মানসিক অস্থিরতা দেখা দেবে। বন্ধু-বান্ধবদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখা দরকার। কর্মে একাধিক শুভ যোগাযোগ আসবে। ... বিশদ
রাজ্য বিজেপি নেতৃত্ব—দিলীপ ঘোষ থেকে বিজয় বর্গীয় সকলেই এই বিপর্যয়ের কারণ বুঝলেও এনআরসি নিয়ে প্রকাশ্যে কিছু বলতে পারছেন না। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে বিরোধিতা করার মতন জায়গায় তাঁরা নেই। তাই দিলীপ ঘোষদের বলতে হচ্ছে, এনআরসি নিয়ে তাঁরা মানুষকে বোঝাতে পারেননি। উল্টো দিকে তাঁদের বক্তব্য, তৃণমূল এনআরসি নিয়ে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ও বিভ্রান্তি এমন পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল, যার প্রভাবে মানুষ বিজেপির থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। রাজ্যে বিজেপি নেতৃবর্গ এনআরসি ইস্যুকে এইভাবে আড়াল করলেও বাস্তবে এনআরসির প্রভাবকে ‘শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যাবে না’। কালিয়াগঞ্জে বিজেপির পরাজিত প্রার্থী কমলকুমার সরকার ভোটের ফল প্রকাশের পর প্রকাশ্যে জানিয়েছেন, এনআরসির জন্যই তাঁকে পরাজয়ের সম্মুখীন হতে হয়েছে।
তিনটি বিধানসভা কেন্দ্রের বুথভিত্তিক ফলাফল বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট ধরা পড়ে, কেন এই উপনির্বাচনে এনআরসি বিজেপির পরাজয়ের পিছনে মূল কারণ ছিল। অসমের অভিজ্ঞতা তো আছেই, বাংলার মানুষ এনআরসির হয়রানি কেবল প্রচারে শুনেছেন তা নয়, মিডিয়ার দৌলতে তা প্রতিনিয়ত প্রত্যক্ষ করতে পারছেন। এনআরসিতে নাম নথিভুক্তকরণের জন্য প্রতিনিয়ত অসমের মানুষকে একদিকে যেমন দুশ্চিন্তায় ও হয়রানিতে রেখেছে, তেমনি চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের পর ১২ লক্ষ হিন্দুর নাম বাদ পড়ায় হিন্দু ভোটারদের মনেও আতঙ্ক গ্রাস করেছে। অসম থেকে প্রতিনিয়ত খবর সামাজিক মাধ্যমের দৌলতে প্রত্যন্ত বাংলার গ্রামের মানুষের কাছে পৌঁছচ্ছে, তাঁরাও এনআরসি সম্পর্কে ধারণা তৈরি করতে পারছেন।
অসমে এনআরসি প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার আগেই মোদি-অমিত শাহ-রা সারা দেশে এনআরসি চালু করার কথা ঘোষণা করেন। এনআরসি নিয়ে বিজেপি নেতৃত্বের ঘোষণার পর বাংলার ঘরে ঘরে নাগরিকত্ব প্রমাণের নথি খোঁজার হিড়িক পড়ে যায়। আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন ওপার বাংলা থেকে আসা হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে কোটি কোটি মানুষ। বিগত দু-তিন মাস ধরে গ্রাম-শহরের সর্বত্র মানুষ নাগরিকত্বের সপক্ষে প্রমাণ খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য মানুষের দীর্ঘ লাইন দিয়ে অপেক্ষা করার ছবি সমস্ত ধরনের সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। আতঙ্ক অনেকগুণ বেশি লক্ষ করা গেছে রাজ্যের মুসলমান বহু মানুষের মধ্যে। ওপার বাংলা থেকে আসা হিন্দুদের মধ্যেও এনআরসি নিয়ে আতঙ্ক গ্রাস করেছে। ভোটার তালিকার সংশোধন প্রক্রিয়ার নতুন করে নাম তোলা, আধারের সঙ্গে ভোটার কার্ডের সংযোগ, ডিজিটাল রেশন কার্ড পাওয়ার বিষয়ে গ্রামের মানুষ মরিয়া হয়ে উঠেছেন। আট ঘণ্টা, দশ ঘণ্টা লাইনে দাঁড়ানোর পর ভোটার-আধার কার্ডের সংযোগ, নথি যাচাইয়ের কাজ করতে গিয়ে মানুষের যে হয়রানি হয়েছে, সেই হয়রানিকে ন্যূনতম বোঝার চেষ্টা রাজ্য বিজেপি নেতৃত্ব কখনওই করেননি। শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস তো মানুষের এই হয়রানি নিয়ে প্রশ্ন তুলবে, এটাই স্বাভাবিক।
