মানসিক অস্থিরতা দেখা দেবে। বন্ধু-বান্ধবদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখা দরকার। কর্মে একাধিক শুভ যোগাযোগ আসবে। ... বিশদ
মহারাষ্ট্রীয় রাজনীতিতে আজ বিজেপির ভূমিকা ও তার পরিণতি যাই হোক কেন্দ্রে এখনও তাদের একাধিপত্য অটুট। সর্বভারতীয় রাজনীতিতেও এই মুহূর্তে বিজেপিকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো শক্তিশালী বিরোধীর দেখা মেলেনি। কংগ্রেস মাঝেমধ্যে ঘুরে দাঁড়ানোর আসা জাগালেও সে যেন অনেকটা দপ করে জ্বলে উঠে হারিয়ে যাওয়ার মতো ব্যাপার। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিগত লোকসভা ভোটের সময় প্রাণপণ চেষ্টা করেও সর্বভারতীয় স্তরে পদ্ম-বিরোধীদের এককট্টা করতে পারেননি। প্রথামিকভাবে যাঁরা পাশে দাঁড়ানোর কথা বলেছিলেন, হাতে হাত ধরে ছবি তুলেছিলেন— কার্যকালে তাঁদের অনেকেই নিজ নিজ দলীয় স্বার্থ চরিতার্থ করতে গাছাড়া দিয়েছিলেন বা বেসুরো গেয়েছিলেন। ভোটফল প্রকাশের পর প্রধানমন্ত্রী ঠিক হবে বলেও তৎকালের কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী তাঁদের বিজেপি বিরোধী, বলা ভালো মোদি বিরোধী জোটশক্তি ধরে রাখতে পারেননি। ফলে মমতাকেও বাংলায় কার্যত একলা চলো রে বলে ভারত শাসকের বিরুদ্ধে শেষঅব্দি যুদ্ধে নেমে পড়তে হয়েছিল। এবং সেই লড়াইতে উত্তরবঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূলকে ধরাশায়ী করে এই রাজ্যে লোকসভার ৪২ আসনের ১৮টিতে পদ্ম ফুটিয়েছিল বিজেপি!
লোকসভা ভোটের আগে অবশ্য এই রাজ্যে বিজেপি দ্বিতীয় শক্তি হিসেবে উঠে আসবে এটা মোটামুটি রাজনৈতিক মহলের সকলেই বুঝতে পারছিলেন, সাধারণ জনতার আন্দাজও ছিল তেমনই। কিন্তু, এতটা যে উঠবে এবং আরও বেশ কয়েকটা আসনে যে একচ্ছত্র তৃণমূলের ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলবে—মুখে যে যাই বলুন এটা বিজেপির অন্দর বাহিরে কেউই প্রত্যাশা করেননি, হলফ করেই তা বলা যায়। রাজ্যবাসী বা রাজ্য রাজনীতির তাবড় পণ্ডিতও না। সংখ্যাটা ঘোরাঘুরি করছিল ১০ থেকে ১২ (অতি বিশ্বাসীদের হিসেবে ১৪)—ব্যস, ওই পর্যন্ত! ভোটফলের দিন শেষ পর্যন্ত ১৮ এবং ভোট শতাংশে ২২ উন্নতি দেখার পর গেরুয়া শিবিরের নেতানেত্রী সমর্থকদের মুখ ও প্রতিক্রিয়া আবেগ ও উল্লাসের বিস্ফারিত দৃশ্যগুলিতে তাই ঝলকে উঠেছিল অসম্ভবকে সম্ভব করার অপার আনন্দ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘাসফুল-সবুজ বাংলায় এত পদ্ম! অবিশ্বাস্য মনে হয়েছিল বঙ্গজনতারও। পথেঘাটে সে প্রমাণও মিলেছিল। কিন্তু, ওই যে বলে—ফলেন পরিচীয়তে—ফলের কাছে সবাইকেই নতজানু হতে হয়।
