শরীর ভালো যাবে না। সাংসারিক কলহ বৃদ্ধি। প্রেমে সফলতা। শত্রুর সঙ্গে সন্তোষজনক সমঝোতা। সন্তানের সাফল্যে ... বিশদ
দীর্ঘদিন ধরে কিডনির সমস্যার ভুগছিলেন। হার্টের সমস্যার জন্য পেসমেকারও বসাতে হয়েছিল। মাসে চারবার ডায়ালিসিস হতো। কিন্তু অদম্য জীবনীশক্তি আর সিনেমার নেশা ৭৭ বছর বয়সে এদিন মৃত্যুর কাছে হার মানল। প্রয়াত পরিচালকের স্ত্রী সোহিনী দাশগুপ্ত জানালেন, গত কয়েকদিন ধরেই বুদ্ধবাবুর শরীর ভালো ছিল না। ডায়ালিসিস চলা অবস্থাতেই ‘উড়োজাহাজ’ ছবির শ্যুটিং করা হয়েছিল। বুদ্ধবাবুর দুই মেয়ে অলকানন্দা ও রাজেশ্বরী শহরের বাইরে থাকায় করোনা পরিস্থিতিতে তাঁরা বাবার শেষকৃত্যে উপস্থিত হতে পারেননি।
এই বরেণ্য পরিচালকের প্রয়াণে শোকজ্ঞাপন করেছেন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর শোকবার্তায় লিখেছেন, ‘সিনেমার ভাষার মধ্যে তিনি ছন্দবোধ সম্পৃক্ত করেছিলেন। তাঁর মৃত্যু চলচ্চিত্র জগতের কাছে অপূরণীয় ক্ষতি।’
১৯৪৪ সালে ১১ ফেব্রুয়ারি পুরুলিয়ার আনাড়াতে জন্মগ্রহণ করেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। স্কটিশচার্চ কলেজ থেকে অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা করেন তিনি। অধ্যাপনার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। ১৯৬৮ সালে তথ্যচিত্র নির্মাণের মাধ্যমে চলচ্চিত্রে হাতেখড়ি। সত্যজিৎ রায় পরবর্তী যুগে বাংলা ছবিকে আন্তর্জাতিক পরিসরে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত ছিলেন অন্যতম। স্পেন, এথেন্স, বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে তিনি সম্মানিত হয়েছেন। আপোস শব্দটি তাঁর অভিধানে ছিল না। সিনেমার মাধ্যমে বারবার তিনি তাঁর সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। ‘স্বপ্নের দিন’, ‘উত্তরা’র জন্য জাতীয় পুরস্কারের মঞ্চে সেরা পরিচালকের শিরোপা পেয়েছিলেন। ‘দূরত্ব’, ‘তাহাদের কথা’ সেরা বাংলা ছবি হিসেবে পেয়েছিল জাতীয় পুরস্কার। ‘বাঘ বাহাদুর’, ‘চরাচর’, ‘লাল দরজা’, ‘কালপুরুষ’, ‘মন্দ মেয়ের উপাখ্যান’, ‘গৃহযুদ্ধ’, ‘নিম অন্নপূর্ণা’, ‘উড়োজাহাজ’, ‘টোপ’ একের পর এক অবিস্মরণীয় সৃষ্টি দিয়ে দর্শকদের বুঁদ করে রেখেছিলেন এই পরিচালক। বছর খানেক আগে তাঁর পরিচালিত হিন্দি ছবি ‘আনোয়ার কা আজব কিস্সা’ ওটিটি প্ল্যাটফর্মে মুক্তি পায়।
এদিন প্রয়াত পরিচালকের বাসভবনে উপস্থিত ছিলেন শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু, বারাকপুরের বিধায়ক রাজ চক্রবর্তী। এছাড়াও এসেছিলেন অভিনেতা শঙ্কর চক্রবর্তী, অনন্যা চট্টোপাধ্যায়, পাওলি দাম, দেবদূত ঘোষ, বাদশা মৈত্র, পরিচালক অশোক বিশ্বনাথন প্রমুখ। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের মধ্যে ছিলেন সিপিএমের রবিন দেব, এসএফআইয়ের রাজ্য সম্পাদক সৃজন ভট্টাচার্য।
ব্রাত্য বসু জানালেন, করোনা পরিস্থিতির জন্য পরিবারের লোকজন বুদ্ধবাবুর মরদেহ নিয়ে স্টুডিওতে কিংবা নন্দনে যেতে চাননি। অনাড়ম্বরভাবেই শেষকৃত্য সম্পন্ন করতে চেয়েছেন তাঁরা। রাজ বলছিলেন, ‘আমি বুদ্ধবাবুর ফ্যান। কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবের কাজ করতে গিয়ে তাঁর সঙ্গে নিবিড় আলাপ হয়েছিল।’ পাওলি বলছিলেন, ‘বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর মতো পরিচালকের সঙ্গে কাজ করাটাই স্বপ্ন সত্যি হওয়ার মতো। চরিত্র, অভিনয়, লুক সব বিষয়েই খুব খুঁতখুঁতে ছিলেন। উনি অভিনয়টা করিয়ে নিতে জানতেন।’
বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের মৃত্যুতে শোকের ছায়া টলিপাড়ায়। অভিনেতা প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় বললেন, ‘একে একে সবাই যেন হারিয়ে যাচ্ছেন। বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত শুধু ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতেরই নয়, আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র জগতের এক উজ্জ্বল নাম। সৌভাগ্যবশত তাঁর সঙ্গে দু’টি সিনেমা করার সুযোগ হয়েছিল। বুদ্ধদা মানুষ হিসেবেও ছিলেন অতুলনীয়।’ চন্দন রায় সান্যাল বললেন, ‘ছোটবেলায় দিল্লিতে একাধিক চলচ্চিত্র উৎসবে ওঁর ছবি দেখে বড় হয়েছি। স্বপ্নেও ভাবিনি যে, কোনও একদিন তাঁর ছবিতে অভিনয়ের সুযোগ পাব। তাঁর শেষ ছবিটির অংশ ছিলাম আমি।’
শেষদিন পর্যন্ত চিত্রনাট্য লেখার কাজে নিজেকে নিমগ্ন রেখেছিলেন সত্তরের দশকের এই কবি। ‘রোবটের গান’, ‘ছাতা কাহিনি’, ‘গভীর আড়ালে’ বুদ্ধবাবুর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ। ‘স্বপ্ন, সময় ও সিনেমা’ বইটিতে তিনি লিখেছিলেন, ‘সিনেমা আজও আমার কাছে স্রোতস্বিনী সময়ের ভেতর থেকে উঠে আসা স্বপ্নের মতো।’ সেই স্বপ্নের লোকেশন, স্বপ্নের চিত্রনাট্য আর স্বপ্নালু দু’টি চোখ যা দিয়ে বিশ্ব চলচ্চিত্র এতদিন ঋদ্ধ হয়েছে, সেই মানুষটার নিথর দেহ দুপুর ২টো নাগাদ কেওড়াতলা মহাশ্মশান থেকে স্বপ্নের চির উড়ানে পাড়ি দিল।