দীর্ঘদিনের পরিশ্রমের সুফল আশা করতে পারেন। শেয়ার বা ফাটকায় চিন্তা করে বিনিয়োগ করুন। ব্যবসায় ... বিশদ
প্রথম প্রশ্ন হল, দলের বিরুদ্ধে অজিত পাওয়ারের এই অভ্যুত্থানের কারণটা কী? উত্তরটা জলের মতো পরিষ্কার। তাঁর বিরুদ্ধে সেচ দুর্নীতির অভিযোগ এবং মহারাষ্ট্র স্টেট কোঅপারেটিভ ব্যাঙ্ক কেলেঙ্কারিতে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের চার্জশিট। সেই চার্জশিটে শারদ পাওয়ারের নামও রয়েছে। অজিত পাওয়ার অবশ্য নিজেরটাই দেখলেন। সেপ্টেম্বর মাসে বিধায়ক পদে ইস্তফা দিয়ে শারদ পাওয়ারের জন্য কাঁদুনি গেয়েছিলেন, ‘এই বয়সে আমার জন্য ওঁকে এত অপদস্থ হতে হল! মানতে পারছি না।’ শনিবার ভোরে শপথ নেওয়ার সময় অবশ্য তাঁর আর কাকার কথা মনে পড়ল না। এর অবশ্য আর একটা কারণ রয়েছে। উত্তরাধিকার। শারদ পাওয়ারের পর দলের সুপ্রিম কমান্ড কার হাতে যাবে? দীর্ঘদিনের পোড় খাওয়া রাজনীতিক অজিত ধরেই নিয়েছিলেন, তিনিই দলের দু’নম্বর ব্যক্তি। এবং এক নম্বর হওয়াটা সময়ের অপেক্ষা। কিন্তু নির্বাচনী রাজনীতিতে শারদ-কন্যা সুপ্রিয়া সুলের উত্থান এবং অবশ্যই তৃতীয় প্রজন্ম অর্থাৎ রোহিত পাওয়ারের ‘বেড়ে ওঠা’টা তাঁর কাছে অশনিসঙ্কেত হয়ে দাঁড়িয়েছে। অজিত পাওয়ার বুঝে গিয়েছেন, বোধহয় তাঁকে দু’নম্বর হয়েই থেকে যেতে হবে। ইগো এবং নিরাপত্তাহীনতার জাঁতাকলে পিষে যদি তিনি এমন কাজ করে থাকেন, তাহলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।
তার উপর তিনি সাফ বুঝে গিয়েছিলেন, দুর্নীতি মামলায় তাঁর বাঁচার আশা খুব একটা নেই। সরকার যদি বিজেপির হয়, তাহলে শাসক দল অবশ্যই তাঁর বিরুদ্ধে তেড়েফুঁড়ে নামবে। এটাও ‘অভ্যুত্থানে’র আর একটা কারণ হতেই পারে। প্রতিদানে? ইতিমধ্যেই সেচ দুর্নীতির ন’টি ফাইল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। দাবি, তার মধ্যে একটিতেও অজিত পাওয়ার নেই। তাঁর অভিযোগের ফাইলগুলি এখনও সচল রয়েছে। কিন্তু আগে যে ঘোষণা করা হয়েছিল, সেচ দুর্নীতির ১১টি মামলাতেই অজিতের নাম রয়েছে? সে সব এখন কোথায় গেল? তার মানে কি এরপর ‘আনুগত্যে’র উপহার মিলবে? অর্থাৎ, এই দু’টি থেকেও রেহাই পেয়ে যাবেন অজিত?
