ভারতের সংবিধানের ৩২৪ অনুচ্ছেদের অধীনে নির্বাচন কমিশনের ব্যাপক ক্ষমতা রয়েছে। এই ধারাটি কমিশনকে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনার ক্ষমতা দেয়। কমিশনের কর্মপদ্ধতি ‘আইনসম্মত’ এবং ‘নিরপেক্ষ’ বলেই বিশ্বাস করা হয়। সেজন্য রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করেই সারা দেশের কোটি কোটি মানুষ তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে বুথে যান। এই বিশ্বাসই গণতন্ত্রকে রক্ষা করে। তাই নির্বাচন কমিশনের উপর আস্থা হারালে গণতন্ত্রের ভিত নড়ে যাবে।
নির্বাচন ‘অবাধ’ ও ‘নিরপেক্ষ’ হবে বলে কমিশন অঙ্গীকার করলেও কমিশনের কর্মকাণ্ড নিয়ে সন্দেহ পোষণকারী মানুষের সংখ্যা আগের চেয়ে বাড়ছে। আমাদের দেশে নির্বাচন অনেকাংশেই অবাধ হয়। যেকোনও প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার, প্রার্থীদের ভোট না দিয়ে ‘নোটা’-য় ভোট দেওয়ার এবং কাউকে ভোট না দেওয়ার স্বাধীনতাও ভোটারদের রয়েছে৷ তবে বর্তমান নির্বাচন সুষ্ঠু বলা যাবে না। অনেকেই মনে করেন, নির্বাচন কমিশন এমন একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে যেটি কেন্দ্রীয় সরকারের ইচ্ছা অনুযায়ী কাজ করে।
নির্বাচন কমিশন নিয়োগে সরকারের তরফে সংশ্লিষ্ট আইনের সংশোধন ছিল এই ব্যাপারে প্রথম পদক্ষেপ। শাসক পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দল থেকে তাদের নেতা এবং সুপ্রিম কোর্টের একজন বিচারপতির (যিনি এই দুই পক্ষের কোনোটিরই অন্তর্ভুক্ত নন) সমন্বয়ে গঠিত একটি প্যানেলের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন নিয়োগ করা হতো। কিন্তু কমিশন নিয়োগে সরকারের নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে একটি সংশোধনী এনে, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতির পরিবর্তে প্রধানমন্ত্রীর মনোনীত অন্য একজন মন্ত্রীকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এই সংশোধনীটি, খেলার দলগুলোর মধ্যে একটি টিমের তরফে রেফারি নির্বাচন করে দেওয়ার মতোই হাস্যকর ব্যাপার।
গুরুত্বপূর্ণ লোকসভা নির্বাচন ঘোষণার দিনকয়েক আগে অজ্ঞাত কারণে একজন নির্বাচন কমিশনার পদত্যাগ করেন এবং ভোট ঘোষণার আগের দিন দু’জন নতুন নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ করা হয়। এতে স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা হিসেবে কমিশনের বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষুণ্ণ হয়েছে।
নির্বাচনকে ‘গণতন্ত্রের উৎসব’ বলা হলেও সর্বত্র তা পরিণত হয় টাকা-পয়সার মেলায়। সেন্টার ফর মিডিয়া স্টাডিজের একটি সমীক্ষা অনুসারে, ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের মোট খরচ ছিল ৬০ হাজার কোটি টাকার বেশি। ক্ষমতাসীন বিজেপি, তার ভিতরে একাই খরচ করেছিল ২৭ হাজার কোটি টাকা। এই হিসেবে, ৩০৩টি আসনে জয়ী বিজেপির প্রতিটি প্রার্থীর জন্য গড়ে ৮৯ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। গণতন্ত্রকে তারা যে স্বৈরাচারের পথ দেখিয়েছে, এই প্রসঙ্গে বাড়তি দৃষ্টান্ত নিষ্প্রয়োজন। এবার মোট খরচের বহর হতে চলেছে, আনুমানিক, সওয়া এক লক্ষ কোটি টাকার বেশি। শাসক দলকে দেওয়া হয়েছে অবাধে টাকা খরচের অনুমতি। অন্যদিকে, বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে প্রধান বিরোধী দলের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টগুলি! অন্যান্য দলকে নোটিস জারি করেছে আয়কর বিভাগ। সংগত প্রশ্ন ওঠে, এরপরে অনুষ্ঠিত নির্বাচন কীভাবে সুষ্ঠু হবে?
