পারিবারিক সম্পত্তি সংক্রান্ত আইনি কর্মে ব্যস্ততা। ব্যবসা সম্প্রসারণে অতিরিক্ত অর্থ বিনিয়োগের পরিকল্পনা। ... বিশদ
সামনেই উল্টো রথ। মাসির বাড়ি ভ্রমণ শেষে আপন গৃহে ফিরবেন জগন্নাথদেব। কিন্তু তার আগে শ্রীক্ষেত্রে তাঁর রথযাত্রা দেখার সুযোগ মিলেছিল এবছর। রথের দিন পুরী পৌঁছে দেখি উপচে পড়া ভক্তের ভিড়। আকুল হৃদয়ে প্রভুর দর্শনের আকুতি ভক্তদের মধ্যে। অগুনতি মাথার সমারোহ গ্র্যান্ড রোড ধরে। আকাশ বাতাস জুড়ে খোল করতালের সুর আর তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে শ্রীজগন্নাথ দেবের জয়ধ্বনি। আপামর জনগণ যেন প্রভুর চরণে নিজেকে উৎসর্গ করে দিতে এসেছে এই শ্রীক্ষেত্রে। ভিড়ের মাঝে মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে রথের পথে নতমস্তকে ভূমি ছুঁয়ে প্রভুর আশীর্বাদ পাওয়ার চেষ্টা। পায়ে পায়ে যত এগিয়ে চলি ততই নতুন অভিজ্ঞতা জমা হয় ঝুলিতে।
রথের পুরী। প্রতি বছর একই উৎসাহে প্রভু জগন্নাথদেবের টানে ভক্তের ঢল নামে শ্রীক্ষেত্রে। বাস, ট্রেন, প্লেন সবেতে ঠাঁই নাই অবস্থা! সব পথ যেন এসে মেশে এই শ্রীক্ষেত্রে। উৎসাহ উদ্দীপনার কোনও খামতি নেই। ‘জয় জগন্নাথ’ ধ্বনিতে মুখর হয়ে এগিয়ে চলেছে জনস্রোত।
ভুবনেশ্বর থেকে পুরী ঢোকার প্রায় ১০ কিমি আগে থেকে টের পাওয়া গিয়েছিল কী হতে যাচ্ছে শ্রীক্ষেত্রে। রাস্তায় রাস্তায় প্রশাসনের কড়া পাহাড়া আর ব্যারিকেড। গাড়ির নো এন্ট্রি। রথযাত্রায় সাধারণ মানুষের পাশাপাশি ভিভিআইপি-দের আনাগোনা থাকেই। এবছর রাষ্ট্রপতিও অতিথিবর্গের আসনে। কড়াকড়ি তো হবেই। নদীর মতো গ্র্যান্ড রোডে গিয়ে মিশেছে ছোট বড় সব পথ। প্রতিটিই পদযাত্রীদের দখলে।
সকালে বিচ রোড ধরে কিছুটা যেতেই চৈতন্যদেবের দু’বাহু তোলা অতি চেনা মূর্তি, স্বর্গদ্বারের জমজমাট এলাকা। এই সকালেই সমুদ্র তীর তার নিজস্ব ছন্দে উৎসবের আনন্দে মেতেছে। ঢেউয়ের অবিরাম যাওয়া আসা। নীরবে সব প্রত্যক্ষ করে ফেনিল সাগর। সমুদ্রবিলাসীরা সকাল থেকেই ঢেউ সাগরে মেতে উঠেছে। বাঙালির অতি পরিচিত সমুদ্রতট। দোকানপাট, চা, উট, ঘোড়া কোনও কিছুরই খামতি নেই। রথ থেকে উল্টোরথে সংযোজন শুধু কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর স্টল।
সমুদ্রতট ছেড়ে আবার পথে। প্রভুর টানে অদ্ভুত শক্তি সঞ্চারিত হয় মনে। সক্ষম, অক্ষম সকলেই প্রভুর জয়ধ্বনি দিতে দিতে এগিয়ে চলে। ভক্তদের জন্য পথের দু’পাশে জল, বিস্কুট, শরবত বিতরণের পাশাপাশি ভাণ্ডারাও আছে। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা মানুষ ভিড় জমাচ্ছে সেখানে। প্রবল গরমে বাড়ির জানলা, বারান্দা, ছাদ থেকে পিচকিরি দিয়ে স্প্রে করা হচ্ছে ঠান্ডা জল। বিভিন্ন কোম্পানি বিলচ্ছে টুপি, হাতপাখা, আরও কত কী। পুরীর বিখ্যাত খাজার অগুনতি ডালা নিয়ে বসেছে এই সময়ের দোকানিরা। ঘিয়ের প্রদীপ থেকে হাজার কিসিমের দোকান।
