মানসিক অস্থিরতা দেখা দেবে। বন্ধু-বান্ধবদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখা দরকার। কর্মে একাধিক শুভ যোগাযোগ আসবে। ... বিশদ
রাজনীতিতে হার জিত আছে। একদল জিতলে অন্যদল হারবে। এটাই স্বাভাবিক। এই হার জিতের গভীরে লুকিয়ে থাকে অসংখ্য কারণ। রাজনীতিতে ‘কেন’ শব্দটির গুরুত্ব অসীম। কেন পরাজয়, তার কারণ অনুসন্ধানের পর প্রতিকারের ব্যবস্থা করলে সাফল্য লাভ অনিবার্য হয়ে ওঠে।
এবার দেখা যাক, তৃণমূল কংগ্রেস কেন লোকসভা ভোটে বিপর্যস্ত হয়েছিল। একটা কথা প্রায় সকলেই স্বীকার করেন, ২০১১ সালে ক্ষমতা দখলের পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন ‘মা-মাটি-মানুষে’র সরকার যে সমস্ত সরকারি পরিকল্পনা নিয়েছে, তা এর আগে কেউ নেয়নি। রাস্তাঘাট, পানীয় জল, গ্রামাঞ্চলে বৈদ্যুতিকীকরণ তো হয়েছেই। পাশাপাশি প্রচুর কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে। নানা সরকারি প্রকল্পের মধ্যে দিয়ে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সাধারণ মানুষকে বিভিন্নভাবে পরিষেবা দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। সরকারি প্রকল্পের কোনও না কোনও সুযোগ সুবিধা পাননি, এমন পরিবারের সংখ্যা গ্রামেগঞ্জে খুবই কম। তা সত্ত্বেও লোকসভা ভোটে ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটে গিয়েছিল।
তার কারণ অনুসন্ধান করে দেখা গিয়েছে, স্থানীয় তৃণমূল নেতাদের ফুলে ফেঁপে ওঠা, দুর্নীতি, পঞ্চায়েত কব্জা করার জন্য মানুষের ভোটদানের অধিকার হরণ, স্কুলে শিক্ষক নিয়োগে অস্বচ্ছতা ও গড়িমসি এবং অবশ্যই তৃণমূল নেতৃত্বের একটা বড় অংশের হামবড়া ভাব দলকে ডুবিয়েছিল। দম্ভের হাত ধরে জনবিচ্ছিন্নতা তার শিকড় বিস্তার করছিল অবলীলায়। জনবিচ্ছিন্নতা অনেকটা পরগাছা স্বর্ণলতার মতো। পরগাছা হু হু করে বাড়তে থাকে। আসল গাছটার রস শুষে খায়। ধীরে ধীরে শুকিয়ে যেতে থাকে মূল গাছ।
রাজনীতির দক্ষ কারিগর প্রশান্ত কিশোর তৃণমূলকে ঘুরে দাঁড় করানোর দায়িত্ব নিয়েই হারের প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান করেছেন। এখন সকলে বুঝতে পারছেন, ভোটগুরুর তকমা তিনি ফোকটে পাননি। ‘দিদিকে বলো’ তাঁর মাস্টার স্ট্রোক। দিদিকে বলোর মধ্যে দিয়ে তিনি আমজনতার ক্ষোভের কারণ আঁচ করেছিলেন। বুঝেছিলেন, অনেক লড়াই-আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে তৈরি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাগানে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বাকসর্বস্ব কিছু নেতা। উল্টোপাল্টা কথা বলে প্রচারে আসা নেতাদের সাধারণ মানুষ যে ভালো চোখে দেখে না, সেটা উপলব্ধি করেছিলেন। তাই প্রথমেই তিনি কাগুজে সর্বস্ব নেতাদের মুখে চাবি লাগিয়ে দিয়েছিলেন। ইদানীং তাঁদের টিভির পর্দায় খুব একটা দেখা যায় না। অর্থাৎ ওষুধ কাজ করেছে।
জনবিচ্ছিন্নতা কাটানোর জন্য বিধায়ক থেকে শুরু করে জনপ্রতিনিধিদের গ্রামে গিয়ে জনসংযোগ কর্মসূচি পালনের পরামর্শ দিয়েছিলেন। তাতে বালি, মোরাম, বোল্ডারে মগ্ন নেতাদের কোথাও কোথাও জনরোষের মুখে পড়তে হয়েছে। হেনস্তা হতে হয়েছে। শুনতে হয়েছে, এতদিন কোথায় ছিলেন? তীক্ষ্ণ বাক্যবাণে জর্জরিত হতে হয়েছে। মানুষ মনের ঝাল মিটিয়ে নেওয়ার সুযোগ পেয়েছে। আর তাতে ভিতরে থাকা ক্ষোভটাও বেরিয়ে গিয়েছে। পিকে এবং তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব বুঝিয়ে দিতে পেরেছে, নেতা ধরে বা লবি করে আর টিকিট নয়। টিকিট পেতে লাগবে জনসংযোগ। কারণ বিধানসভা ও পুরসভার ভোটে টিকিট বিলির সময় নেতৃত্বের চোখ থাকবে টিম পিকের রিপোর্ট কার্ডে।
