সন্তানের বিদ্যাশিক্ষায় নজর দেওয়া প্রয়োজন। অতিরিক্ত পরিশ্রমে শরীরে অবনতি। নানাভাবে অর্থ অপচয়। কর্মপরিবর্তনের সম্ভাবনা বৃদ্ধি।প্রতিকার: ... বিশদ
সাফল্যের সোপান বেয়ে আজ আকাশ ছুঁয়ে ফেলেছেন মেয়েরা। তবু লিঙ্গবৈষম্য আজও প্রকট। এবং যুগ যুগ ধরে এই বৈষম্যের শিকার হয়ে চলেছি আমরা মেয়েরা। কখনও পারিবারিক ক্ষেত্রে, কখনও বা কর্মক্ষেত্রে নারী অবহেলিত হয়ে এসেছে বহু যুগ। আশ্চর্যের কথা, নারীর এই সামাজিক অবহেলা কিন্তু তাঁর আকাশছোঁয়া সাফল্যের পরেও খুব একটা কমেনি। একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও নারী লিঙ্গবৈষম্যের শিকার। পারিবারিক হিংসা, কর্মক্ষেত্রে অবহেলা এবং আরও নানারকম সামাজিক অমর্যাদার মুখোমুখি প্রতিনিয়ত মেয়েরা। এই বিষয়ে কথা হচ্ছিল স্বস্তি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার ডিরেক্টর শাঁওলি চক্রবর্তীর সঙ্গে। তিনি বললেন, এই মুহূর্তে কর্মসূত্রে মেয়েরা এমন একটা মোড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে যেখান থেকে একদিকে রাস্তা গিয়েছে সাফল্যের পথে, আর একটা পথ গিয়েছে লিঙ্গবৈষম্যের দিকে। একদিকে মেয়েদের সাফল্যের সীমা নেই, আবার অন্য দিকে সেই মেয়েরাই লিঙ্গবৈষম্যের শিকার!
সাফল্যের সঙ্গে লিঙ্গবৈষম্য— দু’টি কি পরস্পর-বিরোধী বিষয় নয়? আমার পাল্টা প্রশ্নে শাঁওলি বললেন, ‘আপাতভাবে পরস্পর-বিরোধী হলেও নারীর কর্মক্ষেত্রের প্রেক্ষিতে দেখলে জিনিসটা বোঝানো সহজ হবে। এখন শহরে তো বটেই, গ্রামেগঞ্জেও বহু মহিলা স্বনির্ভর। কিন্তু কর্মসংস্থানের পাশাপাশি তাঁদের দৈনন্দিন প্রয়োজনের কথা মাথায় রাখে না মালিক। তাই এখনও অনেক কর্মক্ষেত্রেই মহিলা কর্মীদের সঠিক টয়লেট নেই।’
কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের সঠিক টয়লেটের অভাবের কথা সাম্প্রতিক ক্ষেত্রে আরও একবার উঠে এসেছিল, যখন সেনাবাহিনীতে মেয়েরা স্কোয়াড্রন লিডার পদে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। সেখানে জনৈক সেনাধ্যক্ষ তাঁর বক্তব্যে জানান, মহিলাদের উন্নতি অবশ্যই কাম্য, তবে তার আগে উন্নতির প্রেক্ষাপটটা সঠিকভাবে সাজিয়ে নেওয়া জরুরি। তাই মেয়েদের স্কোয়াড্রন লিডার পদে বসানোর আগে একটা লেডিজ টয়লেট তৈরি করা দরকার ছিল। শাঁওলির বক্তব্য অনুযায়ী, মহিলাদের জরুরি কিছু প্রয়োজনের কথা এখনও সমাজ ভাবতে শেখেনি। অথচ মেয়েরা নিজেদের যোগ্যতায় সাফল্যের শিখর ছুঁয়েছেন। তিনি আরও বলেন, মেয়েরা এখনও