তেলিয়া রুমাল দক্ষিণ ভারতের ঐতিহ্য। আসল তেলিয়া শাড়ির সাজ কি আজও সম্ভব? বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে লিখলেন স্বরলিপি ভট্টাচার্য।
ছিল রুমাল, হয়ে গেল বেড়াল! ‘হ য ব র ল’-এ সুকুমার রায় মনে পড়ছে? কিন্তু বাস্তবেও রুমাল পাল্টে যায় বইকি। সে বেড়াল হয় না ঠিকই। কিন্তু শাড়ি তো হতেই পারে। তেলিয়া রুমাল শাড়ি এই পটপরিবর্তনের অন্যতম উদাহরণ। যা গরমে আপনার আরামের সঙ্গী হতে পারে। তবে আসল তেলিয়া রুমাল শাড়ি এখন বিলুপ্তপ্রায়। প্রথমত, যে পদ্ধতিতে তেলিয়া তৈরি করা উচিত, তা এখন আর সম্ভব হয় না। দ্বিতীয়ত, দামের হেরফের। আসল শাড়ি দামের দিক থেকেই বহু মানুষের নাগালের বাইরে। অথচ তেলিয়া রুমাল শাড়ি তো অনেকেই পরেন। সেগুলো তাহলে কী?
তেলিয়া রুমালের উৎপত্তি উনিশ শতকে অন্ধ্রপ্রদেশের চিরালায়। পরে তাঁতিরা তেলঙ্গানার নালগোন্দা জেলার পুট্টাপাকা গ্রামে গিয়েও এই শাড়ি তৈরি করতে শুরু করেন। স্থানীয়দের শাড়ি তৈরির প্রাচীন পদ্ধতি শিখিয়েও দেন। সম্প্রতি পুট্টাপাকার তেলিয়া রুমালকে ভৌগোলিক সূচক (জিআই) ট্যাগ দেওয়া হয়েছে।
‘তেলিয়া’র অর্থ তেল। বেশ কয়েক বছর নানা ধরনের শাড়ি নিয়ে কাজ করছেন ‘জয়ী’ বুটিকের কর্ণধার শিঞ্জিনী বিশ্বাস। তিনি বললেন, ‘প্রথমে তেলিয়া রুমাল হেড স্কার্ফ হিসেবে ব্যবহার করা হতো। পুরুষরা পাগড়ির মতো ব্যবহার করতেন। মাথা ঠান্ডা রাখার জন্য। পুরনো বইতেও তেলিয়া রুমালের যে ছবি পাওয়া যায়, সেটাও তেলিয়া রুমাল পাগড়িই। গরম, আর্দ্র পরিবেশে মাথা ঠান্ডা রাখার জন্য তেলে চুবিয়ে তৈরি হতো এই ধরনের পাগড়ি। পরে একই পদ্ধতিতে শাড়িও তৈরি করা শুরু হয়।’
কীভাবে তৈরি হয় তেলিয়া রুমাল শাড়ি? ‘ঐত্রিকা উইমেন অ্যাটায়ার’-এর কর্ণধার পারমিতা বসু ঘোষ বললেন, ‘শাড়ি বোনার আগে সুতির সুতো প্রথমে জল এবং গোবর অথবা ছাগলের মলে চুবিয়ে রেখে প্রি-প্রসেস করা হয়। এরপর তিলের তেল এবং ক্যাস্টর অয়েলে মিশিয়ে আরও ১৫ মিনিট ভিজিয়ে রাখা হয়। তারপর রোদ্দুরে শুকিয়ে নেওয়া হয়। ১৬ দিন এই পদ্ধতি অনুসরণ করে তা আবার করা হয়। এরপর সুতো ধুয়ে, শুকিয়ে শাড়ি বোনা হয়। টানা ২১ দিন এভাবে তেলে চুবিয়ে রাখার ফলে যে শীতল অনুভূতি তৈরি করে এই শাড়ি, তা বেশ বোঝা যায়। বলা হয়, মৎস্যজীবীরা এই ধরনের স্কার্ফ ব্যবহার করতেন। এটা মাথায় জড়িয়ে মাছ ধরতে গেলে, ওই কাপড়ে তেলের যে অন্যরকম একটা গন্ধ থাকে, তা মাছকে আকর্ষণ করে। ডবল ইক্কত পদ্ধতিতে বোনা হয় তেলিয়া রুমাল শাড়ি।’ এর ভিন্ন মতও রয়েছে। অনেকে বলেন, শাড়ি তৈরির শেষ ধাপে তেলে চোবানো হয়।
