সন্তানের বিদ্যাশিক্ষায় নজর দেওয়া প্রয়োজন। অতিরিক্ত পরিশ্রমে শরীরে অবনতি। নানাভাবে অর্থ অপচয়। কর্মপরিবর্তনের সম্ভাবনা বৃদ্ধি।প্রতিকার: ... বিশদ
‘আগন্তুক’ ছবির মনমোহন মিত্রর ছিল পায়ের তলায় সর্ষে। আর এঁদের পায়ের তলায় চাকা। আক্ষরিক অর্থেই গাড়ির চারটে চাকায় ভর করে ইতিমধ্যেই ৩২টি দেশ ঘুরে ফেলেছেন চন্দননগরের দম্পতি দেবাঞ্জলি ও কৌশিক রায়। দেবাঞ্জলি পেশায় চিকিৎসক। কৌশিক শিল্পপতি। তবে পেশার বাইরে নেশাই এই দম্পতির বেঁচে থাকার আরশিনগর। বদ্ধ ঘর পেরিয়ে জগৎ দেখায় নেশায় বুঁদ দু’জনে। সঙ্গী তাঁদের ছোট দুই কন্যা। আগামী মে মাসে ১৮ দিন ধরে কাজাখস্তান, কিরঘিজস্তান, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান— মধ্য এশিয়ার এই চারটি দেশ গাড়িতে ঘুরবেন তাঁরা। পথের হিসেবে প্রায় সাড়ে চার হাজার কিলোমিটার। সহযোগিতায় অটোমোবাইল অ্যাসোসিয়েশন অব ইস্টার্ন ইন্ডিয়া। সেই ভ্রমণ সেরে এসে সেপ্টেম্বরেই ট্রান্স-সাইবেরিয়ান রেলওয়ে ও রাশিয়ার পরিকল্পনা সেরে রেখেছেন। শুধু তা-ই নয়, এর আগে ভারতীয় হিসেবে প্রথমবার গাড়ি নিয়ে গোটা মানস সরোবর ও তিব্বত ঘুরেছেন দেবাঞ্জলিরা।
তবে স্রেফ দেশ বেড়ানোর তাগিদেই যে তাঁরা বিশ্বভ্রমণে যান তা কিন্তু নয়। দেবাঞ্জলির মতে, ‘যে কোনও কাজের সঙ্গে যদি কোনও সামাজিক বার্তা জুড়ে দেওয়া যায়, তাহলে তা অবশ্যই ভালো। ২০১৮ সালটি ছিল ‘পেন অ্যাওয়ারনেস ইয়ার’। তাই সে বছর আমরা ব্যথার চিকিৎসা সম্পর্কে প্রচারকেও আমাদের বেড়ানোর একটা অংশ করে তুলি। ‘ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব দ্য স্টাডি অব পেন’ অর্থাৎ আইএএসপি-র বার্তা নিয়ে আমরা বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ি। দীর্ঘ যাত্রায় শেখাই ব্যথা কমানোর মন্ত্র।’
দেবাঞ্জলির স্বামী কৌশিকের রয়েছে গাড়ির নেশা। স্টিয়ারিংই প্রথম প্রেম। তাই বউ যখন ব্যথা কমানোর মন্ত্রগুপ্তি শেখাচ্ছেন বিশ্ববাসীকে, তখন সেফ ড্রাইভ সেভ লাইফের কথা বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে দিয়েছেন কৌশিক।
মানসিক অবসাদ বা ডিপ্রেশন যখন তখন কোপ বসাতে পারে নগরজীবনে। সেই ডিপ্রেশন থেকেই মনের মধ্যে গুঁড়ি মেরে ঢুকে পড়ে হিংসে, চারপাশের লোকজনের সাফল্য চোখ টাটায়। মনোবিদ অরিন্দম মুখোপাধ্যায়ের মতে, ‘এই সব সমস্যাই অনেকাংশে অবসাদের কারণ। এছাড়া চারপাশের বদ্ধ পরিবেশ ও রুটিন জীবনে অভ্যস্ত হতে হতে চোরাপথেও হানা দেয় অবসাদ। তাই বেড়াতে যাওয়াই এর একমাত্র প্রতিষেধক।’
দেবাঞ্জলিও মানেন তা। বললেন, ‘এর আগে গাড়ি নিয়ে গোটা ভারতবর্ষ ঘুরেছি। কৌশিককে গাড়ির নেশা ধরিয়েছিলেন আমার শ্বশুর চন্দ্রকান্ত রায়। আর আমাকে সে নেশা ধরিয়েছে কৌশিক। দেশ হোক বা বিদেশ, গোটা সড়কপথ আমরাই পালা করে স্টিয়ারিংয়ে বসি।’
কিন্তু এই এত দীর্ঘ সময় একটানা ড্রাইভিং, ভয় করে না? ক্লান্তিও তো আসে!
