অমৃতকথা

বাস্তব উপেক্ষা করেই সঙ্কটে অর্থনীতি
পি চিদম্বরম

অর্থনীতিবিদের অভাব নেই। ব্যাঙ্ক বিষয়ক অর্থনীতিবিদও আছেন অনেক। যদি কিছু অর্থনীতিবিদকে বিশ্বাস করেন, তাহলে আপনি ভাববেন যে ভারতের অর্থনীতি বা অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় কিছুই ভুল নেই, বরং আরও ভালো চলছে বলেই মনে হবে, ভুল কিছুতেই হতে পারে না। যদি ব্যাঙ্ক বিষয়ক অর্থনীতিবিদদের বিশ্বাস করেন, তাহলে মনে করবেন যে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক (আরবিআই) একেবারে স্বর্গীয় অবস্থানে বিরাজমান এবং ভারতের অর্থনীতির সবই ঠিকঠাক চলছে (যতক্ষণ না আরবিআই এই ধারণার বিপরীত কোনও ইঙ্গিত আমাদের দিচ্ছে)। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের আনুগত্যের ভিতরে অতীতের সত্যতাও আমি প্রত্যাশা করি।
বর্তমান সরকারের দশবছর পূর্ণ হবে ২০২৪-এর ৩০ মে। আমরা সেই দশম বর্ষের শেষার্ধে প্রবেশ করেছি গত ১ অক্টোবর। এই প্রশাসনের পক্ষে ২০২৪ সালের এপ্রিল এবং মে মাস অঘোষিত ছুটি হিসেবে অতিবাহিত হবে। সুতরাং দেশের অর্থনৈতিক হালহকিকত পর্যালোচনা করার জন্য এটাই উপযুক্ত সময়।
ভারতের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতির অবস্থা জিডিপি বৃদ্ধির হার দিয়েই সবচেয়ে ভালো অনুধাবন করা সম্ভব, যা অন্য কোনও মেট্রিক দিয়ে পাওয়া যাবে না। তাই বিজেপির দশবছর শাসনকালের বৃদ্ধির হার দিয়েই শুরু করি। ন্যাশনাল স্ট্যাটিস্টিক্যাল অফিসের (এনএসও) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রথম ন’বছরে গড় বৃদ্ধির হার ছিল ৫.৭ শতাংশ। সরকারের তরফে ২০২৩-২৪ সালের জন্য ৬.৫ শতাংশ অনুমিত বৃদ্ধির হার যোগ করলে দশ বছরের গড় দাঁড়াবে ৫.৮ শতাংশ। ইউপিএ-১ এবং ইউপিএ-২ আমলে অর্জিত বৃদ্ধির হারের সঙ্গে এই সংখ্যাটির তুলনা করা যেতে পারে। ইউপিএ-১-এর পাঁচবছর কালে বৃদ্ধির গড় ছিল ৮.৫ শতাংশ। তবে, ইউপিএ-১ ও ইউপিএ-২ দুটি সরকারের দশবছর কালের গড় কিছুটা কমেও ৭.৫ শতাংশ ছিল।
কিছু অর্থনীতিবিদ ১.৮ শতাংশের পতনকে উল্লেখযোগ্য নয় বলে উড়িয়েও দিতে পারেন। কিন্তু সেটা করলে সম্পূর্ণ ভুলই হবে। জাতীয় নিরাপত্তা, পরিকাঠামোগত ব্যয়, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, কল্যাণমূলক ব্যবস্থাদি, পারিবারিক উপভোগ, সঞ্চয়, গরিবি কমানো এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রের উন্নয়ন প্রভৃতিতে বৃদ্ধির এই পতনের যে প্রভাব পড়ে সেটা গুরুতর।
দুটি প্রধান উদ্বেগের বিষয়
মূল্যবৃদ্ধি এবং বেকারত্ব—এই দুটি জিনিস সাধারণ মানুষের সবচেয়ে উদ্বেগের কারণ। ধনী ব্যক্তিদের কথা বাদ দিন। ধরা যাক, তারা জনসংখ্যার উপরের দিকের ১০ শতাংশ। এর বাইরে যে বিপুল সংখ্যক পরিবার রয়ে গিয়েছে, আয়ের সঙ্গে খরচের তালমিল করতে গিয়ে তারা হিমশিমই খাচ্ছে। অল ইন্ডিয়া কনজিউমার প্রাইসেস ইনডেক্স (নয়া সিরিজ) ২০১৩-১৪ সালে ছিল ১১২। সেটাই ১৭৪-এ গিয়ে দাঁড়িয়েছে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে। খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছেছে। এই অবস্থায় প্রথমেই গৃহস্থালির খরচখরচার উপর কোপ পড়ে। আয়ের প্রতিটি স্তরের মানুষ সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে দু’ভাবে—পারিবারিক খরচ কমিয়ে অথবা তাদের সঞ্চয় ভেঙে ফেলে। তার ফলে পারিবারিক আর্থিক সম্পদ নেমে এসেছে ৫.১ শতাংশে। বেশি বিক্রির ভোগ্যপণ্যের (এফএমসিজি) কোম্পানিগুলি তাদের ব্র্যান্ড বা ব্যবসা ধরে রাখেত পুরনো দামে ছোট প্যাকেজ চালু করেছে। দাম বৃদ্ধির ছাপটা পারিবারিক ভোগব্যয়কে কতটা ধাক্কা দিয়েছে তার বড় ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে টু হুইলার বিক্রির সংখ্যা হ্রাসের মধ্যে। 
মারাত্মক উদ্বেগের আর একটি বিষয়টি হল বেকারত্ব। সরকার যেমন দাবি করেছিল, গত দশবছরে সেইভাবে লক্ষ লক্ষ নতুন কর্মসংস্থান হয়নি এবং অবশ্যই পূরণ হয়নি বছরে ২ কোটি চাকরির প্রতিশ্রুতি (এজন্যই এটাকে ভোটের ‘জুমলা’ বলা হয়েছে)। পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে, গত একদশকে (একটি বছর ছাড়া) প্রতিবছরই বেকারত্বের হার ৭ শতাংশের উপরে রেকর্ড হয়েছে। স্টেট অফ ওয়ার্কিং ইন্ডিয়া ২০২৩ রিপোর্ট অনুসারে, স্নাতক যুবদের মধ্যে বেকারত্বের হার ৪২ শতাংশ। ২০২২ সালে যুবকদের (১৫-২৪ বছর) মধ্যে বেকারত্বের হার ২৩.২২ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছে। বর্তমানে ‘কর্মসংস্থান’-এর বেশিরভাগটাই হচ্ছে স্বনিযুক্তির মাধ্যমে। স্বনিযুক্তির হালফিল শতাংশ হার ৫৭। নিয়মিত বেতনভোগী শ্রমিক কর্মচারীর শতাংশ হার ২৪ থেকে ২১-এ নেমে এসেছে। সিএমআইই যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে—মোদি জমানায় ২০১৫-২০২৩ সময়কালের মধ্যে সরকারি চাকরি ২২ শতাংশ কমে গিয়েছে!
