মানসিক অস্থিরতা দেখা দেবে। বন্ধু-বান্ধবদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখা দরকার। কর্মে একাধিক শুভ যোগাযোগ আসবে। ... বিশদ
তিনি তখন ডুবিয়া গেলেন মহাভাবনার সিন্ধুমধ্যে। প্রবোধ ত দিতে হইবে নন্দরাজকে। কিন্তু কী বলিয়া! সংসারে যখন কেহ ক্রন্দন করে কাহারও জন্য, তখন প্রথম কর্ত্তব্য প্রবোধদাতার তাহাকে কাঁদিতে নিষেধ করা। উদ্ধবের এখন বলা উচিত নন্দরাজ আর কাঁদিবেন না এমন আকুলভাবে। কিন্তু এই কথাটি বলা যে কত অনুচিত, অশাস্ত্রীয় তাহা উচ্চারিত হইতে পারে না শাস্ত্রজ্ঞ ব্যক্তির মুখে। উদ্ধব প্রবীণ, শাস্ত্রজ্ঞ, পণ্ডিত, ভক্ত। তিনি জানেন, অতি উত্তম ভাবেই জানেন যে জীবের জীবনের চরম সার্থকতা ভগবল্লাভে। ভগবানকে অন্তরঙ্গভাবে লাভ করা যায় হৃদয়ের আর্ত্তি ও আকুলতা দ্বাবা। সংসারক্ষেত্রে জীবকুল সর্ব্বদা ব্যাকুল ধন-জন-সুখৈশ্বর্য্যের জন্য, কেহ কেহ স্বর্গ-মোক্ষের জন্য। কৃষ্ণের জন্য ব্যাকুলতাপূর্ণ মানুষ সুদুর্লভ। কৃষ্ণের জন্য তীব্র ব্যাকুলতা লাভই মনুষ্যজীবনের চরমতম সার্থকতা।
উদ্ধব প্রত্যক্ষ দেখিতেছেন। নন্দরাজ জীবনের পরমতম সফলতা লাভ করিয়াছেন। তাঁহাকে দেখিয়া উদ্ধবের নিজের অন্তরে সাধ জাগে যাহাতে ঐরূপ আকুলতা তাঁর হৃদয়েও জাগে কৃষ্ণের জন্য। তিনি ভাবেন, বুঝি বা কোটি জন্মেও মহাসাধনা করিলেও ঐরূপ আর্ত্তি তাঁহার হইবে না শ্রীকৃষ্ণ লাভের জন্য। কৃষ্ণের জন্য ঐরূপ অশ্রুবর্ষণ, উদ্ধব মনে করেন তাঁর শাস্ত্র-কঠিন হৃদয়ে কদাপি সম্ভব হইবে না। উদ্ধবের প্রবল ইচ্ছা জাগে নন্দরাজের প্রেমপূর্ণ হৃদয়টি লাভ করিবার জন্য সব ছাড়িয়া তপস্যা করিতে।
নন্দরাজ যে প্রেম লাভ করিয়াছেন অনন্ত বিশ্বে তাহার তুলনা নাই। কৃষ্ণের জন্য ব্যাকুল আর্ত্তনাদই যখন জীবের জীবনের চরমতম সার্থকতার পরিচায়ক, তখন উদ্ধব নন্দরাজকে কাঁদিতে নিষেধ করিবেন কোন মুখে। যদি বলেন উদ্ধব তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া “হে ব্রজরাজ, আর অমন করিয়া কাঁদিবেন না”, তাহা হইলে বিশ্বের সকল ধর্মশাস্ত্র উদ্ধবের মুখ চাপিয়া ধরিলেন। শাস্ত্রগণ বলিবেন উদ্ধব। কী অন্যায় কথা বলিতেছ? যে ক্রন্দনে জীবের জীবনসাধনায় সর্ব্বশ্রেষ্ঠ সাফল্য তুমি সেই কার্য্যে নিষেধ করিতেছ? তুমি শাস্ত্র-নিপুণ হইয়া এমন শাস্ত্র বিগর্হিত উপদেশ দিতেছ কোন্ বিচারে? উদ্ধব শাস্ত্রের মূর্ত্তি। শাস্ত্রসিদ্ধান্ত দ্বারা যেন তাঁর দেহমন গড়া। শাস্ত্রীয় তত্ত্বের বিপরীত একটি শ্বাসপ্রশ্বাস ত্যাগও উদ্ধবের স্বভাববিরুদ্ধ। সুতরাং শাস্ত্রানুযায়ী উদ্ধবের বলিতে হয়, ‘নন্দরাজ, এমনি ভাবে আরও কাঁদুন, যুগ যুগ ধরিয়া আরও আর্ত্ত হইয়া হা কৃষ্ণ বলিয়া আরও অশ্রু বিসর্জ্জন করুন।’ কিন্তু হায়! ইহাও ত সান্ত্বনার ভাষা নয়। যে মহাকাতর তাহাকে আরও কাতর হইতে বলা কি প্রবোধদাতার সাজে? যাঁহাকে সান্ত্বনা বাক্য বলিলে তাহা হয় শাস্ত্রবিগর্হিত, যাঁহাকে শাস্ত্রীয় কথা বলিলে তাহা হইয়া যায় প্রবোধদাতার পক্ষে নিতান্ত অশোভন, তাঁহাকে কি কথা বলিবে কে? শাস্ত্রপ্রবীণ উদ্ধবের পক্ষে নন্দরাজার সান্ত্বনাদাতা হওয়া কেবল যে অতি কঠিন কার্য্য তাহা নহে, সম্পূর্ণ অসম্ভব ব্যাপার। কোন লোক যদি কোন ব্যক্তি বা বস্তুর জন্য অত্যন্ত কাতর হইয়া পড়ে, তাহা হইলে যিনি আসিলেন তাহাকে সুস্থ করিতে, তাঁর দ্বিতীয় কর্ত্তব্য হইবে কাতর ব্যক্তির মনকে বিষয়ান্তরে টানিয়া আনিবার। যে বিষয় লইয়া সে ব্যথিত, সেই বিষয় হইতে যদি তার মন অন্য বিষয়ে লইয়া যাওয়া যায় তাহা হইলে তার দুঃখের লাঘবতা হইতে পারে। ।