পারিবারিক সম্পত্তি সংক্রান্ত আইনি কর্মে ব্যস্ততা। ব্যবসা সম্প্রসারণে অতিরিক্ত অর্থ বিনিয়োগের পরিকল্পনা। ... বিশদ
দাক্ষিণাত্যের কেরলকে বলা হয় ‘ঈশ্বরের আপন দেশ’। খাল-খাঁড়ি-হ্রদের জালিকাকার বিস্তৃতি, নারকেলকুঞ্জ শোভিত বেলাভূমির অদ্বিতীয় কোলাজ নিয়েই ‘গডস্ ওন কান্ট্রি’ নামে পরিচিত কেরল। মালয়ালম শব্দ ‘কেরা’ মানে ‘নারকেল’ আর ‘লাম’ মানে হল ‘দেশ’। অর্থাৎ নারকেলের আধিক্য থাকায় কেরলকে বলা যেতে পারে ‘নারকেলের দেশ’। উত্তর-দক্ষিণে মালাবার উপকূলে লম্বালম্বি বিস্তৃত এই রাজ্য। পুরাণ মতে, দেবতা পরশুরাম ও তাঁর শিষ্য তথা নাম্বুদ্রিপাদ ব্রাহ্মণদের বসবাস করার জন্য উপযুক্ত স্থান খুঁজছিলেন। তখন স্বর্গসদৃশ বাসভূমির সন্ধান করতে সহ্যাদ্রি পর্বতের উপর থেকে পরশুরাম তাঁর হাতের কুঠারটি সমুদ্রে নিক্ষেপ করেন। তখনই সেই কুঠারের আঘাতে সমুদ্র সরে গিয়ে সৃষ্টি হয় মালাবার উপত্যকার।
কেরলের বেশ কিছু অঞ্চল শুধুই জলনির্ভর। অনেকখানি অংশে আরবসাগরের লোনাজল ঢুকে তৈরি হয়েছে খাঁড়ি। কোথাও খাঁড়ি-নদী-হ্রদের ত্রিবেণী সঙ্গম। এই বিখ্যাত খাঁড়িপথে ততোধিক বিখ্যাত ‘হাউসবোটে’ ঘুরে বেড়ানো ও রাত্রিবাস যেন সব পর্যটকেরই স্বপ্ন।
মালাবার উপকূল সফরে যাব। বহুল শোনা, প্রচুর ছবিতে দেখা কেরলের ব্যাকওয়াটারে ভেসে বেড়ানোর সুপ্ত ইচ্ছে তো ছিলই। অনলাইনে গাড়ি-হোটেল-হাউসবোট সব বন্দোবস্ত করা ছিল। সাগরবাহিত খাঁড়ির ধার ঘেঁষে ঘরদুয়ার, গাছগাছালি, জনপদ। এই এলাকাগুলির রোজনামচায় যানবাহন বলতে শুধুই নৌকা। এমনতর জীবনেই তারা অভ্যস্ত। জলপথেই তারা স্কুল-কলেজ-বাজারহাট-অফিস-চিকিৎসালয়-পণ্য আদানপ্রদান ইত্যাদি যাবতীয় কাজকর্ম করে থাকে। প্রায় প্রতিটি পরিবারেই রয়েছে নিজস্ব নৌকা। এই জলনির্ভর জীবিকা সামলান স্থানীয়রা। কেরলের প্রায় ৯০০ কিলোমিটার খাঁড়িপথ ঘিরে সে এক অন্য জগৎ। প্রতিদিনের একমাত্র যানবাহন বলতে এই নৌকা। মালয়ালম ভাষায় এই নৌকাগুলিকে বলা হয় ‘কেট্টুভালম’।
সরকারি সাহায্যে এই কেট্টুভালমকেই সামান্য অদলবদল করে হাউসবোটের আদল দিয়ে পর্যটকদের সফরের আয়োজন করা হয়। বহু বেসরকারি সংস্থাও হাউসবোট প্রকল্পে শামিল হতে থাকে। কেরল পর্যটন উন্নয়ন নিগম (কেটিডিসি) বিভিন্ন হাউসবোট প্যাকেজ ট্যুর রেখেছে। নানা মানের ও দামের হাউসবোট রয়েছে। বাইরে থেকে দেখতেও ময়ূরপঙ্খী নাওয়ের মতো। আর ভিতরটা চমক লাগানো। ঘরগুলি বিলাসবহুল শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। ফুল হাউসবোট মানে সেখানে থাকে দুইখানি দুই শয্যার ঘর, খাবার ঘর তথা বসার বিলাসবহুল একটি ঘর। লাগোয়া রান্নাঘর। সেখানে পাচক মালয়ালম রান্না অথবা সফরকারীর নিজস্ব ফরমায়েশ মতো রান্না করে দেবেন। সাধারণ মানের হাউসবোটও রয়েছে। দামেও সেগুলি সস্তা। প্রতিটিতেই রয়েছে কাচের জানলা ও শৌখিন পর্দা টাঙানো শয়নকক্ষ, লাগোয়া স্নানাগার। বিশাল এই হাউসবোটগুলি সারাদিন নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় ঘোরাফেরা করে রাতে স্থলের ধার ঘেঁষে নোঙর করে।
