মানসিক অস্থিরতা দেখা দেবে। বন্ধু-বান্ধবদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখা দরকার। কর্মে একাধিক শুভ যোগাযোগ আসবে। ... বিশদ
আজকের দিনে এমনটা বলাও ঠিক না যে রোগীর পরিবারের লোকজন একেবারে ধোয়া তুলসীপাতা। তাঁদের অনেকে চিকিৎসকদের অনেক বেশি উত্যক্ত করেন। এর একটি কারণ গুগুল করলেই চটজলদি আপাতভাবে অনেক কিছু জানা যায়। ফলে অল্প শিখে রোগীর আত্মীয় স্বজন আরও বেশি উদ্বিগ্ন হন, এবং সঙ্গে আসে অসহিষ্ণুতা। তাঁরা বারবার প্রশ্ন করেন রোগীর স্বাস্থ্য পরিস্থিতি নিয়ে, অনেক সময় তর্ক চলে অপ্রয়োজনে। এতে চিকিৎসকদের বিরক্তি উৎপাদন হওয়াটাই স্বাভাবিক। তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে চিকিৎসাব্যবস্থারও উপযুক্ত বদল প্রয়োজন। চিকিৎসক এবং রোগীর পরিবারদের মধ্যে বদলা নেওয়ার প্রতিযোগিতায় রোগীর যে আদৌ কোনও লাভ হয় না সে বোধ সকলেরই আছে। তবু সমাধান দূরে থাক, গত একদশকে ডেঙ্গুর প্রাবল্যে বিষয়টি আরও জটিল হয়েছে। কোনও এক অজানা কারণে ডেঙ্গু সংক্রান্ত সঠিক পরিসংখ্যান প্রকাশ পাচ্ছে না। তবে গত এক বছরে ডেঙ্গু মোকাবিলায় সরকারের প্রচেষ্টা আগের থেকে কিছুটা বেড়েছে, কমেছে ডেঙ্গু লুকিয়ে রাখার প্রবণতাও। তা সত্ত্বেও একথা বলতেই হয় সরকারের দিক থেকে আরও বেশি সতর্কতা জরুরি। রাজ্য জুড়ে ডেঙ্গুর প্রকোপ যেরকম সাংঘাতিক, তাতে জনগণকে বাঁচতে গেলে মশারি ঘাড়ে নিয়ে চলাফেরা করা ছাড়া আর বিশেষ কোনও পথ দেখা যাচ্ছে না। আর এ রোগে চিকিৎসার একটা বড় অংশ বাড়িতে সম্ভব, কিন্তু বাড়াবাড়ি হলে হাসপাতালে ভর্তি হতেই হবে। যেকথা আগেই বলছিলাম, অর্থনীতির নিয়মে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিম্নবিত্তদের যেতে হবে সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আর মধ্যবিত্তদের স্থান হবে বেসরকারি হাসপাতালে।
সরকারি হাসপাতালে পরিষেবার অপ্রতুলতা থাকলেও টাকা পয়সা নিয়ে গোলমাল কম। অন্যদিকে অস্বীকার করার উপায় নেই যে মধ্যবিত্তদের মূল সন্দেহ হল বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল রোগীদের ঠকাচ্ছে কিনা। এই ঘটনা যে কোনও অসুখের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। অর্থাৎ এমনটা হতেই পারে যে অসুখ যেটুকু হয়েছে তার থেকে অনেকটা বেশি রোজগার করছে কিছু বেসরকারি চিকিৎসালয়। সাধারণভাবে এর সত্য মিথ্যা যাচাই করা কঠিন, তবে আমজনতার উপলব্ধি অমূলক নাও হতে পারে। ঠিক এরকমই একটা বিভ্রাট অণুচক্রিকার গণনায়। ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে একটা বড় সমস্যা প্লেটলেট (অণুচক্রিকা) কমে যাওয়া। এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায় না গিয়েও যেটা বলা যায় তা হল একক মাইক্রোলিটার পরিমাণ রক্তের মধ্যে এর সংখ্যা থাকা উচিত অন্তত দেড় লক্ষের বেশি। কিন্তু ডেঙ্গুর আক্রমণে যদি এর পরিমাণ কয়েক হাজারে নেমে যায় তখন ভীষণ বিপদ। সেক্ষেত্রে হাসপাতালে বিশেষভাবে পর্যবেক্ষণের মধ্যে রাখতে হয় রোগীকে। অণুচক্রিকার সংখ্যা গোনার দুটি উপায় আছে। এক হল যন্ত্রের মাধ্যমে আর অন্য উপায় হল প্রশিক্ষিত চিকিৎসক যখন নিজের