হঠাৎ নেওয়া সিদ্ধান্তে বিপদে পড়তে পারেন। চলচিত্র ও যাত্রা শিল্পী, পরিচালকদের শুভ দিন। ধনাগম হবে। ... বিশদ
দমদমের তরুণী প্রিয়তা বণিকের বাবার সোনার গয়নার দোকান রয়েছে। পারিবারিক ব্যবসা। ২০১৬ সালে কলেজ শেষ হওয়ার পর তাঁর বাবা বলেছিলেন, পরিবারের ব্যবসার কাজেই লেগে পড়তে। বাবার কথা মেনে শুরুও করেছিলেন প্রিয়তা। কিন্তু যে ধরনের নকশা নিয়ে সেখানে কাজ চলত, তার বাইরে গিয়ে নানারকম ডিজাইন করার চেষ্টা করতেন তিনি। তাঁর মাথায় সেসবই ঘুরত। কিন্তু তাতে কেউ গুরুত্ব দেয়নি। এদিকে দোকানের সেই চিরাচরিত ডিজাইন নিয়ে কাজ করতে ভালো লাগছিল না তাঁর। মন বসেনি কাজে। তখন থেকেই নিজের মতো করে কিছু করার ইচ্ছে ছিল। কাজে দিয়েছিল ছোটবেলার আঁকা শেখা। দোকানে বসে কাজ না
থাকলে টুকটাক পেন্সিল স্কেচে
করতেন গয়নার নকশা।
তিনি নিজে হ্যান্ডমেড জুয়েলারি পছন্দ করতেন। যখন সেই ধরনের সব জুয়েলারি কিনতেন, তখন সেগুলোর মধ্যে নানা উপাদান একটু এদিক-ওদিক করে দিতে বলতেন দোকানিকে। একসময় তাঁর মনে হল, এই কাজটাই নিজে হাতে করলে কেমন হয়? এইভাবেই হ্যান্ডমেড জুয়েলারি বানানোর উপাদান জোগাড় করে বানিয়ে ফেলেছিলেন গয়না। সেসব নিজে যখন পরে বেরতেন, অনেকেই জানতে চাইত, ‘কোথায় পেয়েছ? এত সুন্দর ডিজাইন।’ তাঁর বাবার দোকানে আসা অনেক ক্রেতা অনুরোধ করেন সেইরকম গয়না তৈরি করে দেওয়ার জন্য। তারপর বন্ধুবান্ধবও নিতে শুরু করেন। শুরু হয়ে যায় হ্যান্ডমেড জুয়েলারি তৈরির কাজ। ফেসবুক আর ইনস্টাগ্রামের মতো সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে ভালো সাড়া পেয়েছিলেন। একসময় অর্ডার এত আসছিল যে একা হাতে পুরোটা সামলাতে পারছিলেন না প্রিয়তা। এইরকম অবস্থায় ব্যবসাটা গুরুত্ব দিয়ে করার কথা ভাবেন তিনি। ২০১৯-এর গোড়া থেকে কোমর বেঁধে নেমে পড়েন। কাজ শুরু করেছিলেন মাত্র ১৭০০ টাকার পুঁজি নিয়ে।
কিছুই যায় না ফেলা
বেঁচে যাওয়া ইলেকট্রিক তার আর কাঠের টুকরো দিয়ে নেকপিস বানিয়েছেন প্রিয়তা, যেটি খুব জনপ্রিয় হয়। গাছ লাগানোর বার্তা দিয়ে তাঁর বানানো পাতা নেকলেসের দারুণ চাহিদা ছিল। তাতে তিনি ব্যবহার করেছিলেন ভাঙা বা ফেলে দেওয়া জিনিস, পেস্তার খোসা, জুট ইত্যাদি। এর সঙ্গে কাপড়ে গুজরাতি নকশায় সেলাই করে তিনি গলার বা কানের গয়না বানিয়ে দেন। এতে অবশ্য পরিশ্রম হয় যথেষ্ট। টানা একই ধরনের বেশ কয়েকটা পিস বানাতে বানাতে কোমর ধরে আসে। কিন্তু মনের আনন্দ এতটাই বেশি যে কষ্ট ফিকে হয়ে যায়। নিজের নামের ব্র্যান্ড ‘প্রিয়তা আর্ট ওয়ার্ক’-কে আরও বড় জায়গায় দেখতে চান তিনি। কাজ করতে করতে প্রশংসা পাচ্ছেন, এটাই তাঁর এগিয়ে যাওয়ার পথে অনুপ্রেরণা। কাজ শুরু করতে গিয়ে মাথায় ছিল একটু আলাদা রকমের কিছু করবেন। ফেলে দেওয়া সামগ্রী কাজে লাগানো যায় কীভাবে, ভাবনাচিন্তা করতেন তা নিয়েও। সেসব মিলিয়ে-মিশিয়ে ডিজাইন করে গয়না বানিয়ে ফেলেন তিনি। প্রিয়তার কথায়, ‘হয়তো রান্নাঘরে কাপ ভেঙে গিয়েছে, তার ভাঙা অংশটাকে অন্যভাবে কাজে লাগিয়ে এবং তার সঙ্গে আরও কিছু যোগ করে একটা লকেট বানিয়ে ফেললাম। গায়ে ঘষার ছোবড়া বা লুফা থেকেও বানিয়েছি গয়না। একবার নারকেল ছাড়িয়ে ফেলে দেওয়া অংশগুলো থেকে বানানোর কথা ভাবলাম। এভাবেই চলে আমার কাজ।’
প্রকৃতির পাশে
নারকেলের ছোবড়া থেকে কিছু করবেন জেনে তাঁর মা পরামর্শ দিয়েছিলেন, ‘এগুলো আগে রোদে শুকাতে হবে। দেখতে হবে যাতে পোকা না ধরে।’ তিনি সেটা রোদ্দুরে ফেলে রেখেছিলেন। পোকা ধরেনি দেখে কাজে হাত দেন। বানিয়ে ফেলেন পাখির বাসা নেকলেস। গাছ আর পাখির মাধ্যমে প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের যে আত্মিক যোগ গড়ে ওঠে, তা একটা বড় লকেটের মধ্যে দেখাতে চেয়েছিলেন। প্রিয়তা বলেন, ‘এত গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। পাখিরা বাসা বানানোর জায়গা পাচ্ছে না। তাই আমার মনে হল গাছেরই সামগ্রী থেকে পাখির বাসার মতো বানিয়ে যদি একটা বার্তা দেওয়া যায়। পশুপাখি আর গাছপালার প্রতি ভালোবাসা বোঝাতেই ক্রমশ আরও পরিবেশবান্ধব উপাদান দিয়ে আমি গয়না বানাতে শুরু করি। প্রকৃতির ক্ষতি হোক, চাই না। এটা যেন সকলে মনে রাখি।’ আজকাল নির্বিচারে বৃক্ষনিধনের ফলে পাখিরা সংকটে পড়ে। গাছের অভাবে বাসা বানানোর জায়গা পায় না তারা। ডিম নষ্ট হয়ে যায়। ওদের যন্ত্রণা প্রিয়তাকে ছুঁয়ে যেত। তাই লকেটে দেখালেন, একটা ছোট্ট পাখি বাসায় বসে ডিম দেখভাল করছে। বাসা তৈরি হল নারকেল ছোবড়া থেকে। আর সঙ্গে লাগল শুধু সুতো, কাপড় আর পাখি।
তিনি এমন নানা মোটিফ খোঁজেন প্রকৃতির কাছে। নানা ফুল পাতা দেখতে দেখতে একদিন তৈরি করে ফেলেন কাগজফুল নেকলেস। পথেঘাটে অনাদরে পড়ে থাকা কাগজফুলের রাশি চোখ টানত ছোটবেলা থেকে। বড় হয়ে তাঁর মনে হয়েছিল, এই চেনা ফুল দিয়ে নেকপিস বানালে কেমন হয়? লেগেছিল শুধু বোগেনভিলিয়া বা কাগজফুলের রঙের কাপড়, সুতো আর মাটি। ফুলের