আঠারোশো উননব্বই সালের বিশে এপ্রিল অস্ট্রিয়ার ব্রাউনাউ শহরে জন্ম হয় হিটলারের। পুরো নাম অ্যাডল্ফ হিটলার। উনিশশো পঁয়তাল্লিশ সালের তিরিশে এপ্রিল জার্মানির বার্লিন শহরে মাত্র ছাপ্পান্ন বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়। সারা পৃথিবী যাঁকে চেনে একনায়কতন্ত্রের জনক হিসেবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে তাঁর মৃত্যুর পরই কি এই প্রথা অর্থাৎ একনায়কতন্ত্রের অবসান ঘটল? না, একদমই ঘটল না। বরং সেই দেখানো পথ ধরেই নানা রঙে, নানা চেহারায় বহু রাষ্ট্রেই একনায়কতন্ত্রের কৌশলী কিংবা ছদ্মবেশী দখলদারি চলছে আজও। আর একদমই সেই প্রেক্ষাপটে হযবরল নাট্যগোষ্ঠীর নবতম প্রযোজনা চন্দন সেনের নাটক ‘একনায়কের শেষ রাত’। জনজাতির চেনা ভূগোলের বাইরের একটি রাষ্ট্র ব্লু-ল্যান্ড। সেই দেশের একনায়ক বানহিটা মুসিয়ানা। সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে দেশের প্রেসিডেন্টকে বন্দি করে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতায় নিজেকে বসিয়েছে সে। কিন্তু কতদিন সহ্য করবে এই অত্যাচার দেশের জনগণ? কালের নিয়মে সে আজ বন্দি পিপলস ফ্রন্টের পার্টি ওয়ার্কারদের হাতে। কাল সকালে তাকে মরতে হবে। শুধু বানহিটা একা নয়, তার সঙ্গে গুলি করা হবে তার শয্যাসঙ্গিনী ফ্রিডাকেও। ফ্রিডা আরণ্যক পরিবেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে জীবনের শেষ রাতে ব্যাকুল ভালোবাসায় মিলিত হতে চায় তার শয্যাসঙ্গী একনায়কের সঙ্গে। বানহিটা প্রথমবার ফ্রিডার কাছে মার্জনা চায় এবং বলে ওঠে সে যেমন কবিতা, গান বা ছবি আঁকায় অক্ষম তেমনি সে বহু নারীকে ভোগ্য হিসেবে ব্যবহার করলেও ভালোবাসতে অক্ষম। কেমন করে ভালোবাসতে হয় সে জানে না। ভোরবেলা উদ্ধত অবহেলা নিয়ে সঙ্গিনীকে সঙ্গে নিয়ে জয়োল্লাসী মানুষদের রাইফেলের সামনে দাঁড়ায়। নির্বিচারে গুলি চালায় উল্লসিত জনতা। মৃত্যু হয় বানহিটা এবং তার শয্যাসঙ্গিনী ফ্রিডার। এভাবেই একটি রাতের গল্প দিয়ে একজন একনায়কের জীবন এবং রাষ্ট্রের অবস্থাকে বাঁধতে চেয়েছেন নাট্যকার চন্দন সেন তাঁর ‘একনায়কের শেষ রাত’ নাটকে।
কিন্তু এ তো শুধুমাত্র নাটকের উপরিতল। নাটকের গভীরে রয়েছে সেই বার্তা যা যুগে যুগে দেশে দেশে সাধারণ মানুষকে সাহায্য করেছে একনায়কতন্ত্র, ফ্যাসিবাদের লক্ষণগুলোকে চিনে নিতে। আমাদের চারপাশেও কি সেই ছায়া ঘোরাঘুরি করছে না? ধর্ম, সম্প্রদায়কে হাতিয়ার করে জাঁকিয়ে বসার চেষ্ট করছে না ফ্যাসিবাদ? গণতন্ত্রের নামে যে শক্তি একনায়ককে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করে তারাও যে ভবিষ্যতে সেই একই পথের পথিক হবে না তাও কি নিশ্চিত করে বলা যায়?
বাংলার নাটকপ্রেমী দর্শক এর আগে বহুবার বেশ কিছু সফল নাটক উপহার পেয়েছেন নাট্যকার চন্দন সেনের কাছ থেকে। আরও একবার একটি ভালো নাটকের সাক্ষী থাকল বাংলার দর্শক। নাটকটি নির্দেশনার ক্ষেত্রেও মুনশিয়ানার ছাপ রেখেছেন নির্দেশক চন্দন সেন। বানহিটা মুসিয়ানার চরিত্রে দেবশঙ্কর হালদারের অভিনয় নিয়ে কিছু বলতে যাওয়াটা বাহুল্য। বলতে গেলে এ যাবৎ বিভিন্ন মুদ্রণ মাধ্যমে যা বলা হয়েছে তারই পুনরাবৃত্তি করতে হয়। তাই সেই চেষ্টা না করে নাটকের অন্য বিভাগগুলি সম্পর্কে বলা যাক। এ নাটকের মঞ্চ ভাবনায় হিরণ মিত্র। ওঁর কাজের গুণগত মান প্রশংসনীয়। অত্যন্ত উন্নতমানের আবহসঙ্গীত তৈরি করেছেন গৌতম ঘোষ। মনোজ প্রসাদের আলো নাটকের মান উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর করেছে। আরও একটি বিভাগ পোশাক, যেখানে মুনমুন হালদার সফলতার পরিচয় রেখেছেন। এই নাটকে ওই একনায়কতন্ত্র, তার পতন আর পুনরুত্থানের ফাঁকফোকরগুলো চিহ্নিত। চিহ্নিত সমকাল আর সমাজ, রাজনীতি, প্রেম-ভালোবাসা।
শুভঙ্কর গুহ