দীর্ঘদিনের পরিশ্রমের সুফল আশা করতে পারেন। শেয়ার বা ফাটকায় চিন্তা করে বিনিয়োগ করুন। ব্যবসায় ... বিশদ
গত লোকসভা নির্বাচনে রাজ্য-রাজনীতির গতিপ্রকৃতিতে বিরাট পরিবর্তন এসেছে। রাজ্য রাজনীতির আঙিনায় তৃণমূল, বাম ও কংগ্রেসের রাজনীতির বৃত্তে বিজেপি প্রবলভাবে নিজের উপস্থিতি জাহির করতে সক্ষম হয়েছিল। রাজ্যের ৪২টি লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে ১৮টি লোকসভা আসনে জয়ের পাশাপাশি শাসক তৃণমূলের সঙ্গে বিজেপির প্রাপ্ত ভোটের ফারাক ছিল মাত্র ৩ শতাংশ। রাজ্যের ২৩টি জেলার মধ্যে ১৩টি জেলায় বিজেপির প্রাপ্ত ভোট শাসক তৃণমূলের থেকে বেশি ছিল। লোকসভা নির্বাচনের নিরিখে ২৯৪টি বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে বিজেপি একাই ১২১টি কেন্দ্রে এগিয়ে ছিল। অন্যদিকে, বিগত লোকসভা নির্বাচনে বামেরা ৭.৫ শতাংশ ভোট পেয়ে রাজ্য-রাজনীতিতে প্রান্তিক অবস্থায় পৌঁছায়। কংগ্রেস লোকসভায় ২টি আসন পেলেও প্রাপ্ত ভোট ৫.৫ শতাংশে নেমে আসে। পাশাপাশি উত্তর দিনাজপুর, মালদা, মুর্শিদাবাদে কংগ্রেস তৃতীয় শক্তিতে পরিণত হয়। এই অবস্থায় ২০১৬ বিধানসভা নির্বাচনের পর আবারও রাজ্যে বাম ও কংগ্রেস জোট গঠন করে এই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছে।
লোকসভা নির্বাচনের পরবর্তী পর্যায়ে একের পর এক জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক কর্মী রাজ্য-রাজনীতিতে পরিবর্তনের সম্ভাবনা দেখে বিজেপিতে যোগদান করতে শুরু করে। একের পর এক পুরসভার জনপ্রতিনিধিরা দিল্লিতে গিয়ে বিজেপির গেরুয়া পতাকা হাতে নিয়ে ছিলেন। বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব মুকুল রায় থেকে কৈলাস বিজয়বর্গীয় দাবি করেছিলেন, একশোর বেশি তৃণমূলের বিধায়ক বিজেপিতে যোগদানের সম্ভাবনা রয়েছে। বাস্তবে কিন্তু দেখা গেল উত্তর ২৪ পরগনার যে-সমস্ত পুরসভা বিজেপির দখলে গিয়েছিল একের পর এক সেই পুরসভাগুলির জনপ্রতিনিধিরা দল বেঁধে আবারও তৃণমূল কংগ্রেসে ফিরে আসে। এমনকী, অর্জুন সিংয়ের গড় বলে পরিচিত ভাটপাড়ার পুনর্দখল নিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। রাজারহাট নিউ টাউনের বিধায়ক এবং বেহালা-পূর্বের বিধায়ক যথাক্রমে সব্যসাচী দত্ত এবং শোভন চট্টোপাধ্যায় বিজেপিতে যোগদান করলেও শোভনবাবুর দলে ফিরে আসা সময়ের অপেক্ষামাত্র। সব্যসাচীবাবুও বিজেপির রাজনীতিতে কতটুকু সক্রিয় হয়েছেন তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। অর্থাৎ, অন্যদল থেকে বিজেপিতে ঢোকার স্রোত কেবল বন্ধ হয়েছে তাই নয়, বরং যাঁরা এসেছিলেন তাঁদের বিজেপির রাজনীতির প্রতি মোহভঙ্গের ছাপ স্পষ্ট।
