আমরা: ‘মহারাজ মুক্তি তো দু’রকম—জীবন্মুক্তি ও বিদেহমুক্তি?’
স্বামীজী মহারাজ: ‘মুক্তি সাধারণত তিন রকম,—জীবন্মুক্তি, বিদেহমুক্তি ও ক্রমমুক্তি। ক্রমমুক্তির কথা গীতা স্বীকার করে। অদ্বৈতবেদান্তে প্রধানত জীবন্মুক্তি ও বিদেহমুক্তির আলোচনা আছে,— তাও শঙ্করপন্থীদের মধ্যে দু’রকম অদ্বৈত-যুক্তিবাদীদের মধ্যে। শঙ্কর জীবন্মুক্তি স্বীকার করেন। আমরাও তাই। শ্রীশ্রীঠাকুরের সিদ্ধান্তও তাই।
‘কি জানো?—শরীর থাক্বে এবং জীবিতকালেই ব্রহ্মের উপলব্ধি হবে—এর নামই জীবন্মুক্তি, আর শরীর বা অজ্ঞান থেকে সৃষ্টি জড়শরীর নষ্ট হ’লে, কিংবা অদ্বৈতসাধনায় বিচার করতে করতে জড়শরীরের নাশের বা মৃত্যুর পর যে ব্রহ্মের উপলব্ধি, তার নাম বিদেহমুক্তি। বি-দেহ,—অর্থাৎ অজ্ঞান বা অবিদ্যার কার্য বা পরিণাম শরীর এবং তার নাশের পর ব্রহ্মোপলব্ধি—এর নাম বিদেহমুক্তি। প্রতিটি প্রাণীর মধ্যে চৈতন্যময় আত্মা ফবং সমস্ত প্রাণী, পদার্থ ও বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে পরিব্যাপ্ত যে বৃহৎ ও অখণ্ড-চৈতন্য পরমাত্মা এ’দুটির মধ্যে যখন ঐক্য-জ্ঞান হয় তখনই ব্রহ্মানুভূতি হয়। ব্রহ্মের জ্ঞান ব্রহ্মজ্ঞান নয়, ব্রহ্মই জ্ঞান। বেদান্তে একে সার্বিকজ্ঞান বলে,—অর্থাৎ যে ব্রহ্মের স্বরূপ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সকল প্রাণীতে ও পদার্থে ওতপ্রোতভাবে বর্তমান। এরই নাম সার্বিকজ্ঞান। ঈশোপনিষদের প্রথম মন্ত্রই তাই—‘ঈশা বাস্যমিদং সর্বম্, যৎকিঞ্চ জগত্যাং জগৎ’। এই জ্ঞান কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে দিয়েছিলেন তাঁর অজ্ঞান ও মোহ নষ্ট করার জন্য। শ্রীকৃষ্ণ বলেছিলেন—
ন তু মাং শক্যসে দ্রষ্টুমনেনৈব স্বচক্ষুষা।
দিব্যং দদামি তে চক্ষুঃ পশ্য মে যোগমৈশ্বরম্।।
অর্জুনের ঐ দিব্যচক্ষুই অলৌকিক ও অসাধারণ জ্ঞানময় চক্ষু। জড়-চর্মচক্ষু দিয়ে চৈতন্যকে দর্শন করা যায় না।
আমরা জিজ্ঞাসা কর্লাম: ‘মহারাজ, শুনেছি যে, অদ্বৈতজ্ঞানরূপ জীবন্মুক্তির আশীর্বাদ না পেলে ব্রহ্মানুভূতিলাভ করা যায় না, কিন্তু জীবন্মুক্তিও তো সকল অদ্বৈতবাদীরা স্বীকার করেন না, তাই অনেকে বলেন যে, বিদেহমুক্তিই শাস্ত্রসঙ্গত, কেননা জীবন্মুক্তিতে দেহ থাকে, সুতরাং কিছুটা অজ্ঞান থাকে, আর কিছুটা অজ্ঞান থাক্লে ব্রহ্মজ্ঞানই বা হবে কেন? শ্রীকৃষ্ণ গীতায় নিজেই স্বীকার করেছেন যে, জ্ঞানরূপ অগ্নি সমস্ত কার্য ধ্বংশ করে,—‘জ্ঞানাগ্নিঃ সর্বকর্মাণি ভস্মাসাৎ কুরুতেহর্জুন’। দেহরূপ এক্টু অজ্ঞান থাক্বে, অথচ ব্রহ্মাজ্ঞানের উপলব্ধি হবে—এটাই বা কেমন ক’রে হয়! একটু অজ্ঞানও তো অজ্ঞান বা অবিদ্যা?,—সুতরাং অবিদ্যা থাক্তে বিদ্যা বা জ্ঞান হয়—একথা অসঙ্গত বলে মনে হয়’।
স্বামীজী মহারাজ: “সে’কথা তো পূর্বেও তোমাদের বলেছি যে, শঙ্কর ও বহু শঙ্করমতাবলম্বীরা জীবন্মুক্তি মানেন, কিন্তু আবার বহু অদ্বৈতবাদী
শরীর-থাকা-কালে মুক্তি অর্থাৎ জীবন্মুক্তি স্বীকার করেন না। তাঁরা বলেন যে, অজ্ঞানরূপ শরীর থাক্লো আবার ব্রহ্মজ্ঞানও হ’লো,—এ’ ক্যামন ক’রে হয়?’
‘তোমরা ব্রহ্মসূত্রের চতুর্থ সূত্র—‘তত্তু সমন্বয়াৎ’-এর উপর শঙ্করভাষ্যটা পড়্বে, তাহলেই শঙ্করের বক্তব্য বুঝ্তে পার্বে’।
স্বামী প্রজ্ঞানানন্দের ‘মন ও মানুষ’ (৩য় ভাগ) থেকে