সমাজের চোখে মানুষ হয়ে উঠতে পারেননি। ‘মেয়েমানুষের’ পর্যায়েই আটকে রয়েছেন। তাই তাঁদের উন্নতি নিয়ে যে আলাদাভাবে ভাবনাচিন্তার প্রয়োজন, সে বিষয়ে সমাজ হয়তো অবগতই নয়। আর সেই কারণেই এই বৈষম্য। শাঁওলির সংযোজন, ‘এখনও মেয়েদের শারীরিক প্রতিবন্ধকতার সুযোগ নেয় সমাজ। শত উন্নতি আর সাফল্যের পরেও মেয়েরা সেই স্বাধীনতা অর্জন করতে পারেননি। প্রতি মুহূর্তে তাঁরা নিজেদের প্রয়োজনগুলোকে এড়িয়ে, বাঁচিয়ে বা ঢেকে চলতে অভ্যস্ত হয়ে যান। প্রতি মাসে মেনস্ট্রুয়েশন ফ্লোয়ের কারণে তাঁরা কুণ্ঠিত থাকেন। এবং পুরুষতন্ত্র মেয়েদের এই কুণ্ঠার সুযোগ নেয়। আর শুধু পুরুষতন্ত্রই বা বলি কী করে? মহিলারাও যে মহিলাদের প্রতি সবসময় সদয় থাকেন, তা-ও তো নয়।’ তিনি এমন ঘটনারও সাক্ষী যেখানে একজন মহিলা মেনস্ট্রুরাল ফ্লোয়ের কারণে বারবার বাথরুমে যেতে বাধ্য হলে অন্য মহিলাই তাঁকে কটাক্ষ করেন, জানালেন শাঁওলি। তাছাড়া ওই সময়ে মেয়েদের শারীরিক অবস্থাকে আমাদের উন্নত সমাজেও ‘লজ্জার’ বিষয় বলে ভাবা হয়।
তবে সবটাই যে অন্ধকারাচ্ছন্ন, তা নয়। আশার কথা এই যে, সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি সামান্য হলেও পাল্টাচ্ছে। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা মেয়েদের এই শারীরিক পরিস্থিতিকে সহজ করে দেওয়ার জন্য উদ্যোগী হচ্ছে। আসন্ন নারী দিবসে যেমন পদক্ষেপ নিয়েছে ‘উড়ান’ স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাটি। সমাজের নিম্নস্তরের মহিলাদের জন্য তারা ৮ মার্চ একটি নারী স্বনির্ভর প্রকল্পের আয়োজন করেছে। সেখানে মহিলাদের উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের জন্য বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
অনেকেই মনে করেন, নারী উন্নয়নের পথে আর একটা বড় বাধা সন্তানের জন্ম দেওয়ার প্রক্রিয়া। সেক্ষেত্রেও মেয়েদের রীতিমতো করুণার পাত্রী হিসেবে দেখা হয়। সন্তানধারণের ক্ষেত্রে হরমোনাল কিছু সমস্যা তো তৈরি হয়ই, তাছাড়াও ওই সময়ে মেয়েদের শারীরিক বিভিন্ন অসুবিধেও দেখা দেয়। তখন যে সামাজিক ও পারিবারিক সমর্থন মেয়েদের পাওয়া উচিত, তা তাঁরা অধিকাংশ সময়েই পান না। উল্টে কর্মক্ষেত্রে এবং বাড়িতে বহু ধরনের সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয় তাঁদের। দুঃখের বিষয়, মেয়েদের বিরুদ্ধে এ ধরনের সমালোচনা সবসময় পুরুষ করেন এমন নয়, অন্য মহিলারাও অনেকসময়ই কটু মন্তব্য করে থাকেন।