সর্বভারতীয় স্তরে বিজেপি একাই ৩০০-র বেশি আসন নিয়ে দ্বিতীয় বার দেশ চালানোর দায়িত্ব পেলেও অর্থনৈতিক মন্দার বিষয়টি সরকার এবং দল উভয়কেই দুশ্চিন্তায় রেখেছে। ৩৭০ ধারা বিলোপ, তিন তালাক বিল পাসের মতো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা প্রবাহের পরেও হরিয়ানা, মহারাষ্ট্রে বিজেপির ফল প্রত্যাশামতো হয়নি। হরিয়ানায় নতুন সঙ্গী জুটিয়ে সরকার গঠনে সফল হলেও, মহারাষ্ট্রে বিজেপির সরকার গঠনের স্বপ্ন এখনও অধরা রয়েছে। রাজ্যে রাষ্ট্রপতির শাসন জারি করতে হয়েছে। সংবিধানের ৩৭০ ধারা বিলোপের পর অশান্ত কাশ্মীর উপত্যকা এখনও বিজেপির মাথা ব্যথার কারণ। স্বস্তি কেবল অযোধ্যায় রাম মন্দিরের প্রশ্নে সুপ্রিম কোর্টের রায়। এইরূপ জাতীয় আবহে রাজ্যের তিনটি উপনির্বাচনের ভোট বিজেপির জাতীয় নেতৃত্বের কাছে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।
আবার ফেরা যাক রাজ্য-রাজনীতির দিকে। লোকসভা নির্বাচনের ধাক্কা সামলাতে তৃণমূল কংগ্রেস ভোট-কৌশলী প্রশান্ত কিশোরকে নিয়োগ করে দলের হারানো জমি ফিরে পেতে। প্রশান্ত কিশোরের পরামর্শ অনুসারে তৃণমূল শুরু করে নতুন করে গণসংযোগ যাত্রা, যার পোশাকি নাম দেওয়া হয়েছে ‘দিদিকে বলো’। এই উপনির্বাচনে তৃণমূলের হয়ে প্রার্থী নির্বাচন থেকে শুরু করে ভোটের প্রচারকৌশল সবকিছুই নির্ধারিত হয়েছে প্রশান্ত কিশোরের পরামর্শে। এমনকী, তিনটি কেন্দ্রের জন্য আলাদা আলাদা নির্বাচনী ইস্তাহার তৈরি করার পরামর্শ ছিল ভোট কৌশলী প্রশান্ত কিশোরের মস্তিষ্কপ্রসূত। এই উপনির্বাচনের ফল থেকে প্রশান্ত কিশোরের কর্মদক্ষতার প্রমাণ মেলানোর সুযোগ রয়েছে।
বিগত লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল থেকে দেখা গেছে রাজ্যজুড়ে বাম-কংগ্রেসের সিংহভাগ ভোটারই বিজেপিকে ভোট দিয়েছেন। ক্ষেত্রবিশেষে তৃণমূলের ভোটও বিজেপিতে হস্তান্তরিত হয়েছিল। নির্বাচনের পর গঙ্গা দিয়ে অনেকটা জল বয়ে গিয়েছে। ইতিমধ্যেই অসমের এনআরসিকে সামনে রেখে পশ্চিমবঙ্গেও এনআরসি করবার কথা বিজেপির নেতৃত্ব ঘোষণা করায় তৃণমূল রাস্তায় নেমে বিরোধিতা শুরু করে। এনআরসি ইস্যু রাজ্য-রাজনীতিতে উঠে আসার পর বিজেপি যেমন কিছুটা কোণঠাসা হয়ে পড়েছে, তেমনি শাসক তৃণমূল এনআরসিকে সামনে রেখে ভোটারদের মন পেতে ব্যাপক রাজনৈতিক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। তৃণমূলের এনআরসির বিরোধিতা থেকে রাজ্য-রাজনীতিতে উঠে আসতে পারে নতুন রাজনৈতিক সমীকরণ। রাজ্যজুড়েই মানুষ এনআরসি নিয়ে আতঙ্কে ভুগছে। বিজেপি সংসদে নাগরিকত্ব বিল এনে হিন্দুভোটারদের আশ্বস্ত করতে পারলেও সংখ্যালঘু ভোটারদের মধ্যে রয়েছে