গিয়েছেন কয়েকজন। খুব বেলা হয়ে গেলে খেয়ে নেবেন। এদিকে অপেক্ষা করতে করতে সত্যিই বেলা গড়িয়ে গেল। সেপ্টেম্বরের দুপুর। চড়চড়িয়ে রোদ উঠেছে। লোকজন অস্থির হয়ে উঠতে লাগল। বাচ্চারা এবার খিদের জ্বালায় কাঁদতে শুরু করেছে। তারমধ্যেই দেখা গেল, প্রাসাদের সামনে একটা খোলা জায়গায় দু’জন জাদুকর বিভিন্ন যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজকর্ম করছেন। ভালো করে ঠাওর করতে বোঝা গেল, একটি কুণ্ডে আগুন জ্বালানোর সবরকম জোগাড়যন্ত্র করা হয়েছে। এছাড়া বিশালাকায় কাপড়ের তৈরি থলে শোয়ানো রয়েছে মাটিতে। সেই থলের আকার এক বিরাট শামিয়ানার মতো। আর একটা খাঁচার মধ্যে পোরা রয়েছে একটা মোরগ, একটি হাঁস আর একটা ভেড়া।
ভিড়ের মধ্যে থেকে একজন লোক এবার জাদুকরের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন— ‘ওহে ভদ্র মানুষেরা, তোমাদের নাম কী?’
দু’জন জাদুকরের মধ্যে একজন খুবই সুদর্শন। চওড়া কপাল হলেও তাঁর চুল ছিল কোঁকড়ানো। আর নাক ছিল টিকালো। ঠোঁট ছিল পাতলা। তবে সবচাইতে আকর্ষণীয় ছিল তাঁর চোখ। ওই দুই চোখের দিকে তাকালেই বোঝা যেত, একরাশ স্বপ্ন যেন বাসা বেঁধে রয়েছে সেখানে! জাদুকর আগুন জ্বালাতে জ্বালাতেই চেঁচিয়ে জবাব দিলেন— ‘আমার নাম জোসেফ মন্টগলফিয়ার। সঙ্গে রয়েছে আমার ভাই এটিয়েন মন্টগলফিয়ার।’
দর্শকের মধ্যে থেকে ফের প্রশ্ন এল— ‘তোমরা নাকি আজ আকাশে ওড়ার ম্যাজিক দেখাবে? বলি, সেই জাদু শুরু হবে কখন?’
জোসেফ উত্তর দিলেন— ‘আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করো।’
ফের একজন মজা করল— ‘ম্যাজিক দেখতে এসে আমরা খিদের জ্বালায় মরে না যাই!’ এমন কথায় চারিদিকে হাসির রোল উঠল। মন্টগলফিয়ার ভাইয়েরা অবশ্য তাতে ঘাবড়ে গেলেন না। তাড়াতাড়ি হাতের কাজ সারতে শুরু করলেন। কেননা ইতিমধ্যে প্রাসাদের ভেতর থেকে একজন রাজকর্মচারী এসে খবর দিয়েছে, রাজা ষোড়শ লুই আসছেন তাঁদের জাদু দেখতে।
ম্যাজিক
কুণ্ডে দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে বেশ কয়েকজন লোক মিলে কপিকলের সাহায্যে দু’টি লম্বা দণ্ডের মাথায় প্রকাণ্ড কাপড়ের থলের খোলা মুখটা মেলে ধরল। ক্রমশ ফুলতে শুরু করল থলেটা। এই কাণ্ড দেখে একজন দর্শক বলল— ‘কাপড়ের প্রকাণ্ড থলেটা ফুলেছে ঠিকই, কিন্তু আকাশে উড়বে তো? নইলে রাজা কিন্তু খুব রেগে যাবেন!’
আগের কথা
তোমরা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছ যে সময়ের গল্প করা হচ্ছে তা বহু দিন আগের। প্রশ্ন হল কত আগের? এই গল্প, ১৭৮৩ সালের ১৯ সেপ্টেম্বরের। আজ থেকে দুশো বছরেরও বেশি সময় আগের কথা। রকেট দূরে থাক, সেইসময় বিমানও আবিষ্কার হয়নি। এমনকী আবিষ্কার হয়নি রেলগাড়িও!