জনসমুদ্রে মিশে হাঁটতে হাঁটতে দেখতে লাগলাম দু’চোখ ভরে। গরম ও আর্দ্রতাকে কাবু করতে সরকারি ব্যবস্থাপনায় জল স্প্রে করা হচ্ছে গাড়ি থেকে। আপাদমস্তক ভিজে সেই মজাও নিচ্ছে কেউ কেউ। বিশাল চওড়া রাস্তায় শুধু মাথা আর মাথা। দূরে চকচক করছে রথের চূড়া। এবারের রথযাত্রা একটু অন্য রকমের। প্রায় ৫৩ বছর পরে আবার তিথির পুনরাবৃত্তি এবছর। আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়ার সময় অনুযায়ী এবার রথ দু’দিনের (৭ ও ৮ জুলাই)। সেই হিসেব মতোই রথ মাঝপথে থেমে পরেরদিন পৌঁছায় গুন্ডিচায় মাসির বাড়ি। স্বাভাবিকভাবেই ভক্তরা দু’দিন রথ টানার সুযোগ পেয়েছেন। তবু অভিজ্ঞদের মুখে চিন্তার ছাপ দেখে একটু অবাক হয়েই প্রশ্ন করলাম একজন দর্শনার্থীকে, ‘দু’দিনের রথযাত্রা তো ভালো কথা, তাই না?’ তিনি বললেন, ‘ভালো তো বটেই, প্রভু শেষ পর্যন্ত সকলের ইচ্ছে পূরণ করলে সবই ভালো।’ ফিরে এসে কাগজে বলভদ্রের রথ থেকে পতনের খবর পড়ে সেই অভিজ্ঞ দর্শনার্থীটির মুখই ভেসে উঠল চোখের সামনে।
এবছর একইসঙ্গে অনুষ্ঠিত হয় ‘নেত্রদান উৎসব’ ও ‘নব যৌবন দর্শন’। পৌরাণিক কাহিনি অনুযায়ী স্নানযাত্রায় প্রভুকে সেবায়েতরা মাত্রারিক্ত স্নান করানোর কারণে অসুস্থ হয়ে পড়েন ভগবান। পনেরো দিন পরে তার নেত্রদান করে নব রূপে জগন্নাথকে দর্শন করা হয়। এই পর্বের পর রথে আসীন হন তিনি।
এই রথযাত্রা ভক্তি, আবেগ, উৎসবের এক আশ্চর্য মিলনক্ষেত্র। ভিড়ে মিশে গেলে সেই আবেগ ঘোর নাস্তিককেও ভক্তিরসে জারিত করতে পারে। শুধু রথযাত্রার দিন নয় এই আবেগ, উৎসাহ, উদ্দীপনা গুন্ডিচা থেকে মন্দিরে ফেরা পর্যন্ত তো চলেই। আমেজ থেকে যায় তারও বেশি। পরের দিন গ্র্যান্ড রোডে চোখে পড়ে ভিড়ের নানান স্মৃতি চিহ্ন। অসংখ্য চটি জুতো, মাথার ক্লিপ, হেয়ার ব্যান্ড থেকে আরও কত কী। রথের কাছে ভিড়টা আজও কোনও অংশে কম নয়। দর্শন, প্রার্থনা, প্রাপ্তি নিয়ে তৃপ্ত ভক্তগণ। জগন্নাথের রথ ‘নান্দীঘোষ’ থেকে মাঝে মাঝে বিতরণ করা হচ্ছে তুলসী, ময়ূর পালক, কলা, কাঁঠাল কোয়া ইত্যাদি। ভাগ্যবান ভক্ত এই প্রাপ্তিতেই মহাখুশি।
গ্র্যান্ড রোড জুড়ে কর্পোরেট স্টল প্রচুর। সেইরকমই একটি সংস্থা, আইটিসি আশীর্বাদ আটা ও নুন-এর আমন্ত্রণে এবার রথ দেখার সুযোগ হয়েছিল আমার। ওড়িশার পটচিত্রের আদলে সাজানো হয়েছে রথযাত্রার গল্পকথা। শুধু তাই নয় দ্বিমাত্রিক অ্যানিমেশনে দেখানো হচ্ছে রথের পৌরাণিক গাথা। গল্পের শেষে বেরিয়ে আসছে একটা রথ। আগত দর্শক, ভক্তরা সুযোগ পাচ্ছেন সেই রথ টানার ও ভগবান দর্শন করার। আরও অনেক স্টল রয়েছে। সেখানেও ভক্তদের জন্য সাজানো আছে নানা অফার। ঘড়ির কাঁটা রাতের দিকে এগিয়ে গেলে ফিরতে হয় আমাকে। ফেরার সময়ও দেখি দর্শনার্থীদের উৎসাহে ভাটা পড়েনি। মনে মনে বলি প্রভু তোমার এমনই কৃপা যেন সকলে পায়। ‘জগন্নাথস্বামী, নয়ন পথগামী, ভবতূ মে’।