তৃণমূল জমানায় সমস্ত সরকারি পরিষেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে কমিশন প্রায় বাধ্যতামূলক হয়ে গিয়েছিল। গরিব মানুষের আবাস যোজনার টাকা থেকে ১০০ দিনের কাজ। সবেতেই শাসক দলের স্থানীয় নেতাদের দিতে হয়েছে কাটমানি। নিজের হকের টাকা থেকে নেতাকে ভাগ দিতে হয়েছে। নেতাকে কাটমানি দিতে গিয়ে বহু ঘরের ছাউনিতে টালি, কিংবা টিন চাপেনি। তাতে ঘরের লোকও পর হয়েছে। তাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে প্রকাশ্যে নেতাদের কাটমানির বিরুদ্ধে গলা ফাটাতে হয়েছে। মানুষ বিশ্বাস করেছে, নেতাদের চুরিতে উপরতলার সায় নেই।
শাসক দলের নেতাদের অত্যধিক পুলিস ও প্রশাসন নির্ভরতাও তৃণমূলের ভরাডুবির অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল। ‘সেফ ড্রাইভ সেভ লাইফ’ কর্মসূচিকে সামনে রেখে পুলিসের একটা বড় অংশ যে লুটপাট চালাচ্ছিল, সেটাও নেত্রীর সামনে এসেছিল। তারপরই তিনি বিভিন্ন প্রশাসনিক সভায় গিয়ে পুলিসকে সতর্ক করেছেন। সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, বালি, বোল্ডার, পাথর, মাটির গাড়ি থেকে তোলা কোনও টাকাই কলকাতায় যায় না। কোনও নেতাকে টাকা দিতে হয় না। মুখ্যমন্ত্রী প্রশাসনের দুর্নীতিকে আড়াল না করে প্রকাশ্যে সেকথা বলায় সাধারণ মানুষ সম্ভবত তাঁদের সেই ‘অগ্নিকন্যা’কেই খুঁজে পেয়েছেন।
তবে, এখনও অনেক ব্যাপারেই ক্ষোভ আছে। বিশেষ করে শিক্ষক নিয়োগে জটিলতা ও স্বচ্ছতা নিয়ে মানুষের মনে বিস্তর ক্ষোভ। সেই ক্ষোভ দূর করতে হবে। শিক্ষক নিয়োগে আইনি জটিলতা কাটাতেই হবে। যেভাবেই হোক বাম জমানার মতো প্রতি বছর নিয়ম করে শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়া চালু করতে হবে। যদিও রাজ্যে বেকারত্বের হার জাতীয় হারের (৬ শতাংশ) চেয়ে কম, তবুও স্বস্তির কোনও জায়গা নেই। শিক্ষান্তে কাজের সুযোগ যে কোনও বেকারের প্রধান চাহিদা। লোকসভা ভোটে বালাকোট যদি জাতীয় আবেগ হয়ে থাকে, তাহলে যুব সমাজের আকর্ষণ ছিল নরেন্দ্র মোদির দেখানো ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’র স্বপ্ন। সেই যুবসমাজ পাশে না থাকলে যে কোনও দলের ক্ষমতায় থাকার স্থায়িত্ব দীর্ঘ হয় না।
এবার দেখা যাক, উপনির্বাচনে গেরুয়া শিবির এভাবে ধরাশায়ী হল কেন?
লোকসভা ভোটে এ রাজ্যে বিজেপির ১৮টি আসন পাওয়ার পিছনে সব চেয়ে বড় ভূমিকা ছিল জাতীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপট। লোকসভায় যদি ৪২ আসনই জিতে যেত তাহলেও তৃণমূল যে সরকার গড়তে পারবে না, সেটা সকলেই জানতেন। ফলে, সাধারণ মানুষ দেশে একটা স্থায়ী সরকার গঠনকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তাই ঝড়ে বক মরলেও বঙ্গ বিজেপির অনেকেই ভেবেছিলেন তাঁদের ওঝাগিরির জন্যই এই সাফল্য। এখন তাঁরা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, জনগণের কাছে তাঁদের মূল্য কতটা!