তোমাদের নিশ্চয়ই এবার জানতে ইচ্ছে করছে, ভার্সাইয়ের প্রাসাদের সামনে আদৌ কাপড়ের তৈরি বিরাট থলে উড়ল কি না? সেই গল্পে ফিরছি। তবে তার আগে জোসেফ আর এটিয়েন মন্টগলফিয়ার-এর কথা একটু বলে নেওয়া যাক। তোমরা আগেই জানতে পেরেছ, জোসেফ আর এটিয়েন দুই ভাই। ফ্রান্সের অ্যানোনে প্রদেশে ১৭৪০ সালে জন্ম জোসেফের। আর পাঁচ বছর পরে জন্ম হয় এটিয়েন-এর। দুই ভাইয়ের বাবার ছিল কাগজ কল। ওদের বাবা চেয়েছিলেন, বড় হওয়ার পর দুই ভাই যেন ব্যবসার হাল ধরে। তাই জোসেফকে নামী স্কুলে ভর্তি করা হয়। তবে জোসেফ ছিল বাঁধনহারা। তাই স্কুল ছেড়ে, ঘর ছেড়ে, দূরে গিয়ে নিজেই রাসায়নিকের ব্যবসা শুরু করেন। বিভিন্ন গবেষণাধর্মী কাজ জোসেফকে বরাবর টানত। অনেকগুলি মাস অন্য কাজ করার পরে জোসেফ বাবার কাগজ কলে যোগ দেন। তবে খুব একটা উন্নতি করে উঠতে পারেননি। কারখানার ক্ষতি হতে থাকে। কারণ কারখানার কাজের চাইতেও জোসেফের আগ্রহ ছিল নানা ধরনের গবেষণার প্রতি। অন্যদিকে ছোটভাই এটিয়েন ছিল ধীরস্থির। তিনি পরে ব্যবসার হাল ধরে উন্নতি করেন। তবে দুই ভাইয়ের মধ্যে মনের মিল ছিল খুব। ভাবও ছিল দেখার মতো। সাধারণত দাদা জোসেফ যা বলতেন, এটিয়েন তা মেনে চলার চেষ্টা করতেন। প্রকৃতির নানা আশ্চর্য বিষয় নিয়ে জোসেফের আগ্রহ এটিয়েনের ভালো লাগত।
ফায়ারপ্লেস আর জামা
শোনা যায়, একদিন জোসেফ বসেছিলেন একটি ছোট আগুনের কুণ্ডের পাশে। আগুনের কুণ্ডের ওপরে কতকগুলো জামা শুকোতে দেওয়া ছিল। জোসেফ খেয়াল করে দেখলেন, আগুনের তাপে বারবার জামা ফুলে উঠছে আর বাতাসে ভেসে যাওয়ার চেষ্টা করছে! বিষয়টা ভাবিয়ে তুলল জোসেফকে। তাঁর মনে হল আগুন থেকে নিশ্চয়ই কোনও গ্যাস বেরচ্ছে যা জামা উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। জোসেফ এই গ্যাসের নাম দিলেন ‘মন্টগলফিয়ার গ্যাস।’ আর একইসঙ্গে ডেকে পাঠালেন ছোটভাই এটিয়েনকে। এবার দু’জনে মিলে কাগজ দিয়ে একটা বড়সড় কাগজের বাক্স বানালেন আর তার নীচে আগুন দিলেন। দেখা গেল কিছুক্ষণ পর বাক্সটি বাতাসে উড়ে গেল! তাঁরা দুইভাই মিলে ঠিক করলেন, এবার একটা বড়সড় থলে তৈরি করে তার মধ্যে মন্টগলফিয়ার গ্যাস পুরে শহরের লোকের সামনে ওড়াতে হবে। তাঁরা ফোলা থলেকে বেলুন বলে উল্লেখ করলেন।
অতএব কাপড় আর কাগজ দিয়ে তাঁরা তৈরি করে ফেললেন বিরাট আকারের এক বেলুন। তারপর অ্যানোনে শহরের বাজার চত্বর থেকে ১৭৮৩ সালের জুন মাসে উড়িয়ে দিলেন সেই বেলুন। মানুষ অবাক হয়ে দেখল বিরাট এক বেলুন চড়চড় করে উড়ে গেল আকাশের দিকে। জানা যায়, মোটামুটি ছয় হাজার ফুট উচ্চতায় উঠে দশ মিনিট ভেসে থাকে সেই বেলুন। আর পাড়ি দেয় প্রায় দুই কিলোমিটার পথ। লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ে দুই মন্টগলফিয়ার ভাইয়ের নাম। এমনকী কথাটা ফ্রান্সের রাজার কানেও পৌঁছয়। দুই ভাইকে ভার্সাই-এর প্রাসাদে ডেকে পাঠান রাজা।