মানুষ যখন হয়রানির শিকার হচ্ছেন, তখন রাজ্য বিজেপি নেতৃবর্গের মধ্যে দিলীপ ঘোষ হুংকার দিচ্ছেন—লাশের উপর দিয়ে আমরা এনআরসি করব। আবার রাজ্য স্তরের অনেক নেতাই বলছেন, মুসলমানদের ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ওপার বাংলায় পাঠিয়ে দেওয়া হবে। বিজেপি নেতৃত্বের এই অমানবিক হুংকার ও উদ্ধত আচরণ মানুষ যে পছন্দ করেনি তার ভোটের বুথভিত্তিক ফলাফল থেকে স্পষ্ট ইঙ্গিত মিলেছে। এনআরসি নিয়ে বিজেপি নেতৃবর্গ যত হুংকার ছুড়েছেন ততই বিজেপিকে ঠেকাতে সংখ্যালঘু মুসলমান ভোটারদের অনেকে অন্য সমস্ত রাজনৈতিক দল ছেড়ে তৃণমূলকেই একমাত্র ভরসাস্থল বলে মনে করেছেন।
এই উপনির্বাচনের তিনটি কেন্দ্রেই বাম-কংগ্রেসের অবশিষ্ট সংখ্যালঘু কর্মী সমর্থকরাও পুরোপুরিভাবে তৃণমূলের পক্ষে ভোট দিয়েছেন। একদিকে সংখালঘু ভোটের পূর্ণ মেরুকরণ তৃণমূলের পক্ষে যেমন হয়েছে, অন্যদিকে ওপার বাংলা থেকে আসা উদ্বাস্তুরাও এবার বিজেপিকে ছেড়ে তৃণমূলকে সমর্থন জানিয়েছে। কালিয়াগঞ্জ এবং করিমপুরের ফলাফলে স্পষ্ট ধরা পড়েছে উদ্বাস্তু মানুষের রায় এবার বিজেপির পক্ষে ছিল না।
এনআরসি কিন্তু বিজেপির জন্য ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনেও গলার কাঁটা হয়ে রইল। এমন এক কাঁটা, যা বিজেপি না পারবে গিলতে আবার না পারবে উগরে দিতে। বিজেপি নেতৃত্ব যদি এখন গলায় গামছা দিয়ে করজোড়ে এনআরসি থেকে সরে আসার কথাও বলে, তৃণমূল কিন্তু তার পরেও বিজেপির এই ঘোষণার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে থাকবে। আবার যতই নাগরিকত্ব বিল সামনে আনা হোক না কেন এনআরসিকে কেন্দ্র করে মুসলমান এবং উদ্বাস্তু হিন্দুদের মধ্যে যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে, তাতে আগামীদিনে মুসলমান ভোটারদের একাংশের সমর্থন পাওয়ার যেমন বিজেপির পক্ষে সম্ভাবনা থাকছে না, তেমনি উদ্বাস্তু হিন্দুদের মন জয় করাও বিজেপির পক্ষে কঠিন হবে বলে মনে হয়।
সংখ্যালঘু ভোটারদের কোনও একটি দলের পক্ষে মেরুকরণ সবসময়ই নির্বাচনে জয়-পরাজয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। রাজ্যের ২৯৪টি বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে ১৩০টি বিধানসভা কেন্দ্রে সংখ্যালঘু ভোটারদের মেরুকরণ এই তিনটি উপনির্বাচনের মতন ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনেও যদি তৃণমূলের পক্ষে থাকে, তবে ২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের থেকেও আরও অনেক বেশি আসন নিয়ে তৃতীয় বারের জন্য ক্ষমতায় ফিরে আসতে পারে।
রাজ্যে যত দিন এনআরসির খাঁড়া ঝুলতে থাকবে, ততদিন সংখ্যালঘু মুসলমানদের ভোট শাসক তৃণমূলের পক্ষেই থাকবে। হিন্দু ভোটারদের তরফ থেকেও প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, এনআরসিতে নাম তুলতে গিয়ে একজন নাগরিককে কেন লাইনে দাঁড়াতে হবে? কেন প্রমাণপত্র নিয়ে রাষ্ট্রের দরজায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হবে নাগরিক তালিকায় নাম ওঠানোর জন্য? যাঁদের পূর্বপুরুষ হাজার বছর ধরে এই বাংলা তথা ভারতে বাস করছেন তাঁদের এনআরসির ইস্যু কিন্তু আত্মসম্মানের ইস্যুর সঙ্গে সম্পর্কিত। আর যাঁরা ওপার বাংলা থেকে ভিটেমাটি ছেড়ে উদ্বাস্তু হয়ে এসেছেন, তাঁরাও পারবেন তো সঠিক সময়ে লাইনে দাঁড়িয়ে সরকারি আধিকারিকদের সঠিক নথি দিতে?
আপাতত পুরনো ট্রাঙ্ক থেকে বাড়ির দলিল বের করে বার বার চোখ বুলাচ্ছেন অনেকেই। কেউ আবার পঞ্চাশ,ষাট, সত্তরের দশকের ভোটার তালিকা খুঁজতে ব্যস্ত। আর রাষ্ট্র যখন নাগরিকত্ব বিল নিয়ে মুসলমান এবং অবশিষ্ট নাগরিকদের মধ্যে ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজন টানে, তখন মুসলমান কৌমের মানসিক অবস্থা কোন পর্যায়ে যায় তার নতুন কোনও ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। রাজ্য বিজেপি নেতৃত্বের সুযোগ ছিল বর্তমান সরকারের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যর্থতার কারণগুলিকে সামনে রেখে বিকল্প সরকার দেবার। কিন্তু এনআরসি আপাতত বিজেপির অগ্রগতির পথে কাঁটা হয়ে রইল বলা যায়।