দ্বিতীয়, এরাজ্যে লোকসভা ভোটে গেরুয়া শিবিরের সাফল্যের পিছনে বালাকোটের জাতীয় আবেগ কিঞ্চিৎ কাজ করলেও প্রধান কারণ ছিল তৃণমূলের নেগেটিভ ভোট। তৃণমূলের পঞ্চায়েত, ব্লক ও জেলা নেতৃত্বের উপর মানুষের ক্ষোভ আছড়ে পড়েছিল ইভিএমে। বিজেপিকে ভালোবেসে নয়, মানুষ আন্তরিকভাবে চেয়েছিলেন তৃণমূলের অহঙ্কারের জবাব দিতে। তাই তৃণমূলের দখলে থাকা একের পর এক বিধানসভা আসন থেকে ৪০ হাজার ৫০ হাজার ভোটে লিড নিয়েছিল বিজেপি। লিড দেখে চমকে গিয়েছিলেন বিজেপির নেতারাও। কোনও সংগঠন ছাড়া স্রেফ হাওয়ার জোরে এভাবে সাফল্য যে ঘরে তোলা যায়, তা এর আগে এরাজ্য একবারই মাত্র প্রত্যক্ষ করেছিল। ১৯৮৪ সালের লোকসভা ভোটে। ইন্দিরা গান্ধীর অকাল প্রয়াণে। সেবার সহানুভূতির ঝড়ে টলে গিয়েছিল বামদুর্গের ভিত। কিন্তু, সেই ঝড় দীর্ঘমেয়াদি কোনও প্রভাব ফেলতে পারেনি।
লোকসভা ভোটে গেরুয়া শিবিরের সাফল্য লাভের সঙ্গে সঙ্গে বেনোজলের স্রোত আছড়ে পড়ল। ক্ষমতার চিটেগুড়ের লোভে তৃণমূল ও সিপিএমের দাগী, পচাদের ভিড় বাড়তে লাগল। কেউ কেউ আবার নতুন দলের মাথায় চড়ে বসল। বহু জায়গায় প্রায় আট বছর ঘরের মধ্যে সেঁধিয়ে থাকা সিপিএমের হার্মাদরা গাঝাড়া দিয়ে একেবারে সামনের সারিতে চলে এল। বিভিন্ন এলাকায় স্বঘোষিত নেতাদের আবির্ভাবে পদ্ম শিবির তখন চাঙ্গা। ভাবখানা এমন, এই বুঝি ক্ষমতায় এসে গেল। শুরু হল চেয়ার দখল নিয়ে আদি ও নব্যের লড়াই। মণ্ডল কমিটি দখল নিয়েও চলল খেয়োখেয়ি। মানুষ এসব দেখে ভাবতে শুরু করল, এ তো টকের জ্বালায় পালিয়ে এসে তেঁতুলতলায় বাস।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এরাজ্যের শাসন ক্ষমতায় বসার আগে বছরের পর বছর সিপিএমের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। কয়েক দশক ধরে আন্দোলনের সুবাদে রাজ্যের কোণায় কোণায় তৈরি হয়েছে নিজের লোক। তারা মার খেয়েছে, জেল খেটেছে, খুন হয়েছে। তারপর ক্ষমতা দখল। এসব কিছু হওয়ায় হয়নি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পিছনে সংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাস আছে। কিন্তু, বঙ্গ বিজেপির ক’জন তাঁদের রাজনৈতিক জীবনে লড়াই, সংগ্রামের কথা স্বগর্বে ঘোষণা করতে পারবেন? রাজনীতিতে অনেক অঘটনই ঘটে। কিন্তু, শুধু হাওয়ায় আর বেনোজলের তোড়ে রাইটার্স বা নবান্নে পৌঁছনোর মতো অঘটন ঘটে না।
লোকসভা ভোটে সাফল্য পাওয়ার পর থেকে বিজেপির বঙ্গ নেতৃত্ব দল গড়ার থেকে দল ভাঙানোয় বেশি আগ্রহী হয়ে পড়েছিল। ভাড়াটে সেনা নিয়ে যে যুদ্ধ জেতা যায় না, এই সহজ সত্যিটা তাঁরা বুঝতে চাননি। রাজনীতি যে ১০০মিটারে স্প্রিন্ট নয়, ম্যারথন রেস তা বুঝতে চাননি। অনেকে বলছেন, সংগঠন না গড়ে অতিরিক্ত আরএসএস নির্ভরশীলতা এবং চট জলদি সাফল্য ঘরে তুলতে গিয়ে বিপদ ডেকে এনেছে বঙ্গ বিজেপি।
২০২১ সালের আগে এই উপনির্বাচনে বঙ্গ রাজনীতির অভিমুখ অনেকটা স্পষ্ট। এর ফলে বিজেপিতে ভাটার টান অনিবার্য। একইভাবে অনিবার্য, তৃণমূলের পার্টি অফিসগুলিতে ভিড় বৃদ্ধি। উপনির্বাচনে ফল ঘোষণা হতেই রাজ্যজুড়ে শুরু হয়েছে পটকা ফাটা। দলীয় কর্মীদের উচ্ছ্বাস খুবই স্বাভাবিক। এরপর হয়তো শুরু হবে বিজয় মিছিল বা মানুষকে ধন্যবাদ জানানোর নামে পদযাত্রা। সেই সব মিছিলে ফের মানুষের অপছন্দের মুখগুলি ভেসে ওঠার প্রাণপণ চেষ্টা চালাবে। এখানে বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ হিসেবে বলতেই হয়, অপছন্দের মুখ ফের সামনে এলে মুখ ফেরাবে জনতা জনার্দন। কারণ ক্ষমতার আস্ফালন আমজনতার নাপসন্দ।