ভার্সাই-এর প্রাসাদে
রাজার ডাক পাওয়ার পরেই দুই ভাই একটি শক্তপোক্ত বেলুন তৈরির দিকে মন দেন। শক্তপোক্ত কাপড় তাঁরা সংগ্রহ করেন। আর বেলুনে যাতে চট করে আগুন না লাগে তাই কাপড়ের ওপরে দেওয়া হয় অ্যালুম-এর প্রলেপ। বেলুনের গায়ে সোনার জরির নকশা করা হয়।
এরপর নির্দিষ্ট দিনে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস শহরের কেন্দ্র থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে ভার্সাইয়ের প্রাসাদের ডাকা হয় প্রজাদের। ঠিক করা হয় ভার্সাইয়ের প্রাসাদের সামনেই ওড়ানো হবে বেলুন। তাই পরিকল্পনা মতোই আগুনের কুণ্ডের ওপর ধরে রাখা হয় সেই বিরাট কাপড়ের থলের খোলা মুখ! প্রায় ৩০ ফুট ব্যাসের সেই বেলুনের পেট ফুলে উঠতেই তার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হল ভেড়া, মোরগ আর হাঁসকে। আসলে তখনকার দিনে মনে করা হতো, ভেড়া আর মানুষের শরীরে অন্দরের গঠন একইরকম! এছাড়া মাটি থেকে অত উঁচুতে কোনও প্রাণী বেঁচে থাকতে পারে কি না তা দেখাই ছিল উদ্দেশ্য।
রাজা ষোড়শ লুই-এর সঙ্গে প্রায় এক লাখ তিরিশ হাজার লোক সেদিন অবাক হয়ে যায়। সকলে দেখে, তিনটি প্রাণীকে নিয়ে বিরাট আকারের বেলুনটি আকাশে উড়তে শুরু করেছে। এমনকী নিরাপদে মাটিতে নেমে আসার আগে প্রায় আট মিনিট শূন্যে ভেসেও থাকে বেলুনটি। সব দর্শকরা আনন্দে চিৎকার করে ওঠে।
বেলুনে চড়ল মানুষ
জীবন্ত প্রাণী ভেসে থাকার পর এবার পালা ছিল মানুষ উড়তে পারে কি না তা দেখার। ভার্সাইয়ের প্রাসাদ থেকে বেলুন ওড়ানোর দুই মাস পরেই দুইভাই এবার বেলুনের সাহায্যে মানুষকে আকাশে ভাসানোর পরিকল্পনা করেন। পরিকল্পনা মতো, ওই বছরই ২১ নভেম্বর এক রসায়ন ও পদার্থবিদ্যার শিক্ষক এবং একজন মিলিটারি অফিসার মন্টগলফিয়ার বেলুনে চড়ে বসেন। ২৫ মিনিটে প্রায় ৯ কিলোমিটার উড়েও যান তাঁরা।
বেলুনের উন্নতি
সেই সময় মন্টগলফিয়ার ভাইয়েরা মনে করেছিলেন তাঁরা সম্পূর্ণ নতুন একধরনের গ্যাসের আবিষ্কার করে ফেলেছেন। অথচ সত্যিটা হল ওই গ্যাস আসলে ছিল গরম বাতাস। বাতাস উষ্ণ হলে তা হালকা হয়ে যায়। তাই বেলুনের মধ্যে গরম বাতাস ঢুকলেই বেলুন ওপরে উঠতে থাকে। কারণ তখন আশপাশের বাতাস থাকে ভারী। মন্টগলফিয়ার ভাইয়েরা বেলুন আবিষ্কার করলেও পরে বেলুনের আরও উন্নতি ঘটতে থাকে। এমনকী তৈরি হয় হাইড্রোজেন গ্যাসের বেলুন। বেলুনের সাহায্যে একসঙ্গে অনেক যাত্রী নিয়ে যাওয়ার চেষ্টাও করা হয়। অবশ্য সেই চেষ্টা খুব একটা সফল হয়নি। আজকাল নানা বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের জন্য বেলুনের ব্যবহার করা হয়। তবে সেই সময় মন্টগলফিয়ারদের তৈরি বেলুন অবশ্যই যুগান্তকারী আবিষ্কার ছিল। কারণ মানুষের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ছিল পাখির মতো আকাশে ওড়ার। সেই স্বপ্ন সত্যি করে দিয়েছিল দুই ভাইয়ের কৌতূহলী মন।