বরং দুর্নীতির অভিযোগের বিরুদ্ধে ‘হিমশীতল’ মানসিকতা দেখিয়েছিলেন শারদ পাওয়ার। প্রথমে দাবি করেছিলেন, ব্যাঙ্ক কেলেঙ্কারিতে তাঁর নাম জড়ানোটা মোটেও আইনসঙ্গত নয়। কারণ, তিনি কোনওদিনই ব্যাঙ্কের বোর্ড অব ডিরেক্টরদের একজন ছিলেন না। তারপরও যখন ইডি বিষয়টা গা করল না, পাওয়ার বললেন ‘আমি ইডির দপ্তরে গিয়ে হাজিরা দেব’। ততদিনে রাজ্যে নির্বাচনী আচরণবিধি চালু হয়ে গিয়েছে। শারদ পাওয়ার যদি ব্যাপারটাকে ইস্যু করে ইডি দপ্তরে যান, আইন-শৃঙ্খলাজনিত সমস্যা হতে পারে। তাই ইডি আধিকারিকরা বাড়ি গিয়ে শারদ পাওয়ারের সঙ্গে দেখা করলেন এবং অনুরোধ করলেন, এমন কিছু করবেন না। ভোট মিটলে কথা বলা যাবে। এখানেই শারদ পাওয়ারের মুন্সিয়ানা। ভোটের মুখে চূড়ান্ত নেগেটিভ একটা প্রচার পর্যন্ত ইতিবাচক মোড়কে মুড়ে দিতে পারেন তিনি। এটা অভিজ্ঞতার ফসল। আর সেই কারণেই তিনি ‘মারাঠা স্ট্রংম্যান’। আর সেই স্ট্রংম্যানের আজ অগ্নিপরীক্ষা।
কেন অগ্নিপরীক্ষা? প্রথমত, ‘মুখ্যমন্ত্রী’ দেবেন্দ্র ফড়নবিশ দাঁড়িয়েছেন অজিত পাওয়ারের পাশে। কোন অজিত পাওয়ার? যাঁর নামে এই সেদিনও উঠতে বসতে গাল পাড়তেন তিনি। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর প্রথম আক্রমণই ছিল তাঁর কংগ্রেস-এনসিপির বিরুদ্ধে। ২০১৩ সালে ফড়নবিশ ট্যুইট করেছিলেন, ‘আদর্শ কেলেঙ্কারির রিপোর্ট বেরিয়েছে। কংগ্রেস এবং এনসিপির দুর্নীতির মুখোশটা বেরিয়ে পড়েছে। বিজেপি একজনকেও ছাড়বে না।’ পরের বছর... ‘কংগ্রেস-এনসিপি শুধুই কৃষকদের কষ্ট দিতে পারে’, কিংবা ‘কংগ্রেস-এনসিপি একে অপরের কেলেঙ্কারি ঢাকা দিতেই ব্যস্ত’... একের পর এক আক্রমণ। এমনকী সরকারে আসার পরই তিনি অজিত পাওয়ারের বিরুদ্ধে সেচ দুর্নীতির অভিযোগে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেই অজিত পাওয়ারই নাকি উপ মুখ্যমন্ত্রী? হজম করা সত্যিই কঠিন। তাও করতেই হচ্ছে। অমিত শাহের চালে। তাহলে এটাই ছিল কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্ল্যান বি? ভূপেন্দর যাদবকে কাজে লাগিয়ে অজিত পাওয়ারকে হাত করা। তারপর এনসিপির বিধায়কদের হাইজ্যাক। তবে সেটা কি সত্যিই হয়েছে? এই প্রশ্ন তুলতেই হচ্ছে। কারণ, উল্টোদিকে শারদ পাওয়ার। রাজনীতির দুই চাণক্যের লড়াই মহারাষ্ট্রে। বিধানসভা নির্বাচনে ৫৪টি আসনে জিতেছে এনসিপি। যদি এই সংখ্যার পুরোটাই বিজেপির দিকে চলে যায়, তাহলে বিজেপির শক্তি হবে ১৫৯। হাসতে হাসতে ম্যাজিক ফিগার ১৪৫ পার করে যাবে বিজেপি জোট। বিজেপি অবশ্য দাবি করছে, তাদের কাছে ১৭০ জন বিধায়কের সমর্থন রয়েছে। অজিত পাওয়ারের দাবি সত্যি হলে বিজেপির জোট সরকার সত্যিই ‘স্থিতিশীল’। অজিত পাওয়ার রীতিমতো ঘোষণা করে রেখেছেন, পার্টি তিনি ছাড়েননি এবং শারদ পাওয়ারই তাঁর একমাত্র নেতা। তাঁর কাকাবাবুর উল্টো দাবি সত্ত্বেও। সেই কাকাবাবু কী বলছেন? তাঁর বক্তব্য, এনসিপির ৫২ জন বিধায়ক রয়েছেন কংগ্রেস ও শিবসেনার জোটের সমর্থনে। মোট সংখ্যা ১৬২। কোনটা সত্যি? এক্ষেত্রে পাল্লা কিছুটা ভারী বিরোধী জোটের দিকে। কেন? কারণ, রবিবার সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার তাদের একটাই উদ্দেশ্য ও আর্জি ছিল—২৪ ঘণ্টার মধ্যে বিধানসভায় শক্তিপরীক্ষা চাই। যে বা যারা এই দাবি করছে, ধরে নেওয়া যেতে পারে, তাদের কাছে সংখ্যা আছে। তাই তারা তাড়াহুড়ো করছে। শুধু তাই নয়, সোমবার রাতে ১৬২ জন বিধায়ককে জনসমক্ষে এনে তারা দেখিয়েও দিয়েছে। উল্টোদিকে বিজেপি দাবি করেছিল, দু’-তিনদিন সময় লাগবে। বিরোধীরা সঙ্গে সঙ্গে একটা বাঁকা হাসি দিয়েছিল... তার মানে কি ঘোড়া কেনাবেচার জন্য আরও একটু সময় চেয়ে নিচ্ছে তারা?
