দীর্ঘদিনের পরিশ্রমের সুফল আশা করতে পারেন। শেয়ার বা ফাটকায় চিন্তা করে বিনিয়োগ করুন। ব্যবসায় ... বিশদ
প্রায় কোনও কারণ ছাড়াই পশ্চিমবঙ্গেও এক অভূতপূর্ব রাজনৈতিক সঙ্কট তৈরির চেষ্টা চলছে। গত প্রায় দু’মাস ধরে ধীরে ধীরে তার বীজ বোনার কাজ চলছে অত্যন্ত সন্তর্পণে। রাজভবনের আড়াল থেকে সাংবিধানিক অধিকার রক্ষার দোহাই দিয়ে ক্রমাগত এরাজ্যের বিপুল গরিষ্ঠতায় নির্বাচিত সরকারকে বিব্রত করাই মহামান্য মহামহিমের একমাত্র
উদ্দেশ্য কি না তা বলা কঠিন। কিন্তু, রাজ্য পরিচালনার দুই স্তম্ভ রাজভবন ও নবান্নের মধ্যে এত নিম্নরুচির চাপান-উতোর চলতে থাকলে তা সামগ্রিকভাবে কারুর ভাবমূর্তির পক্ষেই ভালো নয়। গত কয়েকদিনে রাজ্যপাল বনাম রাজ্যের সেই বিরোধ তথা
ইটের বদলে পাটকেল ছোঁড়া প্রায় রকের ঝগড়ায় পরিণত হয়েছে।
এমনিতে নতুন সরকারকে শপথ নেওয়ানো ছাড়া রাজভবনের আর তেমন কাজ নেই। কার্যত রাজভবন ও রাষ্ট্রপতি ভবন ব্রিটিশ শাসনেরই ফেলে যাওয়া উত্তরাধিকার ছাড়া আর কিছুই নয়। এর আদৌ
কোনও প্রয়োজনীয়তা আছে কি না, তা নিয়েও বিতর্ক কিছু কম হয়নি। তবে রাষ্ট্রপতিকে এখনও ভোটে জিতে আসতে হয়, আর পছন্দের রাজ্যপালকে নিয়োগ করে কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক। অর্থাৎ আজকের বিজেপি সরকারই রাজ্যপালের প্রধান নিয়ন্ত্রণ কর্তা। সেই দিক দিয়ে কেন্দ্র ও রাজ্যে একে অপরের বিরোধী দল ক্ষমতায় থাকলে কী হয়, মহামান্য রাজ্যপাল
তাই করে দেখাচ্ছেন।
শপথ নেওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই যাদবপুরে গণ্ডগোলের রাতে জনৈক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী আটকে পড়ায় নজিরবিহীনভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে মহামান্য রাজ্যপালের পদার্পণ দিয়েই এই সংঘাতের শুরু। তারপর ধীরে ধীরে উত্তাপ বাড়ছেই। যুযুধান দু’পক্ষের টানাপোড়েন কমার কোনও লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। এমনিতে এধরনের আইন-শৃঙ্খলা-জনিত সমস্যায় রাজ্যপালের সক্রিয় হস্তক্ষেপ ও লোকলস্কর নিয়ে নিজেই উপস্থিত হওয়া কতটা সংবিধানসম্মত তা নিঃসন্দেহে তর্কের বিষয়। ধর্মতলায় বোমা ফাটলে মহামান্য রাজ্যপাল অকুস্থলে হাজির হয়েছেন, এমন কথা যেমন আগে কেউ শুনেছেন বলে জানা নেই, তেমনি যাদবপুরেও হাঙ্গামা-গণ্ডগোল অতীতে বড় কম হয়নি। রাতের পর রাত উপাচার্যসহ বহু পদাধিকারী আটকে থেকেছেন। দীর্ঘ আলোচনা চলেছে, বাইরে থেকে পুলিস পর্যন্ত ডাকতে
হয়েছে। কিন্তু, মহামান্য কোনও ‘আচার্য’ রাজ্যপালই গণ্ডগোল চলাকালীন সেখানে উপস্থিত হয়েছেন
এমন কথা শোনা যায়নি।
কারণ, শৃঙ্খলারক্ষা ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা একান্তভাবেই নির্বাচিত রাজ্য সরকারের কাজ। এ কাজে হস্তক্ষেপ করা মোটেই সমীচীন নয়। সংবিধানে সে-কথা বলাও নেই। আর, আচার্য হিসেবে
যখন তিনি উপস্থিত হলেনই তখন সেই রাতেই যাদবপুরের গেটে একদল বহিরাগতের লাঠিসোঁটা নিয়ে তাণ্ডবে কেন মুখ খুললেন না, সেই প্রশ্নও কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই উঠছে।
