মানসিক অস্থিরতা দেখা দেবে। বন্ধু-বান্ধবদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখা দরকার। কর্মে একাধিক শুভ যোগাযোগ আসবে। ... বিশদ
পার্থক্য হল, অনেক ক্ষমতা কমেই গিয়েছে তার। পুরনো আমলের নোট ভারতে থাকবে না। আমাদের চালু করা নতুন নোটই হবে ভারতের মুদ্রাব্যবস্থা। ভাবলেন নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহ। মনের এই ইচ্ছা থেকেই ২০১৬ সালে বদলে ফেলা ৫০০ ও এক হাজারের সমস্ত চালু নোট। বহু মানুষ টাকা সংগ্রহ করতে গিয়ে মারা গেলেন। বহু কোম্পানি চিরতরে বন্ধ হয়ে গেল। লক্ষ লক্ষ মানুষ সম্পূর্ণ বেকার হয়ে গিয়েছে। কিন্তু সেগুলিকে বলা যেতে পারে কো ল্যাটারাল ড্যামেজ। আসল লক্ষ্য পূরণ হয়েছে। সেটি হল এখন গোটা ভারত তাঁদের আমলে চালু হওয়া নোটই ব্যবহার করছে। এর মধ্যে হয়তো একটা আত্মতৃপ্তি আছে। অবশ্য দুর্জনেরা বলেন, নোটের মূল্য বাড়েনি। পুরনো ৫০০ টাকার নোটের দাম আজও ৫০০ টাকাই। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের বিনিময় মূল্য হিসাবে নোটের দাম তলানিতে এসে ঠেকেছে। এটুকুই যা ফারাক হয়েছে।
এক্ষেত্রেও প্রশ্ন হল, লাভ কী হল? নোটবাতিল করে নিজেদের ছাপ রেখে যাওয়া না হয় হল, কিন্তু ২০১৬ সালের সেই ৮ নভেম্বরের রাত আটটার পর থেকে আজ ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে কী এমন বিরাট অর্থনৈতিক বিপ্লব হয়ে গেল? কিছুই না! কালো টাকা কমেছে? না। নোট জাল হওয়া কমেছে? না। অর্থনীতির উন্নয়ন হয়েছে? না। বরং অর্থনীতি রোজ একটু একটু করে ডুবছে। তা হলে ওই সিদ্ধান্তের কারণ কী ছিল? এবং কী দিল ভারতকে?
জম্মুকাশ্মীর একটিই রাজ্য ছিল। সেটা পছন্দ নয় তাঁদের। তাই ৩৭০ নং ধারা বিলোপ করাটাই যথেষ্ট মনে হয়নি। জম্মুকাশ্মীর নামক একটি প্রাচীন রাজ্যের স্ট্যাটাসও বদলে ফেলা হল। একটি রাজ্য ভেঙে দুটি ভাগে বিভক্ত করা হল। এবং রাজ্যের সম্মান কেড়ে তাদের দেওয়া হল কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের তকমা। এই যে স্বাধীনতার পর থেকে ৩৭০ নং ধারা চলছিল, এতে বাকি ভারতের আমজনতার কী ক্ষতি হয়েছে? কিছুই না। আবার এই যে ৩৭০ নং ধারা অবলুপ্তি হল? তার পরও ভারতের বাকি পাবলিকের কী লাভ হয়েছে? কিছুই না। বরং কাশ্মীর একটি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে চলে গেল। কবে স্থিরতা আসবে সরকারই জানে না। আবার অন্য দিকে কাশ্মীরেরই বা কী লাভ হয়েছে ৩৭০ নং ধারা এতকাল ধরে থেকে? যদি ৩৭০ নং ধারা এতই ভালো, তা হলে কাশ্মীরে এত সন্ত্রাসবাদের দরকার পড়ল কেন?
সুতরাং জীবন যে খাতে চলার সেরকম আগেও চলেছে, এখনও চলবে। ৩৭০ নং ধারার থেকে যাওয়া অথবা অবলুপ্ত হয়ে যাওয়া তামিলনাড়ু কিংবা পশ্চিমবঙ্গে কোনও প্রভাব ফেলে না। প্রভাব ফেলে পেঁয়াজের দাম কিংবা ছেলেমেয়ের চাকরি না পাওয়ায়। কিন্তু সেটা হুজুগে পাবলিক বোঝে না। তারা নিত্য নতুন চমকে ডুবে থাকতে খুব পছন্দ করে। সুযোগ করে দেয় শাসককে নতুন চমক নিয়ে আসার। চার মাস কেটে গেল। কাশ্মীরের ওই সিদ্ধান্ত আমাদের কী কাজে লাগছে? কবে স্বাভাবিক হবে কাশ্মীর?
