পারিবারিক সম্পত্তি সংক্রান্ত আইনি কর্মে ব্যস্ততা। ব্যবসা সম্প্রসারণে অতিরিক্ত অর্থ বিনিয়োগের পরিকল্পনা। ... বিশদ
ভোরের আলো ফুটতে তখনও বেশ দেরি। কল টাইম পাঁচটা। সাড়ে চারটেয় হোটেলের রিশেপশন থেকে অ্যালার্ম কলে নক করে দিয়েছে। ফেব্রুয়ারি, তাই ঠান্ডা ভালোই। আদ্যোপান্ত মুড়িয়ে হোটেলের রিসেপশনে যখন নামলাম আকাশে তারা জ্বলজ্বল করছে। আমার মতোই বাকিরাও হাজির। দূর থেকে ক্রমাগত শেয়ালের ডাক ভেসে আসছে। কনকনে ঠান্ডা হাওয়া শীতের তীব্রতা বুঝিয়ে দেয়। সকল অপেক্ষারত টেম্পো ট্রাভেলারে ওঠার পর তা অন্ধকার ভেদ করে ছুটে চলল পান্না জাতীয় উদ্যানের উদ্দেশ্যে। চারপাশে বিন্দু বিন্দু আলো দ্রুত পিছনে চলে যাচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ চলার পরে পাহাড়ি রাস্তার হেয়ারপিন বাঁক ঘুরতে থাকে ডাইনে বাঁয়ে। গাড়ির হেড লাইট জঙ্গলের চাপ চাপ অন্ধকার চিরে এগিয়ে যাচ্ছে। ভোরের আলো অন্ধকারকে সরিয়ে যখন তার উপস্থিতি জানান দিল তখন আমরা বন দপ্তরের অফিসের সামনে। পরিচয় পত্র দেখিয়ে প্রয়োজনীয় অনুমতি নিতে একটু সময় লাগল। তারপর আবার গাড়িতে উঠে পৌঁছে গেলাম আকোলা। জঙ্গলে প্রবেশের যে পথগুলি আছে তার মধ্যে বাফার জোনে আকোলা, হারসা ও খাজুরখুদা। আর কোর জোনে মান্ডালা ও হিনাউটা। আকোলা গেটের বিপরীতে বন দপ্তরের অফিস। জিপসি ও গাইড এখান থেকেই নিতে হবে। খাজুরাহো থেকে আকোলা প্রায় ৩৫ কিলোমিটার। গাইড, গাড়ি সব একত্রিত হয়ে জঙ্গলে প্রবেশ করতে প্রায় ৭টা বেজে গেল। জঙ্গল প্রবেশের টিকিট দেওয়া হয় সকালে ৬টা থেকে ৭টা ও দুপুরে আড়াইটে থেকে সাড়ে তিনটে। গেটে প্রবেশ করতে হবে সকালে সাড়ে ছ’টা থেকে সাড়ে সাতটার মধ্যে। আর দুপুরে ৩টে থেকে সাড়ে তিনটের মধ্যে। সকালে ১১টা পর্যন্ত ও বিকালে সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত জঙ্গলে সাফারির সময়। প্রসঙ্গক্রমে জানিয়ে দেওয়া ভালো জঙ্গলে সাফারির প্রবেশ মূল্য: শনি, রবি ও ছুটির দিন ছাড়া ১ থেকে ৬ জনের জন্য জিপসির ভাড়া ২৫০০ টাকা। প্রবেশমূল্য ২৪৫০ টাকা। গাইড ফি ৪৮০ টাকা। শনি, রবি ও ছুটির দিন বাকি ভাড়া এক থাকলেও প্রবেশমূল্য বেড়ে হয় ৩০৫০ টাকা।
একরাশ রোমাঞ্চ নিয়ে শীতের নরম রোদ গায়ে মেখে ঢুকে পড়লাম জঙ্গলে। জঙ্গল যেন প্রাণহীন। সবুজের রং কেমন ফ্যাকাসে। হলদেটে রঙের প্রাধান্য বেশি। শুকনো ডালপালা, ঝোপঝাড় আকাশের দিকে হাত তুলে আছে। ঝোপঝাড়ের কেশ সজ্জায় লালচে আভা। সেই লালচে ধুলো উড়িয়ে জিপসি চলল জঙ্গলের গভীরে। তার সঙ্গে আমাদের সন্ধানী চোখ। হিসাব বলছে পান্না জাতীয় উদ্যানের মোট এলাকা ১৬৪৫ বর্গ কিমি। তার মধ্যে বাফার জোন ১০০২.৪২ বর্গ কিমি ও কোর জোন ৫৪২.