হঠাৎ নেওয়া সিদ্ধান্তে বিপদে পড়তে পারেন। চলচিত্র ও যাত্রা শিল্পী, পরিচালকদের শুভ দিন। ধনাগম হবে। ... বিশদ
নাম কাহিনি
সুমন আর সেঁওতীর ব্র্যান্ড ‘দর্জি শান্তিনিকেতন’। তাঁরা সাস্টেনেবল ফ্যাশনে (অর্থাৎ যা টেকসই হবে) বিশ্বাসী। যে রং বা কাপড় তাঁরা ব্যবহার করেন এবং তাঁদের নকশা—সবই প্রকৃতির খুব কাছাকাছি। সুমন জানালেন, দর্জি পোশাক তৈরি করেন, তাই ব্র্যান্ডে রেখেছেন দর্জি শব্দটা। আর তাঁদের পোশাকের রং, ডিজাইন বা নান্দনিকতা, সবেতেই শান্তিনিকেতন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে। তাই তাঁদের ব্র্যান্ডের নাম ‘দর্জি শান্তিনিকেতন’।
বছর তিনেক আগে পোশাকে ন্যাচারাল ডাই নিয়ে কাজ করার কথা ভেবেছিলেন তাঁরা। বর্ণময় প্রকৃতির কাছ থেকে রং খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা শুরু তখন থেকেই। ফুল পাতা কিংবা মাঠেঘাটে ছড়িয়ে থাকা নানা সামগ্রী থেকে রং বের করে সেই রং জামাকাপড়ে দেওয়া যায় এবং পোশাক ধুয়ে ফেললেও সেই রং যে ওঠে না, সেই কৌশল হাতেকলমে জেনে নেওয়ার জন্য উদ্যোগী হন তাঁরা। কেমিক্যাল রং আবিষ্কার হওয়ার বহু শতাব্দী আগে জামাকাপড়ে এই ধরনের রং ব্যবহার করা হতো। সেঁওতী বললেন, ‘শান্তিনিকেতনে ন্যাচারাল ডাই করার চল অনেক দিনই। অতীতে বসন্ত উৎসবের সময় পলাশের রঙে পাঞ্জাবি ও শাড়ি রাঙিয়ে তোলা হতো। পাঠভবনের ইউনিফর্মেও এই ধরনের ন্যাচারাল ডাই ব্যবহার হয়েছে এক সময়। ফলে এই প্রথাটা ছিলই।’
রঙে মেশা
‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন ইন্দোনেশিয়ার বালি থেকে বাটিক নকশাটি শান্তিনিকেতনে নিয়ে আসেন, তখন থেকে এই নকশার প্রচলন শুরু হয়েছে আমাদের শান্তিনিকেতনে। সেটাও হতো সম্পূর্ণ ন্যাচারাল ডাইয়েই,’ বলেন সুমন। তাঁর দাবি, সারা বিশ্বে রাসায়নিক দূষণ ঘটানোর ক্ষেত্রে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ফ্যাশন দুনিয়া। অর্থাৎ আমরা নিয়মিত যে পোশাক পরি, তা তৈরি করতে যত রাসায়নিক রং বা উপাদান ব্যবহার হয়, তার সবটাই বিভিন্ন নদীতে মিশছে। দূষণের মাত্রা এভাবেই বাড়ছে।
যমুনার তীরে ছট পুজোর একটা ছবি দেখে চমকে গিয়েছিলেন সুমন। জলের সাদা ফেনা অবাক করেছিল তাঁকে। খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন যমুনা তীরবর্তী রাসায়নিক তৈরির কারখানা থেকে বর্জ্য মিশে জলের ওই হাল হয়েছে। তখন থেকে সুমনরা ভাবতে থাকেন, পরিবেশকে স্বস্তি দিয়ে কীভাবে পোশাক বানানোর কাজটা করা যায়। সেই থেকেই ন্যাচারাল ডাইয়ে ফেরা। এখন পোশাকে কোনও কেমিক্যালই ব্যবহার করেন না তাঁরা। তবে এই ধরনের প্রাকৃতিক উপাদান নিয়ে কাজের একটা অসুবিধে হল এই ধরনের রং টেরিকট বা সিন্থেটিক কাপড় শুষে নিতে পারে না। সুতি, উল আর সিল্কেই শুধুমাত্র ন্যাচারাল ডাই করা সম্ভব। তাই হ্যান্ডলুমের কাপড় দিয়ে কাজ করা শুরু করেন তাঁরা।
কিছু প্রাকৃতিক রং তাঁরা নিজেরাই তৈরি করে নেন। যেমন গাঁদা ফুল বাড়ির বাগানেই ফোটে। কম পড়লে বাজার থেকে আরও ফুল কিনে নেন। আবার কিছু প্রাকৃতিক রং যেমন ইন্ডিগো, তাঁদের কিনতে হয়। সেটা তামিলনাড়ু থেকে আসে অনলাইনে। এই রংটিও স্থানীয়ভাবে তৈরি করা যায় কি না, সে ব্যাপারে ভাবনাচিন্তা করছেন তাঁরা। পোশাক বানানোর প্রতিটি ধাপে স্থানীয়ভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে ওঠার চেষ্টা করছেন তাঁরা।
কাজের ধরন
