মানসিক অস্থিরতা দেখা দেবে। বন্ধু-বান্ধবদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখা দরকার। কর্মে একাধিক শুভ যোগাযোগ আসবে। ... বিশদ
এই যুক্তির বিরুদ্ধে এই কথাই ওঠে যে—নিয়ম-শৃঙ্খলা অনেক ক্ষেত্রেই আছে বটে কিন্তু আবার অনেক স্থলে তা পাই না। উদ্দেশ্য-বিষয়েও সেই কথা বলা যায়। জীবন ও জগতে বিশৃঙ্খলা, আকস্মিকতা ও উদ্দেশ্যহীন ক্ষয়-ক্ষতি ও অধঃপতন সদাই চোখে পড়ে। তাছাড়া আর একটি নিয়ম কাজ করছে বলে এ কথা বলা যায় না যে সে নিয়ম বরাবরই বা নিশ্চিন্তভাবে খাটবে। প্রতিদিন সূর্য উঠছে বলেই যে কাল উঠবে—এ যুক্তি নয়। যদি এখন বলা যায় যে এই সমস্ত অনিয়ম ও উদ্দেশ্য-বিহীনতা আপাত-দৃষ্টিতে মাত্র সত্য—বস্তুতঃ নয়। আমরা যদি সমগ্র জগৎকে দেখতে পেতেম—তার ভূত-ভবিষ্যৎ সমস্তখানি মিলিয়ে—দূরের, কাছের সব কিছুকে অখণ্ড-রূপে পেতেম—তাহলে এরূপ কোনও অসঙ্গতি কোথাও চোখে পড়তো না। কিন্তু তাহলেই দেখতে পাচ্ছি যে এই যুক্তির পিছনে রয়েছে পূর্ব-সিদ্ধান্ত যে এই জগৎ একটি সামঞ্জস্য-পূর্ণ সমগ্র ব্যাপার এবং এ-সিদ্ধান্ত আমাদের লৌকিক বা ব্যবহারিক জ্ঞান হ’তে আসতে পারে না। এর পিছনে আছে যুক্তিকারের অলৌকিক জ্ঞান বা উপলব্ধি। তারই সাহায্যে তিনি এই জগৎকে একটি চেতন-পুরুষের মানস-সৃষ্টি-রূপে দেখতে সমর্থ হন সেইজন্যই একে একটি সুনিয়ন্ত্রিত উদ্দেশ্য-পূর্ণ ব্যাপার বলে মনে করেন।
সুতরাং আবার দেখছি যে প্রামাণ্য বিষয়কে পূর্ব হতেই নিজের অজান্তেই যুক্তি করে স্বীকার করে নিয়েছেন। এই যুক্তি তাই যুক্তিকারের অধ্যাত্ম-জ্ঞানের বিবৃতি-মাত্র। কোনো অনুমানে অনুমেয় (বা সাধ্য) আর তার সাধন (বা যে-বস্তুর সাহায্যে অনুমান হয়) এই দুইয়ের মধ্যে একটি ব্যাপ্তি থাকতে হবে। কিন্তু জগৎ ও তার কারণ ঈশ্বর এই দুইকে যে একসঙ্গে পেয়েছে—ক্রমাগত সেইই এই যুক্তির আশ্রয় নিতে পারে এবং তাহলে তো ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষই সে পেয়েছে—তার অনুমানের প্রয়োজন কি? ধোঁয়া হ’তে আগুনের অনুমান করতে হ’লে ধোঁয়াকেও পূর্ব প্রত্যক্ষ করতে হয়। সুতরাং অনুমান প্রত্যক্ষ-জ্ঞানের ভিত্তির ওপরেই প্রতিষ্ঠিত।
আবার আর একদিক হ’তে ঈশ্বরের এই অনুমান-জ্ঞান অসম্ভব মনে হয় এই জন্য যে সাধ্য ও সাধনের মধ্যে ব্যাপ্তি প্রমাণ করতে হলে এই দুইকে বারবার একসঙ্গে পেতে হয় এবং কোনোবারই একের বিহনে অপরকে লাভ করা যায় না। কিন্তু এই বারংবার ঈশ্বর-দর্শন কার হয় এবং হলেও কোনোবারও যে একের অভাবে অন্যটি থাকবে না—এ কথা কে নিশ্চিত করে বলতে পারে? সুতরাং অনুমানে ঈশ্বর-প্রমাণ হয় না। তাহলে সাধু-সন্তরা এই অনুমান-সাহায্যে ঈশ্বরের অবস্থিতি আমাদের কাছে প্রমাণ করতে গিয়েছিলেন কেন? তার উত্তরে বলা যায় যে তাঁদের মানসে ঈশ্বরের অনাদি সত্তা নিঃসন্দেহভাবে গোচর হয়েছিল এবং তাঁরা তাই জগৎকে ঈশ্বরের একটি উপাধি বা চিহ্ন-ভাবেই দেখেছেন—যেমন ধোঁয়া দেখে মানুষ ও বনের পশু। ধোঁয়া দেখলেই যেমন আগুনের জ্ঞান হয়—সাধু-সন্তদের এই জগৎ দেখলেই ঈশ্বরের জ্ঞান হয়। আর তাঁরা এই ধরনের প্রমাণ সাধারণের কাছে উপস্থিত করলেন এই ভেবে যে—মানুষের চেতনায় সুপ্ত রয়েছে এই ঈশ্বর জ্ঞান। এখন তাকে যদি বলা যায় সেই ঈশ্বরের কথা—তার মনে উদয় হতে পারে সেই জ্ঞান। জগতের মধ্যে যতটুকু শৃঙ্খলা আর উদ্দেশ্য-দেখতে পাই তার থেকেই মনে হতে পারে—এদের সঙ্গে যাঁকে দেখেছি চেতনার কোন্-সে-গোপন গভীর স্তরে—কোনো আদি যুগে।
প্রবাসজীবন চৌধুরী’র ‘ঈশ্বর-সন্ধানে’ থেকে