ওই একটি ঘটনাই নয়। তারপর থেকে রাজ্য ও রাজ্যপাল, দু’তরফের নাছোড় টানাপোড়েন কিন্তু বাড়ছেই। যেন ১৮০ ডিগ্রি তফাতে থেকে প্রশাসনের দুটি বিপরীত মেরু একে অপরের বিরুদ্ধে ক্রমাগত তোপ দাগছে। যার জেরে প্রতিনিয়ত রাজভবন আর নবান্ন একে অপরের সঙ্গে সহযোগিতা করা ছেড়ে সমালোচনা ও নিন্দায় সময় ব্যয় করছে। কিন্তু এটা হওয়া কি যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় অভিপ্রেত? এমনকী নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী অথবা তাঁর মন্ত্রিসভার কোনও সদস্য ঠিক করছেন না ভুল করছেন, কোথাও কোনও গাফিলতি আছে কি না সেই মূল্যায়নেরও দায়িত্ব কি সংবিধান রাজভবনকে দিয়েছে? সরকার সামগ্রিকভাবে সফল না ব্যর্থ, সে তো পাঁচবছর অন্তর রাজ্যের মানুষই ভোটাধিকার প্রয়োগ করে তার রায়ে জানিয়ে দেবে।
পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে তবে অন্যথা হওয়ার আসল কারণটা কী? আসল উদ্দেশ্য কী? আর কোনও রাজ্যে তো মহামান্য রাজ্যপালের এমন ভূমিকা দেখা যাচ্ছে না। সংবিধান বিপন্ন হলে, পদে পদে তা লঙ্ঘিত হলে মহামান্য রাজ্যপাল কেন্দ্রকে গোপন রিপোর্ট পাঠাতেই পারেন। কিন্তু, নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকারকে বিঁধে নিত্য সকাল বিকেল বিরূপ মন্তব্য গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কতটা শিষ্টাচারসম্মত? বিধানসভাতেও নির্বাচিত সরকারের লিখে দেওয়া রিপোর্ট পাঠ করা ছাড়া তাঁর অন্যথা করার সুযোগ বিশেষ নেই। নির্বাচিত রাষ্ট্রপতিরও নেই, মহামান্য রাজ্যপালেরও নেই।
মহামান্য রাজ্যপাল নিজেই বলেছেন, তিনি কেন্দ্রের নিয়োগ করা এজেন্ট মাত্র। একদম ঠিক কথা। সেই বিচারে কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে যোগসূত্র রচনা করাই তাঁর মূল দায়িত্ব। সরকারকে বিদ্ধ করে প্রশাসনিক ভারসাম্য নষ্ট করে কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করা তাঁর কাজ নয়। কখনও তা হতে পারে না। যদিও রাজ্যের গত দু’মাসের এই ঘটনাক্রমকে কোনওভাবেই আমি সাংবিধানিক সঙ্কট বলতে রাজি নই। কারণ, সংবিধানে কোথাও বলা নেই—বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জিতে আসা একটি সরকারের সঙ্গে রোজ, প্রতিমুহূর্তে সংঘাতে জড়িয়ে পড়াই মহামান্য ‘মহামহিম’-এর প্রধান সাংবিধানিক দায়বদ্ধতা। বিশেষ করে বিধানসভায় সেই সরকারের গরিষ্ঠতা নিয়ে যখন কোনও প্রশ্ন বা সংশয় নেই। রাজ্যের সিংহভাগ জেলায় আইন-শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে, অতি বড় নিন্দুকও যখন একথা বলতে পারবেন না। শাসক দলে আকস্মিক ভাঙন তথা রাজনৈতিক আনুগত্যের পুনর্বিন্যাসের জেরে বিধানসভার মধ্যে নতুন করে আস্থা প্রমাণ করতে বলার মতো কোনও পরিস্থিতিও যেখানে তৈরি হয়নি।
অতএব মহামান্যের এত তাড়াহুড়োটা কীসের? রাজ্য সরকার কি গরিষ্ঠতা হারিয়েছে, না কি রাজভবনের নির্দেশ মেনে আস্থাভোট নিতে ভারপ্রাপ্ত স্পিকার গড়িমসি করছেন? দিবাস্বপ্নেও তো এমন কোনও সঙ্কটজনক পরিস্থিতি তৈরির সুযোগই নেই। পরবর্তী মন্ত্রিসভার শপথ তো ২০২১ সালে রাজ্যের সপ্তদশ বিধানসভা নির্বাচনের পর।
এমন পরিস্থিতিতে রাজ্যে এসে প্রথম দিন থেকেই রাজভবনের প্রবীণ বিদগ্ধ মহামান্য কাণ্ডারীর হঠাৎ এরকম ‘প্রো-অ্যাক্টিভ’ ভূমিকার কথা কি ছত্রে ছত্রে সংবিধানে লেখা আছে? না-হলে নিজের সরকারের বিরুদ্ধেই রাজ্যের সম্মাননীয় প্রথম নাগরিকের এত অভিযোগ, অসন্তোষ কীসের? বিশেষ করে যখন সেই সরকারের মুখ্যমন্ত্রী নিজেই সকাল থেকে রাত পর্যন্ত একা হাতে রাজ্যের উন্নয়নের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। প্রায় নিয়ম করে জেলায় গিয়ে প্রশাসনিক কাজকর্ম দেখভাল করছেন। এবং, যখন আগামী বিধানসভা নির্বাচন এখনও প্রায় দেড়বছর দূরে। সেই নির্বাচনে যতই কঠিন লড়াই হোক জনমত এখনও অনেকটাই জননেত্রীর পক্ষেই ঝুঁকে।