তাই পরিবর্তনের পূজারি নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহের বদল-সফর অন্তহীন। তাঁরা থামছেন না। যে সরকারি কোম্পানিগুলি ৬০ বছরের বেশি সময় ধরে দেশের অর্থনীতিকে শীর্ষস্তরে নিয়ে গিয়েছে এবং লক্ষ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান দিয়েছে, এবার সেগুলি একে একে বিক্রি করে দিচ্ছে মোদি সরকার। সরকারের যুক্তি হল, কোম্পানি চালানো সরকারের কাজ নয়। ঠিক এই একই কথা আশির দশকে বলেছিলেন মার্গারেট থ্যাচার। তাঁর সেই নীতির জেরে আজ ব্রিটেনের বেহাল দশা। যে ব্রিটেন একদিন ম্যানুফাকচারিং শিল্পের ভরকেন্দ্র ছিল গোটা বিশ্বে, আজ সেই ব্রিটেনে শিল্প বলে আর কিছুই নেই। ধুঁকছে অর্থনীতি। ভারত সেদিকেই এগচ্ছে।
যোজনা কমিশনের নাম বদলে দেওয়া হল। নির্জোট সম্মেলনের গুরুত্ব বদলে দেওয়া হচ্ছে। বৈদেশিক বন্ধুদের বদলে দেওয়া হচ্ছে। দিল্লিতে রাস্তার নাম বদলে দেওয়া হচ্ছে। উত্তরপ্রদেশে স্টেশনের নাম পাল্টে দেওয়া হচ্ছে। এলাহাবাদ থেকে ফৈজাবাদ সব নাম বদলে গিয়েছে। জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের ফি স্ট্রাকচার বদলে দেওয়া হচ্ছে। রাজ্যসভার মার্শালদের পোশাক বদলে দেওয়া হচ্ছে। মাত্র ৬ বছর ক্ষমতায় এসে ভারতের ৭২ বছরকে বদলে দেওয়ার একটি নেশায় যেন আসক্ত হয়ে পড়েছেন মোদি ও অমিত শাহ।
১৯৫১ সালে ডাচ চিত্রশিল্পী এম সি এসখারের আঁকা একটি পেন্টিং অত্যন্ত বিখ্যাত। সেটির নাম ‘হাউস অফ স্টেয়ারস’। সেই চিত্রে দেখানো হয়েছে, একটি সিঁড়ি, যার দুদিকেই খোলা, সেটি দিয়ে উপরের দিকে অন্তহীন হেঁটে চলেছে অসংখ্য মানুষ। প্রত্যেকে প্রচণ্ড উদ্বেগ নিয়ে সতর্ক ভাবে শুধুই উঠে চলছে, যাতে দুদিকের খোলা অংশ দিয়ে পতন না ঘটে। সকলের আশা কী ভাবে এই সিঁড়ি শেষ হয়ে সর্বশেষ ধাপে পৌঁছব। কিন্তু আসলে সেই সিঁড়ি কোথাও পৌঁছচ্ছে না। সেটি এমনই এক মেকানিজম যে মানুষকে সারাক্ষণ ব্যস্ত রাখছে সিঁড়ি ধরে উঠতে। গন্তব্য বলে কিছু নেই। ভারতের বর্তমান অবস্থা ঠিক ওই চিত্রটির মতোই করে দিয়েছেন অমিত শাহ ও নরেন্দ্র মোদি। আধার কার্ডের সঙ্গে গ্যাস সংযোগ। নোটবাতিলের পর পুরনো টাকা ব্যাঙ্কে জমা করতে হবে। এটিএম থেকে নতুন টাকা তুলতে হবে। এনআরসি হবে। আমি কি তালিকায় থাকব? নাগরিকত্ব আইন আসছে। নাগরিকত্বের পরিচয় খুঁজে রেডি রাখতে হবে। আধার কিংবা প্যান অথবা ভোটার কিংবা ড্রাইভিং লাইসেন্স পাল্টে গিয়ে একটিই মাল্টি টাস্কিং ডিজিটাল কার্ড। সেটা করতে গেলে কী কী ডকুমেণ্ট লাগবে? আধার কার্ডের সঙ্গে রেশন কার্ড যুক্ত করতে হবে। কবে লাস্ট ডেট? জিএসটি হার মাসে মাসে চেঞ্জ করা হচ্ছে। এই তালিকায় চোখ রাখলে বোঝা যাবে কীভাবে মানুষকে সারাক্ষণ ব্যস্ত, উদ্বিগ্ন, চিন্তিত করে রাখা হচ্ছে অবিরত। স্বাভাবিক নিয়ম হল কাজ করব, পড়াশোনা করব, সংসার করব, সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দেব, জন্ম হবে, মৃত্যু হবে ইত্যাদি। কিন্তু লক্ষ্য করে দেখা যাচ্ছে বিগত বছরগুলিতে এই স্বাভাবিক জীবনযাপনকে ছাপিয়ে অবিরাম সরকারের নানাবিধ সিদ্ধান্তের পিছনে আমাদের ছুটতে হচ্ছে। একটি কার্ড থেকে অন্য কার্ড। একটি নিয়ম থেকে অন্য নিয়ম। একটি প্রমাণপত্র থেকে আর একটি পরিচত্রপত্র। এই জার্নির কোনও গন্তব্য নেই। সব মিলিয়ে একটি নিরন্তর গতিশীল স্ক্রিপ্ট চলছে! আমরা সেই মেগা সিরিয়ালের নিছকই ক্রাউড সিনের কুশীলব।