চোখে অণুবীক্ষণ যন্ত্রের মাধ্যমে তা দেখেন। যন্ত্রের যে গণনা তা মূলত আনুমানিক। তাই চিকিৎসকের নিজের চোখে বিচার করা সংখ্যাই অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য। শরীরে অণুচক্রিকার পরিমাণ বেশি থাকলে যন্ত্রই মাপুক, কিংবা চিকিৎসক, খুব কিছু যায় আসে না। কিন্তু সে সংখ্যা যখন কমে আসে মাত্র কয়েক হাজারে, তখন গোলমাল অনেক বেশি। উদাহরণস্বরূপ, যন্ত্রে যে মাপ আট হাজার, তাই হয়তো চোখে দেখলে আঠাশ হাজার। এবার অণুচক্রিকার সংখ্যা কম শুনে রোগীর পরিবারের দুশ্চিন্তা বেড়ে যায় অনেক বেশি, এবং সেই পরিস্থিতিতে বেসরকারি হাসপাতালের পক্ষে মুনাফার পরিমাণ বাড়িয়ে নেওয়াও সহজ। অন্যদিকে যন্ত্র কিছুটা বেশি বলায় হয়তো বাড়ির লোক নিশ্চিন্ত হলেন, এদিকে চোখে দেখে কিছুক্ষণ পরে জানা গেল যে তা অনেকটাই কম। সে আর এক বিপদ।
এর সমাধান কি নেই? একটা পথ হল রোগীর পরিবার চাইলেই রক্তের কিছুটা নমুনা তার পরিবারের সদস্যদের মত অনুযায়ী অন্য কোনও জায়গা থেকে পরীক্ষা করে আনা যেতেই পারে। কিন্তু কিছু ব্যবসায়িক কারণ আর হয়তো বা কোনও চিকিৎসা সংক্রান্ত নিয়মের বাধ্যবাধকতায় বেসরকারি হাসপাতালগুলি এ ব্যাপারে একেবারেই সহযোগিতা করে না। এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের নিয়ে সরকার নতুন করে কিছু নিয়মাবলী স্থির করতেই পারে। যার কাছে খরচ করার মত পয়সা আছে, সে যদি নিয়মিত একাধিক জায়গা থেকে অণুচক্রিকা গুনিয়ে আনে, তাতে বেসরকারি হাসপাতালের বাধা দেওয়ার কোন যুক্তিযুক্ত কারণ নেই। অন্যদিকে এই অনুমতি দিলে সেই প্রতিষ্ঠানের উপর মানুষের বিশ্বাস বাড়বে অনেকটা। দুটি ভিন্ন জায়গা থেকে কোনও নমুনা পরীক্ষা করলে যে সঠিক অনুমানের সম্ভাবনা বেশি তা রাশিবিজ্ঞানের গোড়ার পরিচ্ছেদেই লেখা থাকে। দ্বিতীয় কথা হল ডেঙ্গুর প্রকোপ যদি এভাবে বাড়তে থাকে সেক্ষেত্রে সঠিক চিকিৎসার জন্যে যন্ত্রগণকের বদলে বিশেষজ্ঞের চোখে দেখে অণুচক্রিকার সংখ্যা গোনা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু চিকিৎসকের সংখ্যা যদি সীমিত হয় এবং নমুনার সংখ্যা থাকে অনেক বেশি, তাহলে অপেক্ষার সময় অনেকটা বেড়ে যাবে। চিকিৎসায় বিলম্ব হবে সঙ্কটাপন্ন রোগীর। অর্থাৎ বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত কিছু কর্মী যদি চিকিৎসকদের এই চোখে দেখার কাজে সাহায্য করতে পারেন, তাহলে অনেক বেশি অসুস্থ মানুষের শারীরিক অবস্থার সঠিক নির্ণয় দ্রুততর হওয়া সম্ভব। একথা মেনে নিতেই হবে যে ডেঙ্গুর রমরমা বেসরকারি চিকিৎসাব্যবস্থাকে বছরভর অনেক বেশি অক্সিজেন দিচ্ছে। তবুও সামান্য অণুচক্রিকার সংখ্যা গোনা নিয়েই প্রতিদিন রোগীর পরিবার এবং বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের বিশেষজ্ঞদের মধ্যে দিনভর দ্বন্দ্ব। এর মধ্যেই বেশিরভাগ রোগী সুস্থ হয়েই ঘরে ফিরছেন, কিন্তু দু-একটি ক্ষেত্রে তা ঘটছে না। সেকথা গত কয়েকদিন ধরে সংবাদমাধ্যমে কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে রাজ্য সরকার এবং বেসরকারি চিকিৎসাকেন্দ্রের প্রশাসন অণুচক্রিকা বিভ্রাট আর একটু স্বচ্ছভাবে সামলাতে পারলে সব পক্ষেরই মঙ্গল।