কেরলের কোট্টায়াম শহরকে বলা হয়, ‘দ্য ল্যান্ড অব লেটার, লেকস অ্যান্ড ল্যাটেক্স’। কোট্টায়াম মূলত এক প্রশাসনিক শহর। ব্রিটিশ জমানায় স্থানটিকে ‘কোট্টিম’ বা ‘কোট্টিয়িম’ বলা হতো। লোকমুখে তা-ই হয়েছে কোট্টায়াম। এটিকে ‘অক্ষরা নগরী’ বলা হয়। কোট্টায়াম দোকানপাট-যানবাহন-হোটেল-রেস্তরাঁ নিয়ে ব্যস্ত জনপদ। কেরলের কাভানা নদী ও ভেম্বানাদ হ্রদের কোলে কোট্টায়াম। পুবে সবুজে ছাওয়া পশ্চিমঘাট পর্বতমালা আর পশ্চিমে নীল জলের ভেম্বানাদ খাঁড়ি। বৃষ্টির আধিক্য থাকায় চিরহরিৎ অরণ্যবেষ্টিত বাণিজ্যিক শহরটিতে চা-কফি-কোকো-গোলমরিচ-এলাচ ও রবারের চাষ হয়। রবার উৎপাদনের বিশেষ প্রশস্তি আছে। স্থানীয় ‘কোট্টায়াম ট্যাক্সি’ সংস্থা থেকে গাড়িভাড়া করে সারাদিনের সফরে ঘুরে নেওয়া যায় কাছে-দূরের দ্রষ্টব্যস্থল। আজ অবশ্য শুধুই জলকথা, নৌকাবিহারের গল্প।
কোট্টায়ামে নদী, হ্রদ, খাঁড়ি আছে। পাহাড়টিলাও আছে। আছে সম্ভ্রম জাগানো প্রকৃতি। ভেম্বানাদ হ্রদ থেকে জলবিভাজিকা পথ গেছে আলপুঝাহ্ বা আলেপ্পি ও কুমারাকোম। ভেম্বানাদ হ্রদের জলে নৌকা সফরে চলে যাওয়া যায় পাথিরামানাল দ্বীপ। একে বলা হয় ‘মধ্যরাতের দ্বীপ’। নির্জন দ্বীপটিতে রয়েছে ছোট মাঝারি জলাধার। চাষ হচ্ছে নানা ভেষজ উদ্ভিদের। এই হ্রদে রয়েছে আরও কয়েকটি দ্বীপ। পেরুম্বলম ও পল্লিপুরম। অন্যদিকে ভাইপিন, মুল্লাভুকাদ, ভাল্লারপদম, উইলিংডন ইত্যাদি দ্বীপ সবই কোচি হ্রদের এখতিয়ারে। কোচি বন্দরটাই উইলিংডন ও ভাল্লারপদম দ্বীপ নিয়ে।
মেঘ কুয়াশার এক মায়াময় ভ্রমণ মৌতাতে মেতে আছি। বেশিরভাগ পর্যটকই কোট্টায়ামের হোটেলে রাত্রিবাস করে কুমারাকোম বেড়াতে যান। কোট্টায়ামে পর্যটকপ্রিয় ভেম্বানাদ হ্রদ। হ্রদের জলে ভেসে বেড়াচ্ছে বেশ কিছু অতিকায় ‘কেট্টুভলাম’ বা হাউসবোট। হ্রদ সংলগ্ন জেটি থেকে বিভিন্ন খাঁড়িপথে জলবিহারের ব্যবস্থা আছে। বিনোদনবিলাসী ভ্রমণার্থীদের অনেকেই আবার ভেম্বানাদ হ্রদেই নৌকাবিহার করছেন। আমরাও স্পিডবোটে হইহই করে জলক্রীড়ায় আনন্দময় অভিজ্ঞতার শরিক হলাম। সে এক অদ্ভুত আনন্দ। বেড়াতে এসে মাঝেমাঝে নিজেকে প্রকৃতির কাছে স্রেফ উপুড় করে দিতে হয়।
হ্রদ ও শহরের অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব কোট্টায়ামের প্রতিটি কোণায়। কেরলের এই ভেম্বানাদ কয়্যাল বা ভেম্বানাদ কোল ভারতের একটি দীর্ঘতম হ্রদ। হ্রদ আর পর্বত অঞ্চলের মধ্যে যেন চ্যাপ্টা হয়ে আছে কোট্টাভালম হ্রদ-শহরটি। হ্রদের ধারে অগুনতি রিসর্ট ও হ্রদের জলে শতাধিক কেট্টুভালাম ভেসে রয়েছে। হ্রদের জল ছলাৎছল করছে কেট্টুভালামের গায়ে। অল্পচেনা এই শহরেই একদিনের অবসরের ঠেক। এখানেই রাত্রিবাস। একে তো মালাবার উপকূলের এই চমৎকার হ্রদশহরে আসা, তারপর থাকাও হবে একেবারে হ্রদের কিনারায়। আর কী চাই! হ্রদমুখী ঘর। বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অনেকটা সময় হ্রদের পাড়ে বসে ও নৌকাবিহারে যথেচ্ছ মজা করে কেটেছে। হোটেলে ফিরে কফির কাপে আয়েসি চুমুক দিতে দিতে হ্রদের মুখোমুখি ব্যালকনিতে চেয়ার পেতে অনেকক্ষণ বসে থাকি। রাতের মায়াজড়ানো নির্জনতা জোটে ভেম্বানাদের জলবাসরে। বিস্তারিত ছড়িয়ে যাওয়া সে নির্জনতা ভারি মোহময়।
যাওয়া-আসা: কলকাতা থেকে রেলপথ বা উড়ানপথে ত্রিবান্দ্রম। সেখান থেকে ১৪৫ কিলোমিটার দূরত্বে রেল বা সড়কপথে কোট্টায়াম।
থাকা-খাওয়া: কোট্টায়াম শহর জুড়ে রয়েছে প্রচুর হোটেল, রিসর্ট। আর হাউসবোট তো রয়েছেই। এখানকার দক্ষিণ ভারতীয় খাবারের স্বাদ কিন্তু অন্যান্য জায়গার তুলনায় আলাদা। ফলে চাখতে ভুলবেন না।