সাধারণ মানুষ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারছে না। এজন্যই বেড়ে চলেছে নির্বাচনী ব্যয়। লোকসভার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বী ব্যক্তিকে ২৫ হাজার টাকা জমা দিতে হবে। মনোনয়নপত্রের সঙ্গে জমা দিতে হয় হলফনামা এবং অন্যান্য নথি। এসব প্রস্তুত করার জন্য আইনজীবীর ফি-সহ আরও কয়েক হাজার টাকা খরচের বোঝা চাপে প্রার্থীদের ঘাড়ে। প্রচারের খরচ তো এরপর এবং এর বাইরে। যাঁরা শুধু ‘অবৈধ’ এবং ‘দুষ্ট’ ইলেক্টোরাল বন্ড কিনেছেন, তাঁরাই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন—পরিস্থিতিটা এমন হলে সাধারণ মানুষের গণতান্ত্রিক নস্যাৎ হয়ে হবে।
নির্বাচনী প্রচারেও সুষ্ঠু পরিস্থিতি নিশ্চিত করতে পারছে না কমিশন। ২১ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রীর ভাষণটি ছিল—কমিশনের তরফে জারি করা সমস্ত আদর্শ আচরণবিধির স্পষ্ট পরিপন্থী। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতি কমিশনের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে বিরোধী দলকে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। তিনি তো একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীর লোকদের ‘অনুপ্রবেশকারী’ এবং ‘অধিক সন্তান আছে’ বলে হেয় করেন। অবশেষে এই বিষয়ে বিজেপি সভাপতিকে চিঠি পাঠায় কমিশন—তাও প্রধানমন্ত্রীর নাম বা পদবি উল্লেখ না করেই। এমনকী, বিরোধী দলের ইস্তাহারে যেসব বিষয়ের উল্লেখ নেই, প্রধানমন্ত্রী সেটিকে প্রচারের ইস্যুতে পরিণত করেছেন। প্রধানমন্ত্রী বারবার প্রচার করেছেন যে, ‘ইন্ডিয়া’ জোট ক্ষমতায় এলে হিন্দুদের ঐতিহ্যবাহী সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে মুসলমানদের মধ্যে বিতরণ করে দেওয়া হবে। এমনকী, হিন্দু মহিলাদের ‘মঙ্গলসূত্র’-ও দিয়ে দেওয়া হবে অন্যদের! এই ধরনের অবমাননাকর বক্তব্যের পরও কমিশন নীরব রয়েছে। আকাশবাণী এবং দূরদর্শনের জন্য বর্তমান লেখকের তৈরি বক্তৃতা থেকে—নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ অনুসারে, দূরদর্শন এবং আকাশবাণীর কর্তৃপক্ষ নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের (সিএএ) অংশ থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেওয়ার জন্য বলেছেন। এই দাবি আশ্চর্যজনকভাবে পক্ষপাতদুষ্ট। অথচ, এমন ‘কঠোর’ এবং ‘দোর্দণ্ডপ্রতাপ’ প্রকৃতির একটি কমিশন প্রধানমন্ত্রী এবং অন্য বিজেপি নেতাদের বক্তৃতা শোনে না!