তীব্র আতঙ্ক। এই অবস্থায় সংখ্যালঘু অধ্যুষিত করিমপুর বিধানসভা কেন্দ্রে সংখ্যালঘু ভোটাররা আরও বেশি করে তৃণমূলের দিকে ঝুঁকে পড়ে কি না তা পরখ করার সুযোগ রয়েছে। আবার প্রতিযোগিতামূলকভাবে তৃণমূল এবং বিজেপি রাজ্য-রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার করছে—এই অভিযোগ সামনে রেখে বাম, কংগ্রেস এনআরসি নিয়ে সংখ্যালঘু ভোটারদের আশ্বস্ত করতে যে প্রচার চালাচ্ছে, তাতে বামেদের প্রতি সংখ্যালঘুদের নতুন কোনও ভাবনার প্রকাশ ফুটে ওঠে কি না তা এই উপনির্বাচনের ফল থেকে বোঝা যাবে। এনআরসির প্রভাব খড়্গপুর সদরে কম থাকলেও কালিয়াগঞ্জের প্রচারে শাসক বিরোধী উভয়ই এনআরসি নিয়ে তাদের বক্তব্য ব্যাপকভাবে ভোটারদের সামনে তুলে ধরেছে। উত্তরবঙ্গের কালিয়াগঞ্জ কেন্দ্রে ৫০ শতাংশ রাজবংশী সম্প্রদায় মানুষের বাস। নাগরিকত্ব বিলকে সামনে রেখে যে বক্তব্য বিজেপি রাখছে তাতে হিন্দুদের মধ্যে কী ধরনের প্রভাব পড়বে তা দেখার সুযোগ রয়েছে কালিয়াগঞ্জ বিধানসভা উপনির্বাচনের ফলাফল থেকে।
লোকসভা নির্বাচনে ধাক্কা খাওয়ার পর তৃণমূল কংগ্রেস বিজেপির হিন্দু জাতীয়তাবাদী ভাবনাকে প্রতিহত করতে বাংলা-বাঙালি উপ-জাতীয়তাবাদকে সামনে এনেছে। কাশ্মীরে কর্মরত মুর্শিদাবাদের পাঁচ শ্রমিকের মৃত্যুর ইস্যু থেকে সর্বভারতীয় পরীক্ষার প্রশ্নপত্রকে কেন্দ্র করে তৃণমূলের একের পর এক বক্তব্যে বাংলা-বাঙালিয়ানার ভাবনা তুলে ধরা হচ্ছে। দলের এই ভাবনায় তৃণমূল বাংলা ও বাঙালির আশা-আকাঙ্ক্ষার ধারক ও বাহক এবং অন্যদিকে বিজেপি একটি অ-বাঙালিদের দল—এই প্রচারকে তুঙ্গে নিয়ে যাওয়ার কৌশল লক্ষ করা গেছে। তৃণমূলের হয়ে নানা সংগঠন গত কয়েক মাস ধরে ব্যাপক প্রচারও চালাচ্ছে। এই প্রচারের নিটফল কী হতে যাচ্ছে, তার একটা ইঙ্গিত তিন বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনের ফলাফল থেকে মিলতে পারে।
রাজ্য-রাজনীতিতে তৃণমূলের বিরুদ্ধে ওঠা প্রধান অভিযোগগুলিকে হাতিয়ার করে বিজেপি এবং বাম-কংগ্রেস নির্বাচনী প্রচারে নেমেছে। এর মধ্যে কাটমানি ফেরত দেওয়ার মতো ইস্যু যেমন রয়েছে, তেমনি স্কুলের নিয়োগ নিয়ে দুর্নীতির মতো ইস্যুও রয়েছে। উপনির্বাচনের ইস্যু পাল্টা ইস্যু, পাশাপাশি রাজ্যের হিংসাত্মক পঞ্চায়েত নির্বাচন বা সাম্প্রতিক অতীতে ঘটে-যাওয়া উপনির্বাচন ঘিরে হিংসার আবহকেও বিরোধীরা প্রচারের অঙ্গ করেছে। আগামী বছর রাজ্যজুড়ে ১১১টি পুরসভা নির্বাচনের পূর্বে এই তিনটি উপনির্বাচনের মাধ্যমে তিন শিবিরের আজকের পরিস্থিতির একটা আন্দাজ মিলবে।
