সন্তানের বিদ্যাশিক্ষায় নজর দেওয়া প্রয়োজন। অতিরিক্ত পরিশ্রমে শরীরে অবনতি। নানাভাবে অর্থ অপচয়। কর্মপরিবর্তনের সম্ভাবনা বৃদ্ধি।প্রতিকার: ... বিশদ
‘রাঙা হাসি রাশি রাশি অশোকে পলাশে/ রাঙা নেশা মেঘে মেশা প্রভাত-আকাশে...।’
হ্যাঁ, প্রকৃতির রূপেই বসন্তের আগমনবার্তা স্পষ্ট। আর প্রকৃতির সেই রং মিশেছে আমাদের হৃদয়ে। তাই হৃদকমলে রং লেগেছে, বেজে উঠেছে দোলের সুর। আজ বরং ঘুরে আসি শ্রীকৃষ্ণের বৃন্দাবন থেকে। যেখানে রঙের নেশায় মাতাল কৃষ্ণের মন ব্যাকুল হতো তাঁর রাধারানির জন্য। আর রাধারানি? তিনি কী করতেন তখন? চিরসখার ডাকে সাড়া তো দিতেনই, কিন্তু তাঁর সঙ্গেও থাকত লীলাখেলার নানা আয়োজন। বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণ আর রাধারানির চালু করা সেই রীতি আজও প্রচলিত।
বৃন্দাবনের দোল বিষয়ে কথা হল উত্তরপ্রদেশের বারসানার রাধারানি মন্দিরের অন্যতম সেবায়েত বিহারী গোস্বামীর সঙ্গে। বললেন, তাঁদের রাজ্যে হোলির আনন্দ শুরু হয় দোলের অনেক আগে থেকেই। মোটামুটি এক সপ্তাহ থেকে দশ দিন ধরে চলে এই উৎসব। শ্রীকৃষ্ণের রং খেলার ইতিহাস মেনেই সেখানে এখনও রঙের উৎসব আয়োজিত হয়। আর এই উৎসবে মহিলারাই মুখ্য ভূমিকা পালন করেন।
বৃন্দাবনের দু’টি গ্রাম বারসানা আর নন্দগাঁও। বারসানায় শ্রীরাধিকার নিবাস ছিল আর নন্দগাঁওয়ে থাকতেন শ্রীকৃষ্ণ। দোলের ঠিক আগেই নন্দগাঁও থেকে বিনা নিমন্ত্রণে শ্রীকৃষ্ণ সবান্ধব হাজির হন বারসানায়। উদ্দেশ্য, প্রিয় রাধারানিকে দোলের রঙে রাঙিয়ে তোলা। তাঁর অভিপ্রায়ের কথা আগে থেকেই টের পেয়ে যান রাধারানি। তাই তিনিও ফন্দি আঁটলেন সখীদের নিয়ে। শ্রীকৃষ্ণ যেই না রং মাখাতে যাবেন অমনি লাঠি দিয়ে তুমুল প্রহার চালানো হল তাঁর ওপর। সখারাও ছাড় পেলেন না। শ্রীরাধিকার সখীদের হাতে তাঁরাও লাঠির ঘা খেলেন। তাই বলে কি রঙের নেশায় খামতি রইল কিছু? মোটেও না, মার খেয়ে চলে যাওয়ার পাত্র নাকি শ্রীকৃষ্ণ! তাই মারের ফাঁকে ফাঁকেই তিনি রঙের ফোয়ারায় ভেজালেন রাধারানিকে। মন ভিজল তাঁর। দোলের রঙে রঙিন হল শ্রীরাধিকার পরাণও। আর সেই রঙের নেশায় মেতে উঠল গোটা গ্রাম। বিহারী গোস্বামী জানালেন, আজও এই রীতি সমানে চলেছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন কিছু রেওয়াজ। এখানে উৎসবের সূত্রপাত হয় লাড্ডু হোলি দিয়ে।
দোলে শুধু রঙের বর্ষণ হয় না, তার আগে মিষ্টির বর্ষণও হয় বারসানা গ্রামে। কেমন সেই রেওয়াজ? বিহারী গোস্বামী বললেন, ‘প্রতি বছর দোলের ঠিক এক সপ্তাহ আগে বারসানা গ্রামের মহিলারা যান নন্দগাঁও। হাতে তাঁদের নেমন্তন্নের চিঠি। নন্দগাঁওয়ের প্রতিটি ঘরে পুরুষদের দোল খেলার আমন্ত্রণ জানিয়ে আসেন তাঁরা। সেই আমন্ত্রণপত্র নন্দগাঁওয়ের পুরুষকুল গ্রহণ করলে নিজেদের গ্রামে ফিরে খুশির আনন্দে লাড্ডু হোলি পালন করেন বারসানা গ্রামের মহিলারা।’ প্রতি বছরের মতোই এবছরও লাড্ডু হোলির জন্য রাধারানি মন্দিরে দশ কুইন্টাল লাড্ডু এনেছিলেন ভক্তরা। সেই লাড্ডু ভেঙে একে ওপরকে মাখিয়ে ও খাইয়ে পালিত হয়েছে লাড্ডু হোলি। কিন্তু অন্যান্য বছরের তুলনায় তো এবছরটা আলাদা, তাই না? কোভিড সংক্রমণের ভয়ও তো রয়েছে। তবু তারই মধ্যে লাড্ডু হোলি উদ্যাপিত হল? প্রশ্ন শুনে অবাকই হলেন বিহারীজি। তাঁর মতে, ‘শ্রীকৃষ্ণ ভগবানের আশীর্বাদ রয়েছে বারসানা গ্রামের লোকদের ওপর। রোগের ভয়ে থাকতে থাকতে আমাদের মনের আনন্দই উধাও হয়ে গিয়েছে। তাই এই লাড্ডু হোলি, লাঠমার হোলির মতো উৎসব আয়োজনের মাধ্যমেই মনে রঙের ছোঁয়া লাগাচ্ছেন গ্রামের মহিলা, পুরুষ ও কচিকাঁচার দল। তবে কোভিডের জন্য জরুরি সাবধানতাও নেওয়া হয়েছে।’