উত্তর ভারতের বেশিরভাগ নির্বাচনী এলাকায় রাম মন্দিরের ছবি এবং ভগবান রামের ছবি বিজেপির প্রচারের জন্য ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। দূরদর্শনের রামায়ণ সিরিয়ালে ভগবান রামচন্দ্রের ভূমিকায় অবতীর্ণ অরুণ গোভিল মিরাট আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এরপর থেকে যেদিকেই তাকান না কেন, অরুণ গোভিলকে রামচন্দ্রের ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে। এসব বিষয়ও কমিশনের নজরে আসেনি।
সাধারণত ভোটগ্রহণের পর, সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকার মোট ভোটার ও প্রদত্ত ভোটের সংখ্যা এবং প্রদত্ত ভোটের শতাংশ হার—দেরিতে হলেও ভোটের দিনই ঘোষণা করার কথা। এবং, এই সংক্রান্ত চূড়ান্ত পরিসংখ্যান ঘোষণা করার কথা ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই। কিন্তু প্রথম ও দ্বিতীয় দফায় ভোটগ্রহণের কয়েকদিন পরও কমিশন চূড়ান্ত পরিসংখ্যান প্রকাশ করেনি। অবশেষে, বিরোধীরা হট্টগোল করলে, এই পরিসংখ্যান কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। ততক্ষণে প্রথম দফা নির্বাচনের ১১ দিন এবং দ্বিতীয় দফার চারদিন কেটে গিয়েছে। ভোটের দিন প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুসারে, প্রথম দফায় ৬০ শতাংশ এবং দ্বিতীয় দফায় ৬০.৯৬ শতাংশ ভোট পড়েছে। কিন্তু কয়েকদিন পরে কমিশন যে পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে, সংখ্যাগুলো তাতে দেখানো হয়েছে—যথাক্রমে ৬৫.৫ শতাংশ এবং ৬৬.৭ শতাংশ। অর্থাৎ ৫.৫ শতাংশ এবং ৫.৭৪ শতাংশ বৃদ্ধির তথ্য সামনে এসেছে! কমিশন কোনও নির্বাচনী এলাকা বা বিধানসভা কেন্দ্র ভিত্তিক রেজিস্টার্ড ভোটারের সংখ্যা প্রকাশ করেনি। চূড়ান্ত পরিসংখ্যান প্রকাশে বিলম্ব, পরিসংখ্যানে নজিরবিহীন বৃদ্ধি এবং মোট ভোটারের সংখ্যা প্রকাশে ব্যর্থতা প্রভৃতি কারণে কমিশনের প্রতি আস্থা নষ্ট হতে পারে।
ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) সংক্রান্ত একটি মামলায় সুপ্রিম কোর্ট থেকে শংসাপত্র পেয়ে স্বস্তিতে নির্বাচন কমিশন। কিন্তু যন্ত্রগুলির নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে কারও কোনও সন্দেহ দূর করার ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের এই রায় যথেষ্ট নয়। আদালত এই যুক্তি বিবেচনা করেনি যে, ইভিএম নির্মাতারাই স্বীকার করেন যে যন্ত্রের ‘ফ্ল্যাশ মেমরি’ কিন্তু ‘রিপ্রোগ্রামেবল’। এছাড়া ব্রিটেন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি এবং জাপানের মতো টেকনোলজিক্যালি অ্যাডভান্সড দেশগুলি ইভিএম মারফত ভোটগ্রহণের ব্যবস্থা বাতিল করে দিয়েছে।
অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্রেটিক রিফর্মস (এডিআরসি) এবং কমন কজ রিপোর্ট করেছে যে, গত বছর মধ্যপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনে প্রদত্ত ভোটের চেয়ে ৭ লক্ষ ৩৯ হাজার ১০৪টি বেশি ভোট গণনা করা হয়েছিল! এই বিষয়ে তাঁরা সুপ্রিম কোর্টে মামলা করেছেন। কমিশন এই বিষয়েও নীরব।
নির্বাচন কমিশন বিশ্বাসযোগ্যতা হারালে তাতে গণতন্ত্রই ধ্বংস হবে। রেফারি কোনও একটি পক্ষ নিলে সেই খেলা একতরফা হয়ে যায় বইকি। উদ্দেশ্য কাউকে ‘জয়ী’ করার হলে, প্রক্রিয়াটি একইসঙ্গে অন্যদের ‘প্রতারিত’ করারও বটে। আমরা এটুকুই আশা করতে পারি যে, অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচনে কোনও ‘ম্যাচ ফিক্সিং’ হবে না।
লেখক সারা ভারত ফরওয়ার্ড ব্লকের সাধারণ সম্পাদক। মতামত ব্যক্তিগত