‘আমাদের গাড়িটা হল ইসুজু ডি ম্যাক্স। মডেল ভি ক্রস। এগুলো ইউটিলিটি ভেহিকল। আমরা কিন্তু খুব কষ্ট করেই এই সফরগুলো করি। গাড়ির ডিকিতে প্রায় পুরো সংসার তুলে নিয়ে যেতে হয়। ফোল্ডিং চেয়ার, স্লিপিং ব্যাগ, আমার মেয়ে যখন ২০১৮-তে আমাদের সঙ্গে যায়, ওর তখন চার বছর বয়স। ওর জন্য পর্যাপ্ত শুকনো খাবার, ওর প্রয়োজনীয় জিনিস, আমাদের ন্যূনতম দরকারি জিনিস, ওষুধপত্র, মশলাপাতি সবই গাড়িতে নিতে হয়েছিল। তাই বাড়তি টেনশন একটা ছিলই। তবে আমি বা আমার স্বামী দু’জনেই গাড়ি চালাতে এত ভালোবাসি যে আলাদা করে ক্লান্তি আসে না। তবে খুব সাবধানী তো হতেই হয়। তাছাড়া অনেক জায়গাতেই সমুদ্র পেরনোর ব্যাপার থাকে। তখন গাড়িটাকে জাহাজে করে পারাপারের ব্যবস্থা করতে হয়। ওই দেশের প্রশাসন বা বিশেষ আধিকারিকদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলতে হয়। এগুলো নিয়েই গোটা সফর।’
২০১৮-র ভ্রমণ ছিল ছবির মতো সাজানো। ভারতের উত্তরপূর্বের সীমানা ধরে মণিপুর হয়ে প্রথমে মায়ানমার ও থাইল্যান্ড, তারপর লাওস, চীন, কিরঘিজস্তান, উজবেকিস্তান, কাজাখস্তান। এরপর ওখান থেকে রাশিয়া হয়ে ফিনল্যান্ড, নরওয়ে ও সুইডেন ঘোরেন দেবাঞ্জলিরা। এরপর বাল্টিক সাগর পেরিয়ে পূর্ব ইউরোপের কিছু দেশ দেখেন তাঁরা। এই সফরেই চেকস্লোভাকিয়া, সুইডেন, অস্ট্রিয়া, সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স, ইতালি, গ্রিস ঘোরা শেষ করে তাঁরা পাড়ি জমান বুলগেরিয়া, ক্রোয়েশিয়া, সার্বিয়ার দিকে। এরপর তুরস্ক, জর্জিয়া ও আজারবাইজান হয়ে ইরানে পৌঁছন তাঁরা। ইরান ঘুরে গাড়িটিকে জাহাজে ফেরত পাঠিয়ে নিজেরাও দেশে ফেরেন। এই লম্বা ভ্রমণে সময় লেগেছিল সাড়ে সাত মাস।
দেশ-বিদেশের এই লম্বা সফরগুলোয় নানা অভিজ্ঞতা তো ঘটেই, সঙ্গে যোগ হয় স্মরণীয় কিছু মুহূর্তও। এই যেমন, পোল্যান্ডে পৌঁছে কার্ড বিপত্তিতে পড়েন এই দম্পতি। দেখা যায়, হোটেল তো দূর, পোল্যান্ডের কোনও ব্যাঙ্কেও তাঁদের কোনও কার্ড কাজ করছে না। একমাত্র সেখানকার একটি শপিং মলে তাঁদের একটিমাত্র কার্ড কাজ করছে। এদিকে হোটেল ভাড়া বাকি! তাহলে উপায়? সহযোগিতার হাত বাড়ালেন পোলিশ হোটেল মালিক, জানিয়ে দিলেন, ভাড়া লাগবে না। বরং শপিং মলটি থেকে ভাড়ার সমমূল্যের ডিটারজেন্ট কিনে দিলেই হবে। এমন নানা অভিজ্ঞতা সাজিয়ে বিদেশ ভ্রমণের একটি বইও লিখছেন দেবাঞ্জলি রায়।
বেড়ানোর সুদীর্ঘ সময় মা-বাবার সঙ্গে সমান তালে সঙ্গত করে চলে সাত বছরের ছোট্ট দিয়াসিনি। গাড়ির ধকল সহ্য করে দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়াতে সে এই বয়সেই বেশ পটু। আসন্ন ভ্রমণে আবার তাদের দলে যোগ দেবে দিয়াসিনির ছোট বোন দেবর্ণী, যে কিনা মাত্র এক বছরের খুদে সদস্য!
মে মাসে যখন ব্যথা নিরসনের চিকিৎসা ও পথ সুরক্ষার বার্তা নিয়ে মধ্য এশিয়ার দেশগুলো চষে বেড়াবে দিয়াসিনি, তখন না হয় স্কুল ছুটি, কিন্তু সেপ্টেম্বরের বেলায় কী হবে? ট্রান্স-সাইবেরিয়ান রেলওয়ে ও রাশিয়ায় পেন ম্যানেজমেন্ট নিয়ে প্রচারে যাওয়ার সময় যদি কোভিড পরবর্তী স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্কুল খুলে যায় দিয়াসিনির? মা দেবাঞ্জলির সাফ উত্তর, ‘স্কুল যদি খোলেও, তাহলে মাস দুইয়ের জন্য দিয়াসিনি আমাদের সঙ্গে রাশিয়া ও পৃথিবী বিখ্যাত ট্রান্স-সাইবেরিয়ান রেলওয়ে দেখবে। আমি নিজে একজন ডাক্তার। ওদের বাবাও লেখাপড়ায় ভালো ছিলেন। আমাদের কখনও মনে হয় না যে ক্লাস ওয়ানে কয়েক মাস স্কুল কামাই হলে ওর কেরিয়ারে বিরাট কোনও বাধা আসবে। আর সঙ্গে আমরা তো থাকছিই। ওর পড়াশোনার ভিত যাতে ওই দু’মাসে অবহেলিত না হয় তা আমরাই দেখব। দেশ দেখে ওর যে অভিজ্ঞতা হয়, তা ওর বয়সি ক’জনেরই বা হয়!’ দেবাঞ্জলির কর্মকাণ্ডে উৎসাহী হয়ে বেশ কয়েকজন মে মাসে তাঁদের সঙ্গে পাড়ি দেবেন মধ্য এশিয়ার দেশগুলোয়। সবাইকে নিয়েই পরবর্তী সফরের পথ চেয়ে চন্দননগরের রায় পরিবার।