তারপর এই আজ ফের একটা ফল প্রকাশ হতে যাচ্ছে। হোক না উপনির্বাচনী ফল, মোট ২৯৪ আসনের রাজ্য বিধানসভার মাত্র তিনটির ফল— আমজনতার মতামত তো, আজকের পরিস্থিতির বিচারে তাকে কি উপেক্ষা করা যায়? লোকসভা ভোটের পর এই তো প্রথম জনতার মতামত জানার আবার একটা সুযোগ মিলছে। শাসক তৃণমূলই হোক, কি রাজ্যে প্রধান বিরোধী বিজেপি উভয়ের কাছেই আজ তাই খড়্গপুর, করিমপুর আর কালিয়াগঞ্জ উপনির্বাচনের ফলাফল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। মমতার রাজ্যব্যাপী সার্বিক উন্নয়ন, ভোটকুশলী প্রশান্ত কিশোরের ক্যারিশমা নাকি বিজেপির গেরুয়া ঝড় মোদি ম্যাজিকের চমক—কোনটা শেষ পর্যন্ত বিজয়নিশান তোলে তা দেখার এই তো সুযোগ। ১৮ আসন জয়ের গৌরবের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে নাকি প্রশান্ত দাওয়াইতে পশ্চিমবঙ্গে ফিকে হচ্ছে গেরুয়ার ক্রমবর্ধমান আধিপত্য তার আভাস মিলবে— শাসক বিরোধী উভয় সমাজেই আজ সেও এক উৎকণ্ঠ জিজ্ঞাসা। ২০২১ সালে বিধানসভা মহারণের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছে। তার পরিপ্রেক্ষিতে এই জিজ্ঞাসার ইতিবাচকতা বিশেষ মাত্রা যোগ করবেই। কলকাতা সমেত রাজ্যের পুরসভা নির্বাচনও তো আর বেশি দূরে নয়। মোদ্দা কথা, পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সর্বব্যাপী প্রভাব প্রতিপত্তিতে এই মুহূর্তে গেরুয়া ছোপ কতটা ধরে আছে, ১৮ আসন প্রাপ্তির মহালগ্নের পর নরেন্দ্র মোদি সরকারের এনআরসি, নাগরিকত্ব বিল ৩৭০ ধারা লোপ শিল্পবিলগ্নীকরণ ইত্যাদি সংস্কারী পদক্ষেপের প্রভাবে এই রাজ্যে সেটা বাড়ছে, না কিছুটা হলেও ফিকে হয়েছে তার জরিপ করার একটা উপায় হয়ে আসছে আজকের ফল।
শুধু কি তাই? করিমপুর কালিয়াগঞ্জের মতো মুসলিম ও দলিতপ্রধান এলাকায় মমতার উন্নয়নমুখী সহমর্মী ভাবমূর্তি সাধারণজনের মাঝে আজও অটুট আছে না হায়দরাবাদি ‘মিম’-এর প্ররোচনা তাতে ভাঙনের ইন্ধন জোগাতে শুরু করেছে—তারও একটা প্রাথমিক ইঙ্গিত ওই দুই কেন্দ্রের ফলে মিলতে পারে। একথা অনেকেই জানেন, সাম্প্রতিকে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে সর্বভারতীয় মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন (মিম) হয়ে আসাদউদ্দিন ওয়াইসি প্রচার চালিয়ে চলেছেন। হায়দরাবাদের এই সংসদ সদস্য ওয়াইসি এখন বাংলার রাজনৈতিক মহলে তথা সাধারণ জনমধ্যে বিশেষ আলোচিত। অনেক রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞের ধারণা, ওয়াইসির দল আসন্ন বিধানসভায় মুসলিমপ্রধান আসনগুলিতে প্রার্থী দেবে এবং জিততে না পারলেও ভোট কেটে বিজেপির এগিয়ে যাওয়ার রাস্তা সহজতর করবে। রাজ্যে ৭০-৭৫ খানা এমন আসন আছে যেখানে ভোটফলের নির্ণায়ক হয়ে ওঠেন মুসলিম ভোটাররা। ইতিমধ্যেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ওয়াইসির বিরুদ্ধে উস্কানিমূলকতার অভিযোগ এনে তোপ দেগেছেন। তবে, ২০২১ সালে ওয়াইসি তৃণমূলের পক্ষে কতটা বিপজ্জনক হয়ে উঠবেন বা তাঁর জন্য প্রধান প্রতিপক্ষ পদ্মশিবির কতটা সুবিধে পাবে তার হিসেব এখনই করা মুশকিল।