সে যাই হোক, কিছুটা সময় বিজেপি পেয়েই গিয়েছে। কারণ, সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে, আজ, মঙ্গলবার মহারাষ্ট্র সংক্রান্ত রায়দান হবে। অর্থাৎ আজ যদি শক্তিপরীক্ষা হয়, তাহলে বোঝা যাবে শেষ বাজি কে মারল। যদিও তাতে বিজেপি খুব একটা সুবিধা করতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। কারণ, শারদ পাওয়ার সবদিক মোটামুটি বেঁধে ফেলেছেন বলেই সাদা চোখে অন্তত দেখা যাচ্ছে। যে বিধায়কদের হাইজ্যাক করে বিজেপি নিয়ে গিয়েছিল, তাঁদেরও উদ্ধার করে ফেলেছেন তিনি। সেই বিধায়কদের কেউ কেউ তো ফিরে এসে যেন হাঁফ ছাড়ছেন। বলছেন, এমন অবস্থায় পড়ে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।
শারদ পাওয়ার আসলে পাবলিকের পালসটা সত্যিই বোঝেন। পাবলিকের সামনে তাঁর উচ্চতার একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব যদি ভুল স্বীকার করেন, তার প্রভাবটা কোন জায়গায় পৌঁছয়? উত্তরটা ভোটযন্ত্রে। বেশিদিনের কথা নয়। পুনের একটি জনসভায় বলেছিলেন, ‘আমাকে ক্ষমা করুন। যাঁকে আপনাদের প্রতিনিধি হিসেবে নিয়ে এসেছিলাম, তিনি আপনাদের ভালোবাসাকে মর্যাদা দেননি। আমাকে ভুল শুধরে নেওয়ার আর একটা সুযোগ দিন।’ কী সেই ভুল? গত লোকসভা ভোটে সাতারা কেন্দ্রে এনসিপি প্রার্থী ছিলেন উদয়নরাজে ভোঁসলে। ছত্রপতি শিবাজির বংশধর। যুগের পর যুগ সাতারা আসনটি শিবাজির উত্তরসূরিদের জন্যই অলিখিতভাবে নির্ধারণ করা রয়েছে। লোকসভা ভোটে জিতে এনসিপি ছেড়ে বিজেপিতে চলে গিয়েছিলেন ভোঁসলে। দলত্যাগ বিরোধী আইনের প্যাঁচে পড়ে সাতারা আসনটিতে উপনির্বাচন করায় কমিশন। সেখানে বিজেপির ভোঁসলের বিরুদ্ধে প্রার্থী হিসেবে শ্রীনিবাস পাতিলকে দাঁড় করান পাওয়ার। শিবাজির বংশধর কিন্তু আর জিততে পারেননি!
তাই আজ সবচেয়ে বড় প্রশ্নটাই হল, পাওয়ার নিজে কি তাঁর ভাইপোর পাশে রয়েছেন? ১৬২ জন এমএলএকে দিয়ে প্যারেড করানোর পরও এই প্রশ্নটা বাতাসে ঘুরছে। কারণ, নামটা শারদ পাওয়ার। কিন্তু যদি অমিত শাহ তাঁকে ম্যানেজ করতে অসফল হয়ে থাকেন, তাহলে এবার বিজেপির মুখ পুড়তে চলেছে। অর্থাৎ আবার কর্ণাটকের পুনরাবৃত্তি।
রাজনীতির যে দাবাখেলায় শারদ পাওয়ারের হাতে ঘুঁটি থাকে, তাতে কিস্তিমাতটাও তিনিই করতে পছন্দ করেন। এতকাল করেও এসেছেন। মারাঠা স্ট্রংম্যান উপাধিটা এই শেষ বয়সে এসে অন্তত তিনি আর হারাতে চাইবেন না। আর পাল্টা দাপটে তাঁকে সত্যিকারের টক্কর দেওয়ার মতো যিনি ছিলেন, তিনি আজ আর নেই। বেঁচে থাকলেও অবশেষে আজ হয়তো হাত মেলাতেন পুরনো বন্ধুর সঙ্গে। কে তিনি? বালাসাহেব থ্যাকারে।