উত্তরবঙ্গে লোকসভা নির্বাচনের সমস্ত আসনই তৃণমূলের হাতছাড়া হয়েছিল। উত্তর দিনাজপুরের কালিয়াগঞ্জ (তফসিলি) কেন্দ্রে ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস প্রার্থী ৪৬,৬০২ ভোটে জয়ী হলেও লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি এই কেন্দ্রটি থেকে ৫৬,৫৬২ ভোটে এগিয়ে যায়। রাজবংশী সম্প্রদায় অধ্যুষিত এই কেন্দ্রের ফলাফল তিন পক্ষের কাছেই যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। কংগ্রেস কি পারবে তার পুরনো জমি ফিরে পেতে? না কি বিজেপি লোকসভার মতো এই কেন্দ্রে তার প্রভাব অব্যাহত রাখবে? না কি এনআরসি-র মতো ইস্যু আসাতে ২৩ শতাংশ সংখ্যালঘু ভোটারের সমর্থন নিয়ে তৃণমূলের পক্ষে এই কেন্দ্রে চমক দেওয়া সম্ভব হবে?
তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে নদীয়ার করিমপুর ছিল বামেদের দুর্ভেদ্য দুর্গ। প্রায় ৪৫ শতাংশ সংখ্যালঘু মানুষ এই কেন্দ্রটিতে রয়েছেন। গত নির্বাচনে সিপিএমের প্রার্থীকে পরাজিত করে তৃণমূলের মহুয়া মৈত্র ১৫,৯৮৯ ভোটে জয়ী হয়েছিলেন। লোকসভা নির্বাচনে মহুয়া মৈত্রের ভোটের ব্যবধান সামান্য কিছু কমে দাঁড়ায় ১৪,৩৪০ ভোট। কিন্তু এই কেন্দ্রে বাম-কংগ্রেসকে সরিয়ে বিজেপি ৩৬ শতাংশ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে। বাম-কংগ্রেস মিলে লোকসভায় ভোট ছিল ২০ শতাংশের মতন।
উপনির্বাচনে বাম-কংগ্রেস ঐক্যবদ্ধ হওয়ায় কেন্দ্রে নতুন কোনও সমীকরণ উঠে আসে কি না, না কি বাম-কংগ্রেসের সংখ্যালঘু অবশিষ্ট ভোটাররাও আরও ব্যাপকভাবে তৃণমূলের সমর্থনে এগিয়ে আসে তা যেমন দেখার বিষয়, তেমনি বাম-কংগ্রেস জোট এবং তৃণমূলের মধ্যে সংখ্যালঘু ভোট বিভাজনকে কাজে লাগিয়ে বিজেপি এগিয়ে যায় কি না তা দেখার বিষয়।
বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ লোকসভা নির্বাচনের প্রার্থী হিসেবে খড়্গপুর সদর কেন্দ্র থেকে ৪৫,১৩৩ ভোটে এগিয়ে ছিলেন। মোট ভোটের ৫৮ শতাংশ বিজেপির পক্ষে ছিল। উপনির্বাচনে প্রার্থিপদ নিয়ে বিজেপির অন্তর্দ্বন্দ্ব জয়ের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় কি না তা দেখার। না কি জ্ঞানসিং সোহনপালের চার দশকে জেতা এই আসনে নতুন কোনও সমীকরণ উঠে আসে তা দেখার।
পুরসভার চেয়ারম্যানকে প্রার্থী করে তৃণমূল আসনটি দখল করতে মরিয়া প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। অন্যদিকে, বিজেপি সভাপতির জেতা এই আসনে দুর্ঘটনা হলে রাজ্য-রাজনীতির সমীকরণই পাল্টে যেতে পারে। এই সমস্ত সম্ভাবনার উত্তর মিলবে ২৮ নভেম্বর। তার আগে ২৫ নভেম্বর শান্তিপূর্ণভাবে এই তিনটি কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ সম্পন্ন করা নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনের কাছে একটি বড় চ্যালেঞ্জ।