‘বেদ’ অর্থে আত্মজ্ঞান বা ব্রহ্মবিদ্যা। পাঠ অর্থে অনুশীলন। এই ব্রহ্মবিদ্যা বা যোগশাস্ত্র যিনি অনুশীলন করেন তিনিই বেদ পাঠ করেন। তাই গীতার প্রতিটি অধ্যায়ের শেষে বলা আছে—‘‘ইতি ব্রহ্মবিদ্যায়াং যোগশাস্ত্রে শ্রীকৃষ্ণার্জ্জুন সংবাদে...’’ অতএব, বেদ নামক ছাপা পুস্তকখানিকে বিধিপূর্বক মুখের উচ্চারণ করে অথবা মনে মনে পাঠ করাকে বেদপাঠ করা বোঝায় না। এটা সনাতন ধর্মের বাহ্যদিক। কিন্তু অভ্যন্তর দিকটা হল ব্রহ্মবিদ্যার অনুশীলন। এ বিষয়ে যোগিরাজ শ্রী শ্যামাচরণ লাহিড়ী মহাশয় পরিষ্কারভাবে বলেছেন, ‘‘ক্রিয়া করাই বেদপাঠ’’। এক্ষেত্রে ‘ক্রিয়া’ হল বেদ, ‘করা’ হল পাঠ। তিনি আরও বলেছেন—‘‘যো হম কহে সো বেদ হ্যয়, নিশ্চয় জানে।’’ অর্থাৎ আমি যে আত্মজ্ঞান বা ব্রহ্মজ্ঞানের কথা বলছি তাই বলছি, নিশ্চয় জেনো। তাহলে বোঝা গেল বেদ কোন গ্রন্থকে বোঝায় না। তাই আপনার শ্রদ্ধেয় পিতৃদেব ঠাকুর শ্রীসীতারামদাস ওঙ্কারনাথ পরিষ্কারভাবে বলেছেন যে ওরা বেদের কঙ্কাল নিয়ে নাড়াচাড়া করে। এ বিষয়ে উল্লেখ করছি যে যোগিরাজের এক বিখ্যাত শিষ্য শ্রীরামদয়াল মজুমদার মহাশয়ের নিকট থেকে শ্রীঠাকুর ক্রিয়াযোগে দীক্ষালাভ করেছিলেন। তাই তিনি সনাতন ধর্মের সত্যকার বেদ জেনে ছিলেন। এ কারণে শ্রীঠাকুর যোগিরাজ শ্রী শ্যামাচরণ লাহিড়ী মহাশয়কে অন্তর দিয়ে শ্রদ্ধা করতেন। এ বিষয়ে আর একটু জানাই যে ঐ দিন (১৩ই সেপ্টেম্বর) ঐ ‘ধর্মকর্ম’ পাতাতে যোগিরাজ শ্রীশ্যামাচরণ লাহিড়ী মহাশয়ের সম্বন্ধে কিছু কথা ছাপানো হয়েছে। সেজন্য ধন্যবাদ। যদিও তথ্যগুলির মধ্যে কিছু ভুল রয়ে গেছে তাই এখানে যোগিরাজের বিষয়ে উল্লেখ করলাম। যোগিরাজ শ্যামাচরণকে একজন নিছক মহাযোগী বললে ভুল করা হবে। তিনি তাঁর নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে নিজেই বলেছেন— হম হি কৃষ্ণ; হম হি মহাদেব; হম হি চতুর্ভুজ নারায়ণ; হম হি মহাপুরুষ পুরুষোত্তম; হম হি এক পুরুষ হ্যায় আউর কোই নেহি; হম হি অক্ষর পুরুষ; সূর্য নারায়ণ ভগবান জগদীশ্বর সর্বব্যাপী হম হ্যায়; হমারি রূপসে জগৎ প্রকাশিত; হম ছোড়ায় কোই নেহি; হমারা অনন্ত ক্ষমতা, যো চাহে সো কর সক্তা; হম হি আদি পুরুষ ভগবান; স্বয়ং ভগবান; হম হি নিরাকার ব্রহ্ম।
‘‘উপনয়ন’’ শব্দটির মধ্যে ‘সুতোর পৈতে ধারণ করা’কে বোঝায় না। ‘উপ’ অর্থে সমীপে বা নিকটে। ‘নয়ন’ অর্থে ত্রিনয়ন বা কূটস্থকে বোঝায়— এই দুই চর্মচক্ষুকে বোঝায় না। কারণ এই দুই চক্ষু ইন্দ্রিয়। কূটস্থ বা ত্রিনয়ন ইন্দ্রিয়াতীত। সেই নয়নের মাধ্যমে আত্মদর্শন বা ব্রহ্মদর্শন হয়। নয়নের কর্মই হলো দর্শন লাভ করা। গীতা বলেছেন ‘‘স্ত্রীয়া বৈশ্যা শুদ্রা...’’ সকলেই এই ব্রহ্মবিদ্যা অনুশীলনের যোগ্য, ক্রিয়া করার যোগ্য। এক্ষেত্রে কাউকে নিষেধ করা হয় নি। এ একেবারে শ্রীভগবানের কথা। এ কারণে অতীতে বহু নারী এই ব্রহ্মবিদ্যার অনুশীলন করতেন অর্থাৎ বেদপাঠ করতেন। কালপ্রভাবে কুশিক্ষার দরুন মানুষ ধীরে ধীরে এই যোগশাস্ত্র বা ব্রহ্মবিদ্যার অনুশীলন ভুলে গেল এবং ফলস্বরূপ উপনয়ন কেবলমাত্র বাহ্যিক আচার অনুষ্ঠানে পরিণত হল। তাই বর্তমানের মানুষ বেদ বলতে গ্রন্থকে এবং পাঠ বলতে বোঝে পড়াকে। অতীতে ব্রহ্মজ্ঞ যোগীপুরুষগণ শিষ্য বা ছাত্রদের গুরুগৃহে রেখে এইভাবে উপনয়নরূপী যোগশাস্ত্র বা ব্রহ্মবিদ্যা প্রদান করতেন।
বর্তমানে বাহ্যভাবে যে উপনয়ন সংস্কারপূর্বক আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দিয়ে থাকেন তখন প্রথমে উপবীত দক্ষিণ কাঁধে দেন। পরে সেটা ঘুরিয়ে বাম কাঁধে দেওয়া হয়। এই উপবীত মূলত দক্ষিণ কাঁধ থেকে বামপাশে যাবার বিধি আছে। এটা যোগশাস্ত্র বা ব্রহ্মবিদ্যার ওঙ্কার ক্রিয়ার প্রতীক। ধীরে ধীরে মানুষ ব্রহ্মবিদ্যার মাধ্যমে হৃদয়গ্রন্থি ভেদের এই গুহ্যতম রহস্যকে ভুলে গেল।
অশোককুমার চট্টোপাধ্যায়ের ‘ক্রিয়াযোগ বিজ্ঞান’ থেকে