হঠাৎ নেওয়া সিদ্ধান্তে বিপদে পড়তে পারেন। চলচিত্র ও যাত্রা শিল্পী, পরিচালকদের শুভ দিন। ধনাগম হবে। ... বিশদ
ওড়িশার পট
মেদিনীপুরের মেয়ে সুস্মিতা মান্না পিংলার পটচিত্র খুব ছোটবেলা থেকে দেখে বড় হয়েছেন। তাই পটচিত্র নিয়ে কাজ করার আগ্রহ গোড়া থেকেই ছিল তাঁর। সেই ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে তাঁর সামনে খুলে যায় এক নতুন দিগন্ত, তা হল ওড়িশার পট। বাংলার পটচিত্র যেমন লোকগাথা বলে, ওড়িশার পট জানায় জগন্নাথদেবের মাহাত্ম্যগান। এভাবেই সুস্মিতা জেনেছিলেন, রঘুরাজপুরের কথা। যে গ্রামের আনাচেকানাচে এখনও পটুয়ারা অসাধারণ শিল্পকর্ম সৃষ্টি করছেন।
ইতিহাস
আজ থেকে প্রায় ২০০০ বছর আগে ওড়িশায় যখন গঙ্গোরাজাদের রাজত্ব, রঘুরাজপুর গ্রামের পটচিত্রকাররা পেয়েছিলেন রাজা নরসিংহ দেবের আনুকূল্য। রাজা অনন্তবর্মণ দেবের সময় জগন্নাথদেবের মন্দির প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু হয়। সেখান থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরেই ছিল রঘুরাজপুর গ্রাম। সেখানে ছিলেন সেইসব চিত্রকার, যাঁরা তৈরি করতেন জগন্নাথ, বলভদ্র আর সুভদ্রার প্রতিচ্ছবি— কারণ স্নানযাত্রার পর যখন তাঁরা জ্বরে আক্রান্ত হন, ১৫ দিন থাকেন ‘অনশর’ বা কোয়ারেন্টাইনে। তখন ভক্তরা তাঁদের দেখতে পান না, পূজা করতে পারেন না। সেই সময় মূর্তির বিকল্প হিসেবে রাখা থাকে এই পট।
বানানোর কৌশল
প্রথমে পুরনো সুতির শাড়ি পরপর রেখে দেওয়া হতো। মাঝে থাকত হলুদ বীজের গুঁড়োর প্রলেপ। অনেকটা আটা বা গমের মতো এই প্রলেপকে বলা হতো ‘নির্যাসকল্প’। নরম মাটির গুঁড়োও মেশানো হতো এই প্রক্রিয়ায়। বস্ত্রখণ্ডটিকে মোলায়েম করে তোলা হতো কাঠের ছোট গুঁড়ি কিংবা গোল পাথর ঘষে। এভাবে তৈরি হত ‘পট্ট’। বর্তমানে তসর, খাদি, রেশমের ওপর এমন চিত্র বানানো হয়। অতীতে তালপাতাও ব্যবহৃত হতো ক্যানভাস রূপে।
বিভিন্ন রং
সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপায়ে তৈরি হতো পটচিত্রের রং। শঙ্খচূর্ণ দিয়ে সাদা, হিঙ্গুল (পারদ ও গন্ধক মেশানো ঘন লাল পদার্থ) দিয়ে লাল, হরিতাল (পীতবর্ণ ধাতব পদার্থ) দিয়ে হলুদ, খণ্ডনীল পাথর দিয়ে আসমানি নীল, সবুজ পাথর থেকে হরিৎবর্ণ— এই পাঁচটি মূল রঞ্জনদ্রব্য নিয়ে হল পঞ্চতত্ত্ব। এই বর্ণসমারোহ বিভিন্ন চারিত্রিক প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যেমন, হাস্যরস অঙ্কন করা হয় শ্বেতবর্ণ দিয়ে, রুদ্ররূপ রক্তবর্ণ দিয়ে, বিস্ময় বা অদ্ভুতরস হরিদ্রা বা হলুদ দিয়ে। তেমনই কৃষ্ণের ছবি আঁকা হয় নীল রঙে আর রামচন্দ্র সবুজে। এভাবে পাঁচটি মূল রঙের অনবদ্য মিশ্রণে নারকেল খোলায় বানানো হয় আরও ১২০টি রং।
প্রেক্ষাপট
জগন্নাথদেব, বলরাম ও সুভদ্রার ছবি আঁকার পাশাপাশি রাধাকৃষ্ণের চালচিত্র, বৈষ্ণবগাথা, রামায়ণ, মহাভারত, শৈব, শাক্ত এবং সামাজিক জনজীবনের প্রতিচ্ছবিও ধরা পড়ে বিভিন্ন পটচিত্রে।
জগন্নাথকে বলা হয় শ্রীক্ষেত্র পতি, তাঁর দীর্ঘ অক্ষি দু’টি একাধারে সূর্য ও চন্দ্রের প্রতীক। এই ব্রহ্মাণ্ডের তিনি অধিপতি। তিনি ‘আনন্দী’, তাঁর শুরু নেই। তিনি ‘অনন্ত’, তাঁর শেষ বা সীমা নেই। সুস্মিতা এইসব পটচিত্র থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তাঁর ‘বুনন’ বুটিকে সাজিয়েছেন সংগ্রহ। তাঁর বানানো একটি ডুয়াল টোন পিঙ্ক পিওর সিল্ক শাড়িতে প্রেক্ষাপট হিসেবে এসেছে সৃষ্টি ও কন্দর্প কলস যেখানে আদিশক্তিরূপী মহামায়া দু’টি হস্তে ধারণ করে আছেন গণপতিকে, যিনি সৃষ্টির আদিরূপ। তাঁর তৈরি আর একটি কালো তসর শাড়ি (ছবিতে), সাজানো হয়েছে কৃষ্ণলীলার সখীবিহারের চিত্র দিয়ে। সখীদের অপূর্ব সেই সমারোহ আর রাঙা পদ্মের মিশেলে শাড়িটি অতুলনীয়। এছাড়াও আছে রক্তরাঙা একটি পিওর সিল্ক (ছবিতে) যার আঁচলে কৃষ্ণের গোবর্ধন পর্বত উত্থাপনের কাহিনি বর্ণনা করা হয়েছে। সঙ্গে তিনি কালেকশনে রেখেছেন খাদি কুর্তাও। তাতে শ্রীরাধিকার কেশসজ্জার প্রতিচ্ছবি। তসর দুপাট্টা বানিয়েছেন তিন নর্তকীর নৃত্যশৈলীর আঙ্গিকে। জ্যাকেট স্টাইলের ব্লাউজে আছে সোনালি রঙের ময়ূর এবং আর একটিতে শ্রীরাধিকার বনবিহারের চিত্র।