৬৬ কিমি। ১৯৮১ সালে এই জঙ্গল জাতীয় উদ্যানের মর্যাদা পেলেও ১৯৯৪ সালে টাইগার রিজার্ভ ঘোষণা করা হয়। মধ্যপ্রদেশের পঞ্চম ব্যাঘ্র প্রকল্প। কিন্তু দুঃখজনক ভাবে ২০০৯ সালে পান্নার জঙ্গল শিকারিদের কুনজরে সরিস্কার মতো বাঘহীন হয়ে যায়। তারপর সরকারি প্রচেষ্টা ও বন দপ্তরের চেষ্টায় আবার বাঘেদের সংসার পাতার প্রচেষ্টা পান্নায়। শাল, মহুয়া সহ কত রকমের গাছ জঙ্গল জুড়ে। কেন নদী দক্ষিণ থেকে উত্তরে প্রবাহিত হয়েছে জঙ্গলে। যমুনার শাখা নদী কেন এই অঞ্চল দিয়ে বিভিন্ন রূপে প্রবাহিত হয়েছে। কোথাও গভীর খাদের মধ্যে দিয়ে তো কোথাও জঙ্গলের ল্যান্ডস্কেপকে আকর্ষণীয় করে। এই নদীতে আছে ঘড়িয়াল স্যাংচুয়ারি। কুমিরের দেখাও মেলে। প্রায় শুষ্ক জঙ্গলে বাঘ ছাড়াও নীলগাই, বুনো শুয়োর, হরিণ, ভল্লুক, শিয়াল, লেপার্ড, সম্বর প্রভৃতি প্রাণীর দেখা পাওয়া যায়। এছাড়া প্রায় দুশো ধরনের পাখির স্থায়ী ঠিকানা পান্না।
গাইডের দেওয়া তথ্য শুনতে শুনতে ব্রেক কষল জিতেন। চোখের ইশারায় দেখায় নীলগাইকে। কুড়ি বছর ধরে জঙ্গলে সাফারির গাড়ি চালাচ্ছে। অভিজ্ঞতার ঝুলি তার ভরা। চোখ কান তার সতর্ক। আবার কিছুটা গিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। অ্যালার্ম কল কানে এসেছে। কোন দিক দিয়ে শব্দটা আসছে বুঝে নিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে ঢুকে যায় জঙ্গুলে পথে। একটা হরিণের দল দৌড়ে এদিক থেকে ওদিক চলে যায়। তরুণ গাইড চোখে বাইনোকুলার লাগিয়ে দেখতে থাকে। রুদ্ধশ্বাস উৎসাহ নিয়ে সবার সন্ধানী চোখ ঝোপের দিকে। অ্যালার্ম কল অর্থাৎ বাঘ আশপাশেই রয়েছে কোথাও। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষার পরেও যখন তার দেখা পেলাম না, তখন ব্যর্থ মনোরথ হয়ে আবারও অন্য পথে। জঙ্গলের মধ্যে বেশ কিছু গ্রামের দেখা পেলাম। গাইড বলে গোন্ড উপজাতিরা এই গ্রামের বাসিন্দা। ১৯৭২ সালের বন্যপ্রাণী রক্ষার নিয়ম অনুযায়ী কোর ও বাফার জোনে কোনও গ্রাম থাকবে না। কিন্তু জঙ্গলের এই ভূমিপুত্রদের জঙ্গল ছেড়ে বেরিয়ে আসাও কঠিন। লড়াই আজও জারি থাকলেও গোন্ডরা বন্য প্রাণের সঙ্গে থাকতেই স্বছন্দ। চাষবাসই জীবিকা। গ্রাম, সবুজ খেত ফেলে রেখে আরও গভীরে গিয়ে পৌঁছলাম। গাইড নামার অনুমতি দিলেন। ভিউপয়েন্ট। সামনে খাড়াই খাদ নেমে গিয়েছে। নীচে বিশাল হ্রদ। তারপর শুকনো মাটির পাহাড়। গাইড বলে পান্না ডায়মন্ড মাইনস। ফুরফুর করে ঠান্ডা হাওয়া বইছে। সেই হাওয়া জঙ্গলে শুকনো পাতার সঙ্গে যেন খেলায় মাতে। দমকা এসে দৌড় করায় শুকনো পাতাদের। নিঃশব্দতার জাল ছিঁড়ে মায়াবী শব্দ মিলিয়ে যায় জঙ্গলের গভীরে। দিনের শুরুতে পাখিদের কলকাকলি যতটা শোনা যাচ্ছিল এখন অনেকটাই কম। রোদের তীব্রতা বেড়েছে। ভিউপয়েন্টে কিছুটা সময় কাটিয়ে ফেরার পালা। ফিরতি পথে একদল বুনো শুয়োরকে দেখা গেল। রাস্তার এক পাশ থেকে দৌড়ে অন্য পাশে চলে গেল। মুহূর্তে শাটারের শব্দ। তারপর সব নিশ্চুপ। বুনো গন্ধ গায়ে মেখে জঙ্গলের ঘোর নিয়ে উঠলাম হোটেলে ফেরার গাড়িতে।