লাঠমার হোলি প্রসঙ্গে ফেরা যাক। এখন কেমনভাবে পালিত হয় এই উৎসব? মন্দিরের তরফে গোপিনী স্বরূপ সখী জানালেন, আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে দোলের ঠিক আগের দিন নন্দগাঁও থেকে ফুল, ফাগ আর আবির নিয়ে ছেলেরা আসেন বারসানায়। তারপর দোলের আগের সন্ধ্যায় বারসানার মেয়েদের গায়ে রং দিতে তাঁরা উপস্থিত হন হোলির মাঠে। কৃষ্ণকুঞ্জ সাজানো থাকে সেখানে। পাতা হয় ফুলের দোলনা। আর সেই কৃষ্ণকুঞ্জে, গাছের আড়ালে রঙিন লাঠি নিয়ে লুকিয়ে থাকেন বারসানা গ্রামের মেয়েরা। নন্দগাঁওয়ের ছেলেরা যেই না রং নিয়ে মেয়েদের দিকে ধেয়ে যান, অমনি তাঁদের আটকানোর জন্য লাঠির আক্রমণ শুরু হয়। এই প্রহারের হাত থেকে নিজেদের বাঁচানোর জন্য নাকি নন্দগাঁওয়ের ছেলেরা এখন হাতে তৈরি ঢালও সঙ্গে রাখেন। গোপিনী স্বরূপ সখী বললেন, ‘লাঠি বানানো আর আমন্ত্রণপত্র তৈরির আয়োজন প্রায় মাসখানেক আগে থেকেই শুরু হয়ে যায়।’ আনন্দের এই একটা সপ্তাহের আশায় সারা বছর প্রতীক্ষা করেন তাঁরা। স্বরূপের কথায়, আগে গোটা বারসানা গ্রামই অংশগ্রহণ করত হোলি উৎসবে। এখন আর তা হয় না। এখন শুধুই মন্দির সংলগ্ন এলাকার গোস্বামী সম্প্রদায়ের মহিলা ও পুরুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে এই উৎসব। বাকি বারসানা গ্রামেও হোলি খেলা হয়, তবে তা নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। রাধা-কৃষ্ণের ঐতিহাসিক উৎসবের নানাবিধ আয়োজনও সেখানে তেমনভাবে পালিত হয় না। তাই বলে রঙের আনন্দ মোটেও কম পড়ে না বারসানা গ্রামের অন্যত্র। সেখানেও হোলি খেলা হয় সাত দিন ধরে। তবে তা পুরোপুরি রং নির্ভর। অন্যান্য গতানুগতিক আয়োজন তাতে থাকে না।
শুধু দোল খেলাই নয়, বসন্ত উৎসবের প্রস্তুতিপর্বে মহিলাদের বিরাট ভূমিকার কথা জানালেন স্বরূপ। তাঁর কথায়, ‘দোল আমাদের জীবনে নতুন রঙের পরশ আনে। এমন উৎসবের প্রস্তুতি চলে মাস খানেক ধরেই। বাড়ি সাজানো হয়, ঘরের প্রতিটি আসবাবে নতুনত্ব আনা হয়। ঘরদোর রঙিন করে তোলা হয়। বাড়ির বাইরে আবির দিয়ে আলপনা আঁকা হয়। আর এইসব কাজ সম্পূর্ণভাবেই মহিলাদের হাতে থাকে। এমনকী, রং খেলার মাঠ সাজানোর দায়িত্বও গোপিনীদের। পালা করে একদল গোপিনী এই কাজ সামলান। দোলের আনন্দ যাতে সকলের মধ্যেই ছড়িয়ে যায়, সেই দিকেও মেয়েরাই নজর রাখেন।’
গতানুগতিকতা আর ঐতিহ্যের প্রসঙ্গ টেনে স্বরূপ আরও জানালেন, দোল উৎসবের রীতিনীতি অল্পবিস্তর বদলানো হয়েছে। গোঁড়ামি থেকে বেরিয়ে সমাজ যে এই পরিবর্তনগুলো মেনে নিয়েছে এটাই আশার কথা। শুধু কুমারী বা সধবারাই নন, বিধবারাও এখন অংশগ্রহণ করেন দোলে। তাঁদের জন্য এখন দোলের শেষ দিনটি রাখা হয়। ওইদিন বিধবারা আশ্রম জীবন থেকে বেরিয়ে এসে দোলের রঙিন ছোঁয়ায় রাঙিয়ে তোলেন নিজেদের। তাঁদের মনেও তখন আনন্দের বহতা ধারা। আনন্দ উৎসবে শামিল হয়ে সকলের সঙ্গে তাঁদের মরমেও ফাগুনে রঙের পরশ লাগে। ওই একটা দিন বসন্ত হাওয়ায় গা ভাসিয়ে তাঁরাও হয়ে ওঠেন মনেপ্রাণে রঙিন।