কীভাবে কাজ হয় জিজ্ঞেস করতে সুমন-সেঁওতী জানালেন, শান্তিনিকেতনে চিরাচরিতভাবে চলে আসা খেস জাতীয় কাপড়, আশপাশে কাটোয়া ও শান্তিপুরের গ্রাম থেকে সুতির কাপড় এনে সেগুলো প্রাকৃতিক রং দিয়ে রাঙানো হয়। কখনও হরিতকী-গাঁদা ফুল-কাঁচা হলুদ, কখনও খয়ের-মোচা-গুড়, কখনও আবার ইন্ডিগো থেকে রং বের করে চুবিয়ে নেওয়া হয় কাপড়ে। বাটিকের জন্য কাপড়ে মোম দিয়ে ছবি এঁকে রঙে চুবিয়ে তুলে নিলে মোমের অংশটা বাদ দিয়ে রঙিন হয়ে একটা নকশা ফুটে ওঠে। মোমে রং ধরে না। তা থেকেই বাটিকে নকশা তোলা হয়। এখন মোমের বদলে অনেকে প্যারাফিন ব্যবহার করেন, কারণ খরচ বাঁচে তাতে। কিন্তু সুমন জানালেন, তাঁরা এখনও মধু এবং মোম দিয়ে বাটিকের কাজ করছেন। প্রকৃতির যত্ন নেওয়া এবং বাংলার ঐতিহ্য তাঁদের কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ঐতিহ্যের কথা ভাবতে গিয়ে তাঁরা সাধারণ সুতির কাপড় থেকে নজর ফেরান তাঁতের দিকে। সাধারণ সুতিতে বেশি নকশা করা সম্ভব হচ্ছিল না। টাই অ্যান্ড ডাই, বাটিক এবং বাঁধনি কাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে হচ্ছিল। তাই নকশার জন্য তাঁতের কাপড় নিয়ে কাজ করা শুরু করেন।
পুরনো থেকে নতুন
সেঁওতী জানালেন, বর্ধমানের একটি জায়গা থেকে বিভিন্ন ধরনের কাউন্টের খাদি সুতো তাঁরা নিয়ে এসে সেগুলোকে বিভিন্ন রঙে, বিভিন্ন প্যাটার্ন তোলানোর কাজে ব্যবহার করা শুরু করেছিলেন। তাঁদের তাঁতি রাখহরি দাস সুতোগুলো নিয়ে বুঝে নেন তাঁদের ব্র্যান্ড কী ধরনের প্রোডাক্ট চাইছে। তারপর হ্যান্ডলুমে সেটা বুনে দেন। সেই কাপড়েই সুমনরা ডিজাইনিং করেন, তারপর আর একজন দর্জি সেই নকশা থেকে পোশাক বানান। সেটা বানানোর পরে যে ছাঁটের কাপড় পড়ে থাকে, সেগুলো জুড়েও তাঁরা একটা নকশা ফুটিয়ে তোলেন। এভাবে আপসাইকেল (ফের ব্যবহার করার জন্য) করার প্রক্রিয়ায় তৈরি হয় অন্য পোশাক।
‘দর্জি শান্তিনিকেতন’-এর পাশাপাশি তাঁদের আর একটি শাখা ‘দর্জি আপসাইকেল’। এতে পুরো কাজটাই আপসাইকেল করা জিনিসপত্র দিয়ে করা হয়। তাঁদের কথায়, দর্জি শান্তিনিকেতন-এর বাতিল হওয়া সব কিছুই কাজে লাগানো হয় দর্জি আপসাইকেল-এ। সুমন বলেন, ‘কাপড়ের একটা সুতোও নষ্ট হোক, আমরা চাই না। যত্রতত্র সেসব ফেলে নোংরা হোক চারপাশ, সেটাও করি না কখনওই।’ সেঁওতীর মতে, ‘সুতোর পাক থেকে শুরু করে পোশাক তৈরির প্রক্রিয়া একটা জার্নির মতো। তাই এই যাত্রাপথের কোনও অংশ ফেলে দেওয়া যায় নাকি? তার জন্যই আপসাইকেল। পাশাপাশি রং ওঠা পুরনো জামাকাপড় সংগ্রহ করেও কাজ করছি।’ এ প্রসঙ্গে সুমনের সংযোজন, ‘বিদেশে এখন এটার চল হয়েছে খুবই। ধরুন আপনার নিজেরই কোনও পোশাক পুরনো ডিজাইনে আর পরতে ভালো লাগছে না। আপনি সেটা একটা আপসাইকেল স্টুডিওয় দিলেন, সেখানে আপনার মনমতো পরিবর্তন ঘটিয়ে পুরনোটি কাজে লাগিয়েই অন্য ধরনের পোশাক পেয়ে গেলেন।’ এই ধরনের পরিবশেবান্ধব পদক্ষেপে বিশ্বাসী দর্জি শান্তিনিকেতন-ও।
সবার জন্য পোশাক
তাঁদের ব্র্যান্ডের পোশাক ধীরে ধীরে সাড়া পেয়েছে ভালোই, জানালেন সুমন। লিঙ্গ-সাম্যের কথা মাথায় রেখে কাজ করেন তাঁরা। ছেলেদের জন্য বিশেষ জামা বা মেয়েদের জন্য আর এক রকম জামা, বা কিছু বিশেষ রং ছেলেদের জন্য আর কিছু রং মেয়েদের জন্য— ব্র্যান্ডে এমন বিভাজন রাখেননি তাঁরা। একই সমীকরণ আকৃতিগত দিকেও। সুমনের কথায়, ‘আমরা যা বানাই, সেই পোশাক ছেলে বা মেয়ে যে কেউ পরতে পারেন। ভারী চেহারা হোক বা পাতলা গড়ন, যিনি যেমনই হোন, পরুন আমাদের পোশাক।’ প্রথম দিকে অল্পবয়সিদের মধ্যে জনপ্রিয় হয় তাঁদের পোশাক। তারপর পরিধি বেড়েছে। দেশের বাইরে থেকেও এখন অর্ডার পাচ্ছেন। সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমেই সবটা হয়। ইনস্টাগ্রামে ব্র্যান্ডের নামে পেজ রয়েছে তাঁদের।