রেণু বানাতে ব্যবহার করেছিলেন মাটি। উপাদানগুলো শুনেই বুঝতে পারছেন এটি ওজনে কতটা হাল্কা! একইভাবে গোলাপগুচ্ছ কাপড়ে বানিয়ে নেকলেস করেছেন তিনি। দেখে মনে হবে যেন ছোট ছোট অসংখ্য গোলাপ একসঙ্গে রাখা। এটি হাতে বানাতে অনেকটাই সময় লাগে। আর একটি নেকপিসে মাল্টিপল কালারের বল দিয়ে প্রাণশক্তিকে ফেরাতে চেয়েছেন করোনাকালে। সাত রঙের কাপড়ের বল আর জুট দিয়ে সুতোয় বুনেছেন রামধনু নেকপিসটি। কাপড়ের বুননেই তৈরি করেছেন চাঁপা, পলাশ আর জবার মতো ফুল। নেকপিসগুলি সব ক’টিই নজরকাড়া আর হাল্কা।
পাথরে নকশা
বেশ কয়েক রকমের পাথরকুচি সংগ্রহ করে তা দিয়ে বানিয়েছেন বোহো নেকলেস। তাতে যোগ করেছেন জুট আর কাঠের গুঁড়ো। এধরনের গয়না সাধারণ সুতির বা লিনেন শাড়ি এমনকী কুর্তা সবের সঙ্গেই যায়। কিন্তু পাশাপাশি গর্জিয়াস লুকের জন্যও তিনি পরিবেশবান্ধব সামগ্রী দিয়ে গয়না করেছেন। তাঁর কথায়, ‘সবসময় গর্জিয়াস হলেই যে তাতে মেটাল রাখতে হবে, তা নয়।’ গোল্ডেন সুতোয় ফুল এমব্রয়ডারি করে তাতে থ্রি ডি এফেক্ট আনার চেষ্টা করেছেন তিনি। সেই ফুলগুলো সোনালি দড়ি দিয়ে বুনে দিয়েছেন। এটাও পুরোটা কালো কাপড়ের উপর। কালো গোল্ডেনে কনট্রাস্ট হয়েছে দুর্দান্ত। এটিও প্রশংসিত হয়েছে। বিয়েবাড়ির সাজে যাতে এধরনের গয়না রাখা যায়, এবার সে চেষ্টাই করছেন প্রিয়তা। পাশাপাশি নীল রঙের পাথর জোগাড় করে বানিয়েছেন চওড়া একটি নেকপিস। ঘর সাজাতে বা অ্যাকোয়ারিয়ামে এধরনের পাথর ব্যবহার করা হয়। এইসব পাথর একসঙ্গে করে আঠা দিয়ে জুড়েছেন। সঙ্গে কাপড়। মাঝে রেখেছেন শুধু একটা লকেট।
লকডাউনে সময় কাটছিল না। তাই একদিন বানিয়ে ফেলেন কাঁথাস্টিচের গয়না। প্রথমে কাপড়ে এঁকে স্টিচ শুরু করেন। কাজটি সহজ নয়। প্রথমে কিছুতেই এগোচ্ছিল না। বেশ কয়েকটা কাপড় নষ্ট হয়, জানালেন তিনি। তবে তখন হাতে অঢেল সময় ছিল। তাই চেষ্টা ছাড়েননি। একসময় জবার মোটিফ সহ পুরো গলাজোড়া নেকপিসটি চোকারের মতো নিখুঁত বানিয়ে ফেলেন। সুতোয় দিয়েছেন জিরি ফোঁড়।
তবে এধরনের গয়না বানানোর জন্য তাঁকে সমালোচনা শুনতে হয় না, এমন নয়। কেউ হয়তো বলেছেন গয়নাগুলো বেশি জবরজং আর হেভি। কারও মনে হয়েছে অতি সূক্ষ্ম। আরও সিম্পল ডিজাইন করেন না কেন, প্রশ্ন শুনেছেন। প্রিয়তা তাঁদের বলেন, ‘আমার গয়না গতানুগতিক নয়। এটাই আমার পরিচয়। যাঁরা বুঝবেন, তাঁরা ঠিকই বেছে নেবেন।’
যোগাযোগ: ৯০৫১৬৬৪০৩৪
গ্রাফিক্স : সোমনাথ পাল