শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন, “মানবজীবনের উদ্দেশ্য ঈশ্বরলাভ, ঈশ্বর প্রেম, ঈশ্বরকে ভালবাসা। এ সংসারে ঈশ্বর-সাধন জন্য মানবজীবন পেয়েছ। ঈশ্বরের পাদপদ্মে কিরূপে ভক্তি হয়, তাই চেষ্টা কর।”
“প্রথমে চাই মনুষ্যত্ব—মানুষজন্ম। তারপর চাই মুমুক্ষুতা। মুমুক্ষুতা ব্যতীত ঈশ্বরের উপলব্ধি অসম্ভব। যখন ভগবানের জন্য তীব্র ব্যাকুলতা হবে, তখনই জানবে তুমি ঈশ্বরলাভের অধিকারী হয়েছ। তারপর চাই মহাপুরুষ সংশ্রয়—গুরুলাভ। গুরুপরম্পরাক্রমে যে শক্তি এসেছে, তার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন। তা ছাড়া মুমুক্ষুতা থাকলেও কিছু হবে না, গুরুকরণ আবশ্যক।” জীবজগতে মানুষই শ্রেষ্ঠ জীব। মানুষজন্ম অতি দুর্লভ। মানুষ ভিন্ন অন্য জীবের খাদ্য সংগ্রহ এবং বেঁচে থাকার সংগ্রামে সমগ্র জীবন ব্যয়িত। মানুষ বেঁচে থাকার সব উপাদান সংগ্রহ করার পরেও মন, বুদ্ধি এবং বিবেকের সাহায্যে অন্য চিন্তা করতে পারে। তারই ফসল প্রকৃতির নানা অজানা তথ্য আবিষ্কার করে বিজ্ঞানের জয়যাত্রা। যে মন বৈজ্ঞানিক গবেষণা করতে পারে, সেই মন ঈশ্বরচিন্তাও করতে পারে এবং পৃথিবীর অনেক মানুষ তা করেন। এই হিসাবে মানুষকে দুই শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে। যাঁরা ঈশ্বরচিন্তা করেন তাঁদের বলা হয় দৈবী স্বভাবসম্পন্ন মানুষ আর যারা নিজের বিদ্যা, বুদ্ধি, অর্থ বা শক্তির দম্ভে ঈশ্বরকে অবজ্ঞা করে, তাদের বলা হয় আসুরিক বা পশুস্বভাবসম্পন্ন মানুষ। পশুদের মতো পশু-স্বভাবসম্পন্ন মানুষ ঈশ্বরচিন্তা করে না।
এই ধরনের মানুষ সম্পর্কে শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন—“বদ্ধজীবেরা ঈশ্বর চিন্তা করে না। যদি অবসর হয় তাহলে হয় আবোল-তাবোল ফালতো গল্প করে, নয় মিছে কাজ করে।” বর্তমান পৃথিবীর আসুরিক স্বভাবসম্পন্ন মানুষ জড়বাদী সভ্যতার ভোগবিলাসে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে ঊর্ধশ্বাসে ছুটছে অর্থের সন্ধানে। লাভ হচ্ছে প্রচুর অর্থ, অর্থের দাপটে এক একজন মানুষ পরিণত হচ্ছে কংস বা রাবণের মত দুর্ধর্ষ দানবে। অর্থের জোরে পৃথিবী এবং পৃথিবীর মানুষকে এরা করতে চাইছে ক্রীতদাস। দানবীয় শক্তির প্রচণ্ডতায় এরা অস্বীকার করছে স্রষ্টা ভগবানকে। জড়বাদী শিক্ষার বিকৃত জ্ঞানে আসুরিক স্বভাবসম্পন্ন মানুষ ভগবান সম্পর্কে যা ভাবে, বহুকাল আগে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গীতার ১৬ অধ্যায়ে তা পরিষ্কার করে বলেছেন—
অসত্যমপ্রতিষ্ঠং তে জগদাহুরনীশ্বরম্।
অপরস্পরসম্ভূতং কিমন্যৎ কামহৈতুকম্।।
আসুর প্রকৃতিসম্পন্ন ব্যক্তিগণ বলে থাকে যে, এই জগতে সবই অসত্য বা এই জগৎ ঈশ্বরহীন; ধর্ম বা অধর্ম এখানে কিছুই নেই। এ জগতের নিয়ন্তা কোন ঈশ্বর নেই। স্ত্রী-পুরুষগণ কামবশে পরস্পর মিলিত হওয়ায় এই জগতের সৃষ্টি হয়েছে। তা ছাড়া এর অন্য কোন কারণ নেই।
প্রভাস দাশ ও দীপক কুমার সরকার সঙ্কলিত ‘দীক্ষার আগে ও পরে’ থেকে