সাধুগণের মুখে শুনেছি, মন যখন তোমায় স্পর্শ করে, তখন শরীর রোমাঞ্চিত হয়, নেত্রে জল আসে; এরূপ তো আমার অনেক সময় হয়। মন যদি তোমায় স্পর্শ করে, তবে কেন আবার ফিরে এসে হাহাকার কর্তে থাকে? অপূর্ব্ব এ মনের রঙ্গ! কখন দেবতা কখন নারকী। মনটা যখন তোমার কাছে থাকে, তখন সে বড় ভাল থাকে; অভাব অভিযোগ কামনা কিছুই থাকে না। যখন তোমার কাছ থেকে চলে আসে, তখন বানরের মত এডাল থেকে ওডালে লাফালাফি করে; তার দুষ্টামির জ্বালায় অস্থির করে দেয়। তুমি ছাড়া আর আমার গত্যন্তর নেই! তাই তোমার চরণে শরণ নিলাম। তুমি আমার মন নাও। আরও শুনেছি, মনই মানুষের বন্ধ ও মোক্ষের কারণ। মনকে গলিয়ে ফেলতে না পারলে, বন্ধ-মোক্ষের হাত হ’তে কিছুতেই নিস্তার নেই। তাই মনকে গলাতে চাই, তুমি ত’ মহাদ্রাবক! তুমি আমার মনটাকে গলিয়ে দাও। আমি তোমাতে মনকে ফেলে রাখবো। দেখো, যেন সে কোনরকমে তোমার কাছ থেকে পালিয়ে আস্তে না পারে। দেখ, মনকে গলাবার একটা খুব ভাল উপায় আছে। তোমাকে একটু খাটতে হবে। মনতো বিষয়-দৃশ্য জগতের দিকে ছুটে পালাবে, যেমন পালাতে যাবে তুমি অমনি বিষয়কে আড়াল করে মনের সুমুখে দাঁড়িয়ো। সে যেদিকে ছুটবে, তুমি সেদিক আড়াল করে দাঁড়াবে। ক্রমে সকল রূপে, সকল রসে, সকল গন্ধে, সকল স্পর্শে, সকল শব্দে মন তোমার মধুময় স্পর্শ পেয়ে মেতে উঠবে। সে সব ভুলে গিয়ে তোমাতেই ডুবে থাকবে। এটুকু তুমি কি করতে পারবে না? বলো না? কথা কও না? দেখ, তোমার এ উপেক্ষা আমি জীবনে ভুলবো না। সব মনে করে রাখলাম। যেদিন দেখা হবে, যেদিন তুমি আমার সঙ্গে আদর করে কথা কইতে আসবে, সেদিন যা অভিমান কর্ব—তা মনেই আছে। আমি একেবারে অটল, অচল, নিস্পন্দ হয়ে থাকবো। তুমি ডাক্বে, উত্তর দিব না। তুমি সাধবে, গম্ভীরভাবে বসে থাক্বো। যেন তুমি কে! তোমার সঙ্গে আমার মোটেই জানাশুনা নেই। সেদিন, সেদিন তুমি খুব জব্দ হবে! কেমন, শুনছ? দূর তোর! এমন লোকের সঙ্গে মানুষ কথা কয়—না ভাব করে। নিবিড়-ঘন-গম্ভীর-শব্দ-রাশি, কখন আলো, কখন বিন্দু, মাঝে মাঝে বিদ্যুতের মতো স্পর্শ করেছো। শরীরটা রোমাঞ্চিত হয়ে উঠছে। ওগো ও নিষ্ঠুর! ওগো ও নব-দূর্ব্বাদলশ্যাম! ওগো ও অরূপ! আমায় কোথায় নিয়ে চলেছ? অজানা অচেনা দেশে কোথায় যাবো? কথা কবে না? দেখা দেবে না? তবু টেনে নিয়ে যাচ্ছ? না আমি যাব না—তোমার সঙ্গে যাব না। তুমি চলে যাও! যাও—চলে যাও! তোমায় আমি চাই না; আমি কোথাও যাবো না, এইখানেই থাকবো,—বেশ ত’! চাইনে বল্লেও ছাড়বে না—তথাপি টানবে? না, আমি যাবো না,—তোমার সঙ্গে আমি কিছুতেই যাবো না। আমায় আর তুমি ছুঁয়ো না; আবার স্পর্শ করছ; এতো বড় বিপদে ফেল্লে; মাঝপথে এনে দেখাও দেবে না,—কথাও কবে না—ছেড়েও দেবে না—একি ব্যাপার?
‘শ্রীওঙ্কারনাথ-রচনাবলী’(১৪ খণ্ড) থেকে