দেশে চতুর্থ পর্যায়ের আনলক প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। একদিকে টিকা আবিষ্কারের প্রচেষ্টা চলছে, অন্যদিকে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে করোনা সংক্রমণ। এখন পরিস্থিতি ঠিক কীরকম? কী লেখা রয়েছে ভবিষ্যতের খাতায়? ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করলেন রাজ্য সরকারের করোনা মোকাবিলার বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্য তথা পিজি হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের প