হঠাৎ নেওয়া সিদ্ধান্তে বিপদে পড়তে পারেন। চলচিত্র ও যাত্রা শিল্পী, পরিচালকদের শুভ দিন। ধনাগম হবে। ... বিশদ
এই সামনে ছিল হুকোমুখো হ্যাংলা বা কুমড়োপটাশ। তারপর কল্পনার রাজ্যে ঘুরতে ঘুরতে কখন যেন ঢুকে পড়ল অ্যালিসের অদ্ভুত কাণ্ডকারখানা। নিশ্চিন্ত, নির্ভাবনার শৈশব তো এমনি করেই রোজ সেজে ওঠে। ছোটবেলার সেই মধুর স্মৃতি সঙ্গে থেকে যায় আজীবন। ‘ঘুড়ি’ ব্র্যান্ডের স্রষ্টা, এ শহরের ডিজাইনার দেবযানী বসু রায়চৌধুরীর মনেও সুকুমার রায় থেকে শুরু করে লুইস ক্যারলের চরিত্রগুলো রয়ে গিয়েছিল সেভাবেই। তাদের ব্যবহার করে দেবযানী এনেছেন অভিনবত্ব।
অ্যালিস কল্পনা
দেবযানীর কথায়, ‘ঘুড়ি যখন শুরু করি, মাথায় এসেছিল ছোটবেলায় পড়া সব বই। কখনও ছড়া, কখনও বা গল্প, অনুপ্রাণিত হয়েছি সব কিছু থেকেই। এরপর সেই চরিত্রগুলোকে নিয়ে কখনও প্রিন্টে, কখনও আবার জামদানিতে, কাজ করেছি দু’ভাবেই।’ ‘অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড’ দেবযানীর খুব প্রিয় বই। তাঁর মতে, ‘আপাতদৃষ্টিতে এটিকে বাচ্চাদের বই-ই মনে হয়। কিন্তু যত বড় হয়েছি, বুঝেছি অ্যালিসের কল্পনার দুনিয়া বড়দের জন্যও কতটা প্রাসঙ্গিক। তাই এই বইটিকে নিয়ে নানাভাবে ভাবা যায়। অ্যালিস নিয়ে শাড়ি ডিজাইনের সময় মনে এসেছে সেই ভাবনা। অ্যালিস যখন খরগোশের গর্তে ঢোকে, খরগোশ তাকে নিয়ে যায় আজব দুনিয়ায়। সঙ্গে বিশেষ চরিত্র বেড়াল। এইগুলোই মুখ্য আমার শাড়িতে। প্রথমে জামদানিতে এই কাজ করার পর তা দেখতে ভালো হয়েছিল।’ তাই অ্যালিস-খরগোশ-বেড়াল এই তিনটি মোটিফকে তিনি জামদানির পাড় বরাবর তুলে এনেছেন। অ্যালিসের গল্পে বাকি রইল গুরুত্বপূর্ণ তাসের মোটিফ। তাসের মধ্যে হার্টস, স্পেডস, ডায়মন্ড ইত্যাদি সব মোটিফ অল্টারনেট করে ‘অ্যালিস শাড়ির’ বডি-তে একটা রো ধরে কালার ভেরিয়েশন রেখেছেন তিনি। এই শাড়িটিকে সকলের সামনে কীভাবে তুলে ধরা হবে, সেই ব্যাপারে দেবযানীর সঙ্গে ইন্টার্ন হিসেবে কাজ করেছিলেন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ফ্যাশন টেকনোলজি (এনআইএফটি)-র তমালিকা ভৌমিক, তাঁর শিল্প নির্দেশনার মাধ্যমে। শাড়ির ছবি এমন অ্যাঙ্গেলে তোলা হয়েছিল যা দেখে মনে হয়েছিল অ্যালিস যেন পড়ে যাচ্ছে র্যাবিট গর্তে! গল্পের মুহূর্ত জীবন্ত হয়েছিল এভাবেই। অ্যালিসের সেই শাড়িটি দেবযানীর কাছে তাই খুব প্রিয়।
জনপ্রিয় ফ্রিডা