পারমিতা জানালেন, তেলিয়া রুমালের কিছু ঐতিহ্যবাহী রং রয়েছে। কালো, সাদা, লালের ব্যবহার এই ধরনের শাড়িতে খুব বেশি দেখা যায়। এখন সবুজ, নীলেও বোনা হচ্ছে। তাঁর কথায়, ‘বুননের আগেই সুতোয় কালার ট্রিটমেন্ট করা হয়। ফলে সেটা রং ধরে রাখতে সাহায্য করে।’ ফুল, পাখি, হাতি, সিংহ, চাকা, রঙ্গোলি এবং স্বস্তিক চিহ্নের মতো কিছু ঐতিহ্যবাহী মোটিফ এই শাড়িতে ব্যবহার করা হয়। ইদানীং ফিগার মোটিফও বোনা হচ্ছে শাড়িতে।
বছরের যে কোনও সময় তেলিয়া শাড়ি পরে স্টাইল করা যায়। তবে গরমে সবথেকে আরামদায়ক তেলিয়া রুমাল শাড়ি। যে কোনও বয়সের মহিলা এই শাড়ি পরতে পারেন। কিন্তু আসল তেলিয়া শাড়ি দামের কারণেই সাধারণের নাগালের বাইরে বলে জানালেন শিঞ্জিনী। তাঁর কথায়, ‘আমি মিউজিয়ামে রাখা একটা আসল তেলিয়া রুমাল শাড়ি দেখেছি। সেটার দাম অন্তত দু’লক্ষ টাকার কাছাকাছি বা তারও বেশি। ওটা কিন্তু বিক্রির জন্য নয়। তেলিয়া রুমালের একটা নিজস্ব নকশাদার স্টাইল রয়েছে। টাই অ্যান্ড ডাই পদ্ধতিতে বোনা হয়। অন্ধ্রপ্রদেশে পুট্টাপাকা, পচমপল্লি বা সংলগ্ন এলাকাতে তেলিয়ার মোটিফ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে শাড়ি তৈরি করা হচ্ছে। সেটা তেলিয়া রুমাল শাড়ি বলে বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু এগুলো আসলে ডবল ইক্কত। এই শাড়ি আমিও রাখি। তবে ক্রেতাকে বলে দিই, এটা ডবল ইক্কত। তেলিয়া রুমাল নয়।’
শাড়ি বাঙালির চিরকালীন স্টাইল স্টেটমেন্ট। যিনি সুন্দর করে শাড়ি পরতে পারেন, তিনি সাধারণত যে কোনও পোশাকেই স্বচ্ছন্দ। ইদানীং কি দক্ষিণের শাড়ির চাহিদা বেশি? শিঞ্জিনী বললেন, ‘দক্ষিণের শাড়ির কদর আমার ছোটবেলাতেও ছিল। মা, দিদাকে দেখেছি নানা ধরনের দক্ষিণের শাড়ি পরতেন। তবে তখন সাউথ কটন বা সাউথ সিল্ক, আমরা এটুকুই জানতাম। এখন গুগল বা সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে আমরা নামগুলো আরও ভালো করে জানতে পারছি।’ তেলিয়া আসলে এক ঐতিহ্যের স্মারক। সাধ্যমতো এই শাড়ি সংগ্রহে রাখলে তা একদিকে যেমন আপনার রুচির পরিচয় দেবে। তেমনই অন্যদিকে তাঁতির মুখেও হাসি ফুটবে। শাড়ি না পরতে চাইলে তেলিয়ার ওড়নাও ব্যবহার করতে পারেন। যে কোনও একরঙা কামিজ বা টপের সঙ্গে দারুণ মানায়।
তেলিয়া রুমাল শাড়ির যত্নে কী করবেন? হাতে বোনা যে কোনও শাড়ি ড্রাই ওয়াশ করিয়ে নেওয়াই ভালো। বাড়িতে হাতে কাচার ঝুঁকি নেবেন না। একবার রং উঠে শাড়িতে লাগলে তা একেবারে নষ্ট হয়ে যাবে। কোনওভাবেই ধোওয়ার পর রোদ্দুরে মেলবেন না। তাতে শাড়ির রং নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ড্রাই ওয়াশ করিয়ে আলমারিতে রেখে একটা সুতির রুমালে নিমপাতা বেঁধে শাড়ির পাশে রাখুন। এতে আর্দ্র আবহাওয়ায় পোকা হওয়ার সম্ভাবনা কমবে। একবার এই শাড়ি পরার পর হাল্কা হাওয়ায় রেখে ফের তুলে রাখতে পারেন।