তাই বলে মহিলাদের ক্ষমতায়ন থমকে যাচ্ছে তা কিন্তু নয়, জানালেন শাঁওলি। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে সমাজ এগচ্ছে। মেয়েদের জন্য নানা ধরনের ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্প চালু হয়েছে। সেই সুযোগে অনেক মহিলা নিজের ব্যবসাও শুরু করেছেন। সংসারের আয় বাড়াতে মেয়েরা পুরুষের পাশাপাশি এগিয়ে আসছেন। এখন মেয়েদের জীবন আর সংসারের চার দেওয়ালের ভেতর আটকে নেই। এবং মেয়েদের স্বনির্ভর হয়ে ওঠার পিছনে পুরুষের সক্রিয় ভূমিকাও লক্ষ্যণীয়। এই সমাজে পুরুষরাও তাঁদের স্ত্রীয়ের পাশাপাশি ঘরের কাজে পটু হয়ে উঠছেন, তাঁরাও স্ত্রীদের সঙ্গে বিভিন্ন কাজ ভাগ করে নিচ্ছেন বলে মেয়েরা ঘরেবাইরে পারদর্শী হয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছেন। এটা যেমন একদিকে সত্য, তেমনই আবার পারিবারিক হিংসা বেড়ে যাওয়ার ঘটনাও সঠিক, বললেন শাঁওলি। তাঁর কথায়, ‘এ যুগের পুরুষদের চিন্তাধারায় অসম্ভব এক বৈপরীত্য লক্ষ করা যায়। একদিকে তাঁরা স্ত্রীকে সংসারের কাজে সাহায্য করেন, স্ত্রীয়ের স্বনির্ভরতাকে সমর্থন করেন আবার অন্যদিকে পান থেকে চুন খসলে স্ত্রীয়ের সমালোচনা করেন, এমনকী তার গায়েও হাত তোলেন।’
সামাজিক বা পারিবারিক থেকে যদি আমরা কর্মক্ষেত্রের দিকে চোখ ফেরাই তাহলে দেখব মেয়েদের ক্ষমতায়নের একটা সীমা রয়েছে। যার ওপরে সহজে তাঁরা যেতে পারেন না। যোগ্যতা সেখানে বড় কথা নয়। বড় কথা, তাঁরা মহিলা। অতএব লিঙ্গবৈষম্য ঘরেবাইরে সর্বত্র বিরাজমান। শাঁওলি বললেন, কর্পোরেট সেক্টরে বিশেষভাবে দেখা যায় একটা স্তরের পর মেয়েদের যোগ্যতা থাকলেও আর পদোন্নতি হয় না। কিন্তু আশার কথা এই যে মহিলাদের ক্ষমতায়নে বিভিন্ন প্রকল্প চালু হয়েছে। সেক্ষেত্রে মহিলাদের উচিত চাকরি ছেড়ে স্বনির্ভরতার রসদ খোঁজা। ব্যবসা করলে তার মাধ্যমে আর পাঁচজনকে স্বনির্ভর করে তোলা যায়। মেয়েদের সেই পদক্ষেপ করা উচিত।
নারী উন্নয়নের একপিঠে ক্ষমতায়ন, অন্যপিঠে পারিবারিক হিংসা। জীবন নির্ধারণের জন্য কোন পথ বেছে নেবেন, তা নারী নিজেই বিচার করতে পারেন। আশা একটাই, অনেক অবহেলা আর নির্যাতন পেরিয়ে নারীকণ্ঠ ক্রমশ সরব হয়ে উঠছে। তাই তো মহিলাদের ক্ষমতায়ন বা নারী স্বনির্ভর প্রকল্প আজ আর শুধুমাত্র কয়েকটা লব্জ হয়ে থেমে নেই। বরং সেই সূত্র ধরে এগিয়ে চলেছে মেয়েদের জীবন। তাই তো ‘মেয়েমানুষের’ খোলস ছেড়ে মানুষ হয়ে উঠতে উদ্যত নারী। ছবি: স্বস্তি-র সৌজন্যে