“সতত মনে রাখিও তোমার কর্মশক্তি কাহারও হইতে কম নহে, ইহার পরিচয় এবার পাইয়াছ তোমার কর্মশক্তিই যেন তোমার আশ্রয়দাতার শুভাশীর্বাদ আনয়ন করিয়া তোমাকে মহামুক্তির পথে পরিচালনা করিতে পারে।...” সঙ্ঘগীতায় কর্মশক্তির পরিচয়ের কথা যাহা বলিলেন, তাহা এমন কিছুই নয়। বাংলার বাইরে হিন্দী ভাষীদের নিকট যাইয়া প্রথম একা আদায়, এই যা। যাহা ঘটিয়াছিল তাহা এই—ডালটনগঞ্জে [বিহার] একা কালেক্সনে গিয়াছি। ৭০.০০/৭৫.০০ টাকা আদায় হইল। কিন্তু তারই কিছুদিন পূর্বে স্বামী সত্যানন্দ নওগাঁ আশ্রমের যে সব কর্মী ১৯২৪ এর পিতৃপক্ষ-রিলিফে গয়া আসিয়াছিল তাহাদের সবাইকে নিয়া বেশ তোড়জোড় করিয়া ঐ ডালটন্গঞ্জে গিয়াছিল, কিছু আদায় হয় কিনা দেখিতে। হয়ত স্থানীয় লোকের উৎসাহ তেমন পায় নাই। ফিরিয়া আসিয়াছিল। লোকের কথা না শুনিয়া একটু অগ্রসর হইলেই তাহারা আমার চাইতে অনেক বেশী আদায় করিতে পারিত। প্রচারও খুব হইত। কারণ, নেতা ছিল স্বামী সত্যানন্দ যার কর্মশক্তি সম্বন্ধে সঙ্ঘগীতার একটি চিঠিতে সঙ্ঘনেতা খুব প্রশংসা করিয়াছেন। বলিবার অভিপ্রায় এই যে, যাহারা ডালটনগঞ্জে যাইয়া ব্যর্থমনোরথ হইয়াছিল তাহাদের সাথে এই সন্তানের এমন একটা কীই বা পার্থক্য ছিল! তথাপি, রামচন্দ্রের ক্ষুদ্র কাঠবিড়ালীকে উৎসাহ ও আশীর্বাদ দিবার মতো ডালটনগঞ্জের অতি সামান্য কিছু আদায়কে উপলক্ষ্য করিয়া তিনি দীনাতিদীন একটি সন্তানকে এত বড় আশীর্বাদ করিয়া গেলেন। ধর্মক্ষেত্রে নেতৃত্ব করিবার ইহাই ত পরিচয়! পথপ্রদর্শকের এই ত রীতি! আদর্শপ্রতিষ্ঠার এই ত ধারা! হিন্দুনেতা ও হিন্দু জনসাধারণ পুনঃ পুনঃ বিচার করিয়া দেখুক যে, আধ্যাত্মিক স্বভাবসম্পন্ন হিন্দুজাতিকে পরিচালনা করিবার শক্তি যার-তার হয় না। কী অমর দেবসঙ্ঘের নায়কাধীনে কাজ করিবার অবসরই না ছিল আমাদের! দেবদুর্লভ কী সুযোগই না গিয়াছে! অকৃত্রিম অধ্যক্ষের মতো হাতে নাতে তিনি সব কাজ আমাদের শিখাইয়া গিয়াছেন, কোন দিকের কোন কিছুর বাকি রাখেন নাই। পুঙ্ক্ষানুপুঙ্ক্ষরূপে সে কথা আমাদের বুঝিতে হইবে। ভাসাভাসা নয়, উপরে উপরে নয়, পাতি পাতি করিয়া, তন্ন তন্ন করিয়া সঙ্ঘকে জানিবার প্রয়াস করিতে হইবে—সঙ্ঘনেতার নেতৃত্বের পরিচয়ে, জ্যেষ্ঠদের সৌভাগ্যের পরিচয়ে।
যাঁহারা তাঁহার নিজ হাতে গড়া সঙ্ঘসন্তান, ভুলিও না, সঙ্ঘের পরিচালক যাঁহারা, তাঁহারা কিন্তু ঠাকুরের নিজ হাতে গড়া—তাঁহার কোলে বসিবার সৌভাগ্য হওয়া, তাঁহার বক্ষোজামৃতে পুষ্ট হওয়া, তাঁহার প্রেমালিঙ্গনে শোধিত হওয়া, তাঁহার প্রণয়-চুম্বনে হলাদিত হওয়া ও প্রীতিবিনিময়ে কৃতার্থ হওয়া; ভুলিও না, এঁদের তিনি মাতৃযত্নে মানুষ করিয়া গিয়াছেন। কোন্ খাদ্য এঁদের হিতকর তার ব্যবস্থাও তিনিই করিতেন, হানিকর যা তার নিষেধও তিনি করিতেন। এঁদের বস্ত্রাদির ব্যবস্থা তিনিই করিতেন, বস্ত্রের পুনঃপ্রয়োজন তিনিই মিটাইতেন। সুস্থাবস্থায় এঁদের কর্মব্যস্ত রাখিতেন, অসুস্থ হইলে চিকিৎসা তিনিই করাইতেন। কর্মের নির্দেশ এঁদের তিনিই দিতেন, কর্ম্মান্তরে প্রেরণ তিনিই করিতেন। প্রচারকার্য্যে এঁদের তিনিই পাঠাইতেন, নিজের কাছে ডাকিয়া তিনিই আনিতেন। বিশ্রাম করিতে এঁদের তিনিই বলিতেন, এঁদের তিনিই জাগাইতেন। অর্থাৎ, এঁদের অস্থি মজ্জা শোণিত যেন তিনিই নির্মাণ করিয়া গিয়াছেন। উঠিতে বসিতে, চলিতে ফিরিতে, খাইতে পরিতে, প্রতিটী কার্য্যে প্রতিটী ব্যাপারে শ্বাসে প্রশ্বাসে তিনি এঁদের অঞ্চলের ভিতর রাখিতেন, আগলাইয়া ধরিয়া থাকিতেন, কোলে করিয়া রাখিতেন, এঁদের শিশুর মতো পর্য্যবেক্ষণ করিতেন। স্বামী অদ্বৈতানন্দজী বাজিতপুরে একবার শিশুভাবে আপ্লুত হইয়া দিনরাত তাঁহার আঁচল ধরিয়া ছিলেন।
স্বামী নির্ম্মলানন্দের ‘শ্রীশ্রীপ্রণবানন্দের—শত রূপে, শত মুখে’ থেকে