বিশেষ পর্যবেক্ষণ
অর্থমন্ত্রক তাদের মাসিক রিভিউ রিপোর্ট প্রকাশ করে থাকে। সেপ্টেম্বর, ২০২৩-এর  রিভিউ রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়েছ গত ২৩ অক্টোবর। তাতে সাঙ্কেতিক ভাষায় বলা হয়েছে: সাম্প্রতিক বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গির ঝুঁকি, ক্রমাগত ব্যয়ের চাপ, আশঙ্কাজনকভাবে মুদ্রাস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি, উচ্চতর দীর্ঘ মেয়াদি পলিসি রেট, লিকুইডিটি এবং ক্রেডিট রিস্কের এলোপাতাড়ি পুনর্মূল্যায়ন, পণ্যের জোগানে ঘাটতি প্রভৃতি পণ্যের বাজারকে বিপাকে ফেলছে এবং বাড়িয়ে দিচ্ছে বিদ্যুৎ মাশুল। এই পর্যালোচনার চূড়ান্ত কথাটি হল—অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি অন্ধকার, বৃদ্ধি হবে মন্থর, জিনিসপত্রের দাম বাড়বে, চড়া হবে সুদের হার, পরিবারের ভোগব্যয় কমে যাবে, হ্রাস পাবে মানুষের সঞ্চয়ের পরিমাণ এবং বেড়ে যাবে তাদের ধারদেনা। 
একটি রেটিং সংস্থার এক অর্থনীতিবিদ সম্প্রতি লিখেছেন, ‘ব্যাঙ্ক ঋণ বৃদ্ধি হার বেশ তেজিভাবেই ১৫ শতাংশের উপর রয়েছে, খুচরো ঋণ বৃদ্ধির হারটা আরও বেশি—১৮ শতাংশের উপর।’ তথ্যাদি বিশ্লেষণ করলে পরিষ্কার হয়ে যায় যে, ঋণ বৃদ্ধির প্রবণতাটি আসলে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে পার্সোনাল লোন (২৩ শতাংশ) এবং গোল্ড লোন (২২ শতাংশ) বৃদ্ধির হারের দ্বারা। এই সত্যটি আপনি জেনে ফেলার আগে পর্যন্ত অবশ্য পরিসংখ্যানটি আপনার কাছে সত্যিই ভালোলাগার মতো। ২০২৩ সালের আগস্টে শিল্প ক্ষেত্রে ঋণ বৃদ্ধির হার ছিল মাত্র ৬.১ শতাংশ। বিগত চারটি ত্রৈমাসিকে দেশবাসীর গড় মাসিক আয় ৯.২ শতাংশ কমে গিয়েছে (১২,৭০০ টাকা থেকে নেমে এসেছে ১১,৬০০ টাকায়)। গ্রাম ভারতের দিনমজুরদের হাল হয়েছে আরও খারাপ। তাদের গড় দৈনিক মজুরির পরিমাণ ৪০৯ টাকা থেকে ৩৮৮ টাকায় নেমে এসেছে। একটি স্বাভাবিক অনুমান এই যে, পার্সোনাল লোন এবং গোল্ড লোন ভোগব্যয়ের জন্যই নেওয়া হয়ে থাকে। তথ্যাদির আবোল-তাবোল পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণের ফল অর্থনীতির জন্য সুখপ্রদ হতে পারে না।  
তিনটি বিকল ইঞ্জিন
অর্থনীতিবিদরা এই ব্যাপারে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন যে, যখন বেসরকারি বিনিয়োগ, ব্যক্তিগত খরচ এবং রপ্তানি থম মেরে রয়েছে তখন শুধুমাত্র সরকারি বিনিয়োগের ইঞ্জিন চালু থাকছে। রপ্তানিতে গতি সঞ্চার, ব্যক্তিগত বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে উৎসাহ এবং কেনাকাটার জন্য নাগরিকরা যাতে আরও খরচাপাতি করেন—তার ব্যবস্থা গড়ে তোলার উপায় রয়েছে। সমস্যা এবং উদ্বেগের সত্যটি সরকার যতক্ষণ অস্বীকার করে চলবে, সেই পথ ও সুযোগ ততক্ষণ অধরাই রয়ে যাবে। এই যে হেমন্তে আমরা প্রবেশ করেছি এটি কঠিন, আরও কঠোর হতে পারে শীতকাল এবং কেবল আশা করতে পারি যে বসন্ত আমাদের জন্য অনেক আনন্দ বয়ে আনবে।
লেখক সাংসদ ও ভারতের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী। মতামত ব্যক্তিগত
8Months ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
বিশেষ নিবন্ধ
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

পারিবারিক অশান্তির অবসানে গৃহ সুখ ও শান্তি বাড়বে। প্রেমের ক্ষেত্রে শুভ। কর্মে উন্নতি। উপার্জন বৃদ্ধি।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.২৬ টাকা৮৪.৩৫ টাকা
পাউন্ড১০৬.৪৬ টাকা১০৯.১২ টাকা
ইউরো৮৯.৭৬ টাকা৯২.২০ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা