অর্পণ সেনগুপ্ত, কলকাতা: ‘গোপাল যেমন সুবোধ, রাখাল তেমন নয়। সে বাপ-মার কথা শুনে না, যা খুসী তাই করে, সারাদিন উৎপাত করে।’ অথবা ‘যখন আমি প্রথম চুরি করিয়াছিলাম, তুমি জানিতে পারিয়াছিলে। সে সময়ে যদি তুমি শাসন ও নিবারণ করিতে, তাহা হইলে আমার এ দশা ঘটিত না।’ (বানান অপরিবর্তিত) একটা সময় বাঙালির অক্ষর-শিক্ষার সূচনাপর্বে বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’ এভাবেই শিশুমনে বুনে দিত ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়ের প্রাথমিক বোধ। গোপালের মতো সুবোধ হয়ে ওঠা বা ভুবনের মাসির গল্পের মাধ্যমে চুরি না করার নীতিশিক্ষা মিলত তখনই। সেই পাঠ আবার ফিরে আসতে চলেছে প্রাথমিক শিক্ষায়। প্রথম শ্রেণিতে বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’-এর অংশবিশেষ রেখেই জমা পড়েছে কলা ও কর্মশিক্ষার প্রাথমিক স্তরের খসড়া বই। সিলেবাস কমিটির তরফে সেই বই গিয়েছে শিক্ষাদপ্তরের কাছে। তাতে প্রথম শ্রেণিতে বর্ণপরিচয়ের প্রথম ভাগ, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণিতে দু’টি ভাগই রাখা হয়েছে বলে খবর। উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, প্রথম শ্রেণির পড়ুয়াদের কথা ভেবে বর্ণপরিচয়ের পাঠ্যাংশ তাদের নিজেদের মতো করে পড়ার বা বলার সুযোগ থাকছে। সেক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরীয় শব্দ বা লিখনশৈলীর আঞ্চলিক এবং সরল বিকল্প ব্যবহার করা যাবে।
কেন বর্ণপরিচয় আনতে হল কলা এবং কর্মশিক্ষার মতো বিষয়ে? এর সঙ্গে যুক্ত শিক্ষকদের বক্তব্য, রাজ্যের স্কুলস্তরে নীতিশিক্ষা বিষয়টি নেই। রাখাল বা গোপালের মতো চরিত্রগুলির সঙ্গে পড়ুয়ারা একাত্ম হয়ে নীতিশিক্ষা পাবে। তারা বুঝবে, চুরি করা, কুবাক্য বা কটু কথা বলা, ঝগড়া বা মারামারি খারাপ কাজ। তাছাড়া, এগুলি পড়লে তাদের রিডিং স্কিলও বাড়বে। এই বিষয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল রিসাইটেশন। সেই কথা ভেবেও ‘বর্ণপরিচয়’ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
কিন্তু প্রথম শ্রেণির বাচ্চাদের পক্ষে বর্ণপরিচয় পাঠ একটু কঠিন হয়ে যাবে না? শিক্ষকরা জানাচ্ছেন, একেবারে হুবহু উচ্চারণ করে না পারলেও চলবে। কিছু শব্দ সরল করে পড়া যাবে। পুরুলিয়া, বাঁকুড়া বা এমন জেলা, যেখানে কথাবার্তায় আঞ্চলিক প্রভাব বেশি, সেখানকার শিশুরা স্থানীয় কথ্যভাষায়ও এটি পড়তে পারবে। পড়ে নিয়ে তা নিজের মতো করে নিজের ভাষাতে বলতেও পারবে ছাত্রছাত্রীরা।
শিক্ষামহল অবশ্য প্রাথমিকে বর্ণপরিচয় রাখা নিয়ে কিছুটা দ্বিধাবিভক্ত। একাংশের বক্তব্য, প্রথম শ্রেণির পড়ুয়াদের পক্ষে রিডিং পড়াটা বেশ কঠিন। এমনকী, দ্বিতীয় শ্রেণিতেও যুক্তাক্ষর পড়ার সমস্যা থাকে। তাই শিক্ষকরাই এটি পড়ে বুঝিয়ে দিলে ভালো হয়। তাছাড়া, নিজের মতো করে বিদ্যাসাগরের লেখা পরিবর্তন করে নেওয়া যায় কি না, সে প্রশ্নও উঠছে। অন্য মহলের বক্তব্য, নিজেদের মতো করে যদি বিদ্যাসাগরকে কচিকাঁচারা পড়ে উঠতে পারে, তাতে লাভ বই ক্ষতি নেই। রচয়িতার মূল উদ্দেশ্যও ব্যাহত হবে না। প্রসঙ্গত, বিভিন্ন ক্লাসে বিদ্যাসাগর ছাড়াও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নজরুল ইসলাম, সুকান্ত ভট্টাচার্যের লেখা থাকছে। এছাড়া, হাতের কাজ হিসেবে কাগজের অরিগ্যামি, বাগান তৈরির মতো বিষয়গুলি সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।