দেখেশুনে সন্দেহ হয় অমিত শাহ ও নরেন্দ্র মোদি কি একটি বিপজ্জনক প্রবণতায় আক্রান্ত? সেটি হল অতি আত্মবিশ্বাস! তাঁরা কি ভুলে যাচ্ছেন যে তাঁরা দুজনেই জাতীয় রাজনীতির অঙ্গনে এসেছেন মাত্র ৬ বছর। তাই সর্বাগ্রে দরকার ছিল ধীরস্থির হয়ে ভারতকে আত্মস্থ করা। প্রতিটি রাজ্যের সংস্কৃতি, ইস্যু, মানুষের মনোভাব একটু একটু করে উপলব্ধি করে, সব রাজ্যের মানুষের মন জয় করে তার পর সুচারু প্ল্যানে নিজেদের পরিকল্পনাকে কৌশলে রূপদান করা। হঠাৎ করে ৭২ বছরের ইতিহাস পাল্টে ফেলার মরিয়া পদক্ষেপ মোটেই চাণক্যনীতি নয়। নিজের শক্তি, প্রতিপক্ষের শক্তি, নিজের দুর্বলতা, প্রতিপক্ষের দুর্বলতা সবটাই সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করে এগনোই দীর্ঘকালীন সাফল্যের রাজনীতি। তাঁদের কাছে মানুষের সমর্থন আছে। গরিষ্ঠতা আছে। মোদির মতো এক চূড়ান্ত জনপ্রিয় মুখ আছে। তা হলে এত অধৈর্য কেন? ভাবতে হবে যে, কেন এই সেদিন লোকসভা ভোটে বিপুল জয় হল, অথচ মাত্র কয়েকমাস পর থেকেই একে একে রাজ্যগুলিতে গরিষ্ঠতা পাচ্ছি না? এখনও প্রতিটি নির্বাচনে তাঁরাই তো একক বৃহত্তম দল! সুতরাং পুনরায় একক গরিষ্ঠতায় ফিরে আসা মোটেই কঠিন নয়। শুধু প্রয়োজন অ্যাপ্রোচের পরিবর্তন। আর একটু ইতিবাচক মনোভাব নিতে হবে তাঁদের।
মাত্র ৬ বছর আগে গুজরাত থেকে এসেই অমিত শাহ ও নরেন্দ্র মোদি যদি ভেবে বসেন, ১৯৮৪ সালে এমপি হয়ে দিল্লি আসা এবং সিপিএমের মতো এক শক্তিকে উৎখাত করে দেওয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিংবা ১৯৭৮ সালে ইন্দিরা গান্ধীকে ধাক্কা দিয়ে মাত্র ৩৭ বছর বয়সে মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী হওয়া শারদ পাওয়ারকে তাচ্ছিল্য করা যায়, নস্যাৎ করা যায় এবং অনায়াসে তাঁদের রাজনীতির রণকৌশলে পরাজিত করা সম্ভব, সেটা কি ওভার কনফিডেন্স নয়? মহারাষ্ট্রে সরকার গঠনের নাটকীয় পট পরিবর্তন এবং পশ্চিমবঙ্গের তিনটি উপ নির্বাচন কি সেই বার্তাই দিল না? পৃথিবী বিখ্যাত প্রাচীন চীনা গ্রন্থ ‘আর্ট অফ ওয়ার’ হাজার হাজার বছর ধরে আজও সমান প্রাসঙ্গিক যুদ্ধের ফর্মুলা হিসাবে। সেখানে বলা হয়েছে, তুমি যদি নিজেকে এবং প্রতিপক্ষকে কাউকেই না চেনো, তাহলে প্রতিটি যুদ্ধই হারবে। তুমি যদি নিজেকে চেনো অথচ প্রতিপক্ষকে চিনতে পারোনি, তা হলে যে কোনও যুদ্ধে জিতলেও একটি করে পরাজয়ের সম্ভাবনা থেকেই যাবে আগামীদিনে। আর তুমি যদি নিজেকে এবং প্রতিপক্ষকে সমানভাবে চিনে নাও, তা হলে পরাজয়ের কোনও সম্ভাবনা নেই। শুধু একটাই শর্ত, অধীর হলে হবে না। যুদ্ধজয়ের প্রধান শর্ত ধৈর্য আর প্রতিপক্ষকে গুরুত্ব দেওয়া! আর বর্জনীয়? অতি আত্মবিশ্বাস!