প্রাণপ্রয়াণপাথেয়ং সংসারব্যাধিভেষজম্।
দুঃখশোকপরিত্রাণং শ্রীরামেত্যক্ষরদ্বয়ম্।।
দেখ্, আমার এ নাম প্রাণপ্রয়াণের পাথেয়। তুই নাম কর্। আজ তোর দেহে প্রাণ আছে, কিন্তু চিরদিন তো থাকবে না। তোর এমন একটা দিন আসছে যেদিন তোর হস্তপদাদি সঞ্চালনের শক্তি থাকবে না, তোর চক্ষু আর কিছু দেখবে না, তোর জিহ্বা রস গ্রহণ করতে পারবে না বা কোন শব্দ উচ্চারণ করতে পারবে না। প্রাণ তোর দেহকে ত্যাগ করে চলে যাবে। ওই দেহটা হয় ভষ্মে, নয়ত কুকুর-শৃগালের বিষ্ঠায় পরিণত হবে। এতদিন প্রাণের পাথেয় সংগ্রহ করিস্ নি, প্রাণকে কিছু দিস্ নি—সে বিনা বেতনে তোর এই পঞ্চভূতের বোঝাটাকে বয়ে বেড়াচ্ছে। তোর উচিত ছিল প্রাণকে নামের বেতন দেওয়া; প্রাণের মাঝে নাম ফেলে দেওয়া; সে যেমন যাতায়াত করত—পলে পলে, ক্ষণে ক্ষণে, দণ্ডে দণ্ডে তার বেতন দেওয়া হত। যাবার দিন আর পাথেয়ের ভাবনা থাক্ত না। তুই যখন প্রতি শ্বাসে-প্রশ্বাসে প্রাণের বেতন দিস্ নাই—আর বেশীদিন সময় নাই, আজ হতে প্রাণে নামের পাথেয় দে অর্থাৎ সুষুম্নায় “রাম রাম” “হরি হরি” উচ্চারণ কর্—প্রাণপ্রয়াণের পাথেয় হবে। “হরি” এই অক্ষর দুটি প্রাণপ্রয়াণের অত্যুত্তম পাথেয়। দেখ্, নিকটবর্ত্তী স্থানে যেতে হলে পাথেয়ের প্রয়োজন হয়, আর সেই মহাপথের পাথেয় সংগ্রহ না করে কি প্রকারে নীরবে বসে আছিস্? তোর সম্মান, তোর আত্মীয়স্বজন, তোর স্ত্রী-পুত্র, তোর গৃহ, দ্বার, অর্থ—কেহ ত সঙ্গে যাবে না, সে পথের সঙ্গী কেহ হবে না, সে-পথের পাথেয় কেহ দিবে না—আর নীরব থাকিস্ না, নাম কর্। পুরাণ, সাংখ্য, উপনিষৎ, বেদ, বেদান্তাদি সকল শাস্ত্র ঘোষণা করছে—এইরূপ অনুষ্ঠান করলে আমায় পাওয়া যায়। শুধু নানা পথের সন্ধান জেনে লাভ কি? একটা পথ ধর্ না—নাম কর্ না। ‘বহু শাস্ত্রে ইনি পারদর্শী—এই সম্মানের জন্য কেন অমূল্য সময় ব্যয় করছিস্? অনন্ত শাস্ত্র, জ্ঞাতব্য বিষয় বহু; তুই সার অবলম্বন কর। সেই সার কি জানিস্? এই কলিযুগে নামই সার।
কিং করিষ্যতি সাংখ্যেন কিং যৌগৈর্নরনায়ক।
মুক্তিমিচ্ছসি রাজেন্দ্র কুরু গোবিন্দকীর্ত্তনম্।।
—সাংখ্যের কি প্রয়োজন? যোগের কি প্রয়োজন? ভক্তি প্রার্থনা করিস্—নাম কর্; মুক্তি প্রার্থনা করিস্—নাম কর্; আমায় দেখবার ইচ্ছা থাকে—নাম কর্। নাম প্রাণপ্রয়াণের পাথেয়, নাম সংসারব্যাধির ঔষধ।
আচ্ছা, সংসারকে রোগ বলছ কেন? সংসার রোগই ত। রোগের যেমন উপসর্গ প্রলাপ থাকে—এ সংসারে সবটাই উপসর্গ। প্রলাপের কথা বলিস না—প্রলাপ ভিন্ন বাক্যই নাই। দেখ্ রোগ হলে রোগী যেমন বলে—আমায় জল দাও, আমায় ও-ঘরে নিয়ে চল, আমি উপরে যাব, আমি বসব, আমি দাঁড়াব, আঃ, উঃ, মলাম—সেইরূপ ওই দেখ্, সংসার-ব্যাধি-পীড়িত লোকগুলো হা অর্থ, হা অর্থ, হা সম্মান, হা যশ, হা নীরোগ শরীর, হা বশ্যতাপন্ন স্ত্রী-পুত্র, হা সংসারের শান্তি—ইত্যাদি বলে, সর্ব্বদা হাহাকার করছে। এ সংসারে একটা ভীষণ মারাত্মক রোগ।
‘শ্রী ওঙ্কারনাথ-রচনাবলী’ (৩য় খণ্ড) থেকে