সাধারণত কোনও কিছু বলার থাকলে, কোনও নজিরবিহীন ঘটনা নিয়ে মন্তব্য করার থাকলে রাজভবন থেকে প্রেস বিবৃতি জারি হয়ে থাকে। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্বে তৎকালীন রাজ্যপাল মাননীয় গোপালকৃষ্ণ গান্ধী একাধিক বিবৃতি জারি করেছিলেন। বলেছিলেন, হাড় হিম করা সন্ত্রাসের কথা। প্রেস বিবৃতি ছাড়া কোনও অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাওয়া অথবা বেরিয়ে আসার পথে কোনও ঘটনা নিয়ে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে মহামান্য রাজ্যপাল দাঁড়িয়েই অত্যন্ত সংক্ষেপে মন্তব্য করেন। কিন্তু কোথাও কেউ শুনেছেন, রাজ্যে একটা বিপুল গরিষ্ঠতায় জিতে আসা সরকার ক্ষমতায় আসীন থাকা সত্ত্বেও রাজ্যপাল নিয়ম করে যেখানেই যাচ্ছেন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর সাংবাদিক সম্মেলন করছেন। এবং সবচেয়ে বড় কথা, সরকারের বিরুদ্ধে তাঁর ক্ষোভ, কটাক্ষ উগরে দিচ্ছেন। মন্ত্রীদের বিঁধছেন। মুখ্যসচিব কেন দীর্ঘ ৫০ দিনেও তাঁর সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পেলেন না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। রাজ্যপাল ও মুখ্যসচিবের মধ্যে যদি কোনও দূরত্ব তৈরি হয়েও থাকে তা প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তরের একটি অত্যন্ত গোপনীয় ব্যাপার। রাজভবনের সচিবালয়ের মাধ্যমেই তার নিষ্পত্তি করা বাঞ্ছনীয়। ভরাহাটের মধ্যিখানে বসে তা নিয়ে কথা বলা কি রাজ্যপাল পদের সম্মান ও গরিমার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
শুধু তাই নয়, শিলিগুড়ি বিমানবন্দর থেকে
সার্কিট হাউসে আসার পথে মুখ্যমন্ত্রীর কাটআউট দেখে তা নিয়েও সাংবাদিকদের কাছে শ্লেষ মেশানো মন্তব্য করতেও মহামান্য রাজ্যপাল ছাড়েননি।
অথচ, ভারতের মতো গণতান্ত্রিক দেশে রাজ্যের
কিংবা রাষ্ট্রের সরকার যাঁর নামে চলে, যাঁর হাতে অঙ্গরাজ্য পরিচালনার ক্ষমতা ও দায়িত্ব ন্যস্ত হয়েছে, তাঁর কাটআউট ও ছবি টাঙানো তো কোনও আইনলঙ্ঘনের মতো বাড়াবাড়ি হতে পারে না। বিশেষ করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো অবিসংবাদিত জননেত্রী, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলায় যার গ্রহণযোগ্যতাকে ম্লান করার মতো কোনও নেতা বা নেত্রী আজও নেই। আর কে না জানে, হালফিল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দিল্লি বিমানবন্দরের বাইরে নরেন্দ্র মোদি আর কলকাতা বিমানবন্দরের বাইরে মমতারই কাটআউটই শোভা পাবে। দিল্লিতে কি প্রত্যেক রাস্তার মোড়ে মহামহিম রাষ্ট্রপতি মহামান্য রামনাথ কোবিন্দের কাটআউট শোভা পাচ্ছে? কিংবা রাজনৈতিক উত্থান পতনে সরগরম মহারাষ্ট্রে রাজ্যপাল ভগৎ সিং কোশিয়ারির ক’টা ছবি কিংবা কাটআউট আছে?
তাহলে রাজভবনের এত গোঁসা কেন? মহামহিম রাজ্যপাল একটা কথা ঠিকই বলেছেন, তিনি সব অর্থেই ক্রিকেট মাঠের আম্পায়ার। শুধু নিঃশব্দে আঙুল তোলাই তাঁর একমাত্র কাজ। কিন্তু, তা না করে তিনি নিজেই যদি চার-ছয় মারতে নেমে যান তাহলে খেলাটা তো মাঠেই মারা যাবে! হচ্ছেও তাই। আম্পায়ার যদি বিরাট কোহলির ব্যাটিংয়ের ভুল ধরতে যান কিংবা নিজেই শামি-ইশানের মতো বলে ঝড় তুলতে চান তাহলে ক্রিকেট খেলাটা কিন্তু পণ্ড হতে বাধ্য। প্রবীণ, বিদগ্ধ, প্রাজ্ঞ আইনজীবী মহামান্য রাজ্যপাল যেন এই আপ্তবাক্যটি মনে রাখেন। না হলে কী মহারাষ্ট্র, আর কী পশ্চিমবঙ্গ, সর্বত্র এক অভূতপূর্ব সাংবিধানিক সঙ্কট শুরু হবে।