তার কারণ, এ রাজ্যে বিধানসভা ভোট এখনও বছর দূরে, তার মধ্যে গঙ্গার জল অনেক গড়াবে। এবং, তার চেয়েও বড় কথা এরাজ্যে বাম-কংগ্রেস এবার আগেভাগেই জোট করার কথা ঘোষণা করে দিয়েছে। বলা বাহুল্য, মুসলিম ও দলিত ভোটের একটা অংশ এখনও বাম-কংগ্রেসের ঘরে যায়। কট্টররা হয়তো ওয়াইসির কথায় প্রভাবিত হবে কিন্তু সাধারণ শান্তিপ্রিয় মুসলমান ভোটার ভিন রাজ্যের এক নেতার কথা কতটা আস্থাভরে মানবেন—তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়। বিশেষ করে মুখ্যমন্ত্রী মমতার উন্নয়নমূলক কাজকর্মের যে সুবিধা এরাজ্যের সংখ্যালঘুরা পেয়েছেন, পেয়ে চলেছেন, এত তাড়াতাড়ি সেসব বেমালুম ভুলে ওয়াইসির বক্তৃতায় প্রভাবিত হয়ে ভিন্ন সিদ্ধান্ত নেবেন—এমনটা কতদূর ঘটবে তা নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
তবু, সাবধানের মার নেই। কণ্টক যতই ক্ষুদ্র হোক তার বিদ্ধ করিবার ক্ষমতা থাকে— আর সে কাঁটা যদি বিষাক্ত হয় তাতে প্রাণসংশয়ও অস্বাভাবিক নয়। একথা মমতার মতো পোড়খাওয়া লড়াকু নেত্রী জানেন। সে জন্যই উন্নয়নে আরও আরও গতি আনতে তিনি ইতিমধ্যেই দিনরাত একাকার করে জেলাসফরে নেমে পড়েছেন। একের পর এক প্রশাসনিক বৈঠক করছেন। উন্নয়নকাজে গাফিলতি দেখলে রেয়াত করছেন না কাউকে। পাশাপাশি এনআরসির বিপদ মিম-এর বিপদ থেকে নানান কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের কুফল জনতাকে বোঝাচ্ছেন। তার কিছু ফল যে মিলতে শুরু করেছে—ভোট কুশলী প্রশান্ত কিশোরের প্রথম রিপোর্টে তার ইতিবাচক আভাস বেশ স্পষ্টভাবেই মিলেছে। রিপোর্ট নাকি বলছে, উত্তরবঙ্গের আলিপুরদুয়ার এবং জলপাইগুড়ি জেলার অধিকাংশ সিটে মমতার তৃণমূল জমি ফিরে পেয়েছে, চা বাগান এলাকায় গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব হটিয়ে জমি শক্ত করতে তৃণমূলের পুরনো কর্মকর্তাদের হটিয়ে পিকের সুপারিশ মতো নতুন কমিটি হয়েছে। গত ২৯ জুলাই থেকে চালু ‘দিদিকে বলো’ উদ্যোগেরও নাকি ফল বেশ ভালো। সব মিলিয়ে ১৮ আসনের ধাক্কাক্ষত খানিকটা হলেও মেরামত করা গেছে—এমনটাই বক্তব্য পিকের। পিকের এই ভাবনার সঙ্গে আজকের ভোটফল কতটা সঙ্গতিপূর্ণ হয়— সেটাও দেখার।
আসলে, উপনির্বাচন পুরনির্বাচন পঞ্চায়েত নির্বাচন আর লোকসভা বিধানসভা চরিত্রগতভাবে এক নয়। আকারে প্রকারে বড়ত্বেই শুধু নয়, লোকভাবনার দিক থেকেও ভিন্ন। লোকসভার কথা বাদ দিচ্ছি। বিধানসভায় মানুষ সরকারের বিগত কর্মকালের হিসেব করেই ভোটটা দেয়। সঙ্গে থাকে রাজনৈতিক পছন্দ। এর মধ্যে একটা অ্যান্টি-ইনকামবেন্সি ফ্যাক্টার থাকে ঠিকই, তবে নিতান্ত অন্ধবধির ছাড়া বাকি জনের কাছে সরকারের উন্নয়ন কর্মসূচি রূপায়ণের বাস্তবতা ব্যাপ্তি ও সাফল্যও ভোট-বিবেচনার সময় বিশেষ গুরুত্ব পায়। এই রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী মমতার উন্নয়নকামী ভাবমূর্তি এখনও রীতিমতো উজ্জ্বল। সেই ঔজ্জ্বল্য ছাপিয়ে পদ্মদল কতটা এতে পারে, ওয়াইসির মিম কতটা বাগড়া হয়ে দাঁড়াতে পারে—বলবে সময়। কিন্তু, আজ খড়্গপুর করিমপুর এবং কালিয়াগঞ্জ যে সেসবের একটা
ইঙ্গিত অন্তত দিয়ে যাবে—তাতে সন্দেহ নেই। আর সে জন্যই তো বঙ্গ জুড়ে পারদ চড়ছে কৌতূহলের। নয় কি?