অ্যালিসের পাশাপাশি তিনি কাজ করেছেন কিছু ভিন্নধর্মী চরিত্র নিয়েও। তার মধ্যে রয়েছে মেক্সিকান পেন্টার ফ্রিডা কালো-র মুখও। ফ্রিডার করা সেলফ পোর্ট্রেটের সৌজন্যে তাঁর মুখটি ইদানীং ফ্যাশন দুনিয়ায় ভীষণ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। দেবযানীও তাঁর শাড়িতে এনেছেন ফ্রিডাকে। তিনি বলেন, ‘ক্লাস টুয়েলভ পাশের পর থেকেই আর্ট নিয়ে আমার উৎসাহ বেড়েছিল। সেই সময় থেকে পড়াশোনার জন্য ব্রিটিশ কাউন্সিল যেতাম। তখন পড়ার বইয়ের বাইরে নানা বই টানত আমায়। সেভাবেই ফ্রিডার প্রসঙ্গেও জেনেছি।’ তবে ফ্রিডাকে যেহেতু বহু ডিজাইনার নানাভাবে নিজেদের সৃষ্টিতে নিয়ে এসেছেন, তাই এই চরিত্র নিয়ে কাজের ক্ষেত্রে স্বতন্ত্রতা বজায় রাখা চ্যালেঞ্জিং ছিল দেবযানীর কাছে। তিনি বলেন, ‘অন্য চোখে দেখতে চেয়েছিলাম ফ্রিডাকে। আমাদের রাজ্যে তাঁতিরা জামদানিতে ফুল, আঙুরলতার মতো ট্র্যাডিশনাল মোটিফেই অভ্যস্ত। ওই বুননে ফিগার তৈরি করার কাজটি সব তাঁতি পেরে ওঠেন না। তাঁদের আলাদা করে এর জন্য প্রশিক্ষণ দিতে হয়। তবে বেশিরভাগ তাঁতিই জামদানিতে ফিগার তুলতে আগ্রহী নন। আমি ফ্রিডাকেও জামদানিতে তুলে ধরতে চেয়েছিলাম। প্রিন্টেও আমি ফিগারের উপর কাজ করতাম বেশি। শেষ পর্যন্ত জামদানিতে ফিগার করানোর জন্য একজন ভালো উইভারকে পেয়েছিলাম যিনি কাজটি করতে উৎসাহ দেখান। ছবিতে কোনও একটা গল্প সুন্দর করে সাজিয়ে এঁকে যদি তাঁকে বুঝিয়ে দিই, তিনি ভালোভাবেই সেটা তুলে আনতে পারেন। সেই বোঝাপড়া তাঁর সঙ্গে আমার হয়ে গিয়েছে। ফ্রিডা শাড়ির আঁচলে বড় করে সেই গল্পটা এনেছি। এই কাজটি করার সময় ওঁকে শুধু স্কেচ করে দিইনি। কালারড ছবিতে যেমন লাইট অ্যান্ড ডার্ক শেডস থাকে, আঁকা ছবিতেও সেটা করেছিলাম। উইভারও সেটা আনতে পেরেছিলেন কাজে। দূর থেকে শাড়িটা দেখলে এখনও মনে হয় হ্যান্ড পেন্টেড বা প্রিন্টেড, এতটাই নিপুণ কাজ!’ কিন্তু তিনি জানালেন, প্রথমবার কাজটা শেষ হওয়ার পরে মনে হয়েছিল তাতে যেন প্রাণ নেই। দেবযানী জানালেন, ‘পরে ওই কাজটা ভালো করে খুঁটিয়ে দেখার পরে বোঝা গেল, আমার আঁকায় ফ্রিডার চোখে কাজল ছিল, যেটা বুননে তোলা হয়নি। এই ধরনের ফিগারে চোখ খুব গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। তাই পুরো লুকটা যাতে জীবন্ত হয়, তার জন্য মুখের কাজে ত্রুটি রাখলে চলবে না। পরবর্তীকালে সেদিকে তাই সবসময় খেয়াল রাখি।’
আবোল তাবোল
সত্যজিৎ রায়ের জন্মশতবর্ষে তাঁর সৃষ্ট বিভিন্ন চরিত্র নিয়ে কাজ করছেন অনেকেই। দেবযানী সেই কাজ শুরু করেছিলেন অনেক আগে। তা ছাড়াও তিনি অনুপ্রেরণা খুঁজে পেয়েছেন সুকুমার রায়ের চরিত্রদের কাছ থেকে। এর আগে সন্দীপ রায়ের সঙ্গে কথা বলে তিনি উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর গুপি গাইন বাঘা বাইন নিয়ে সিল্কে জামদানিতে কাজ করিয়েছেন। পরবর্তীকালে সুকুমার রায়ের সৃষ্টি নিয়েও তিনি কথা বলেন সন্দীপবাবুর সঙ্গে। আবোল তাবোল নিয়ে সেভাবে কাজ হয়নি দেখে দেবযানী সেগুলি করতে চেয়েছিলেন। তারপর সেই বইয়ের থেকে চরিত্র ড্রয়িং করে তাতে কালার ম্যাচ করানোর কাজ হয়, কারণ ওই চরিত্রগুলো সব সাদা-কালোতেই পরিচিত, জানালেন এই ডিজাইনার।
ভ্যান গঘ
তাঁর সব ক’টি কাজের মধ্যে ভ্যান গঘের পেন্টিং-এ ‘স্টারি নাইট’-এর বুনন খুবই কঠিন এবং কষ্টসাধ্য কাজ, মনে করেন দেবযানী। কারণ এতে প্রচুর সুতোর কাজ থাকে, বলছিলেন তিনি। প্রিন্টে এই কাজ করেননি। এই ছবিতে এত রঙের খেলা আছে যে স্কিন প্রিন্টে সেটা ঠিকভাবে ফুটত না এবং সে কাজ যথেষ্ট সময়সাপেক্ষও হতো। কালজয়ী ওই শিল্পীর ছবিতে যে যে রং ব্যবহৃত হয়েছে, সেই সব রং তিনি স্কেচে ব্যবহার করেছিলেন। তবে কোনও কোনও ক্ষেত্রে রঙের বদলও ঘটিয়েছেন বুননের স্বার্থে। কারণ পেন্টিংয়ে যে রং উজ্জ্বলভাবে ফুটে ওঠে, তা সবসময় বুননে একই প্রতিচ্ছবি তৈরি করতে পারে না। ভ্যান গঘের সৃষ্টি এই শাড়ির আঁচলের বুননে তুলে আনা হয়েছে। তিনি বললেন, ‘ছবির সুন্দর ডিসপ্লে-র জন্যই এই শাড়ির আঁচলটি কিছুটা বড়। সাধারণত শাড়ির আঁচল থাকে এক মিটার। এই শাড়িতে সেটা আছে দেড় মিটার। পুরোটাই রেশমের উপরে। ছবিটা তাই দেখলে মনে হবে যেন ফ্লোটিং। বাকি শাড়িটা মটকা সিল্কে তৈরি এবং প্লেন বডি রাখা হয়েছে যাতে আঁচলটা চোখে পড়ে শুধুমাত্র। এই আঁচল বুনতে সময় লেগে যায় সাড়ে তিন মাস।’ দেবযানী জানালেন এই শাড়িতে অন্তত সাড়ে তিনশো রকম রঙের সুতো ব্যবহার করা হয়েছে! যা শুনে বোঝাই যাচ্ছে এটা কতটা কঠিন কাজ।
এসবের পাশাপাশি অ্যানিমাল মোটিফ নিয়েও কাজ করেন এই ডিজাইনার। এমনিতে প্রথাগত ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ের পড়াশোনা তিনি আগে করেননি। আগ্রহ থেকেই এসেছিলেন এই কাজে। এখন লকডাউনের সময়টা কাজে লাগিয়ে অনলাইনে করছেন টেক্সটাইল ডিজাইনের কাজ। এত দিন এই ধরনের কোর্সে যে হাতেকলমে কাজটা হয়, সেটাই তিনি করে এসেছেন তাঁতিদের সঙ্গে। এখন পড়ছেন তত্ত্বগত দিকটি। এই পড়াশোনার ফলে প্যাটার্ন ডিজাইনিংও নিজে করতে পারছেন দেবযানী।
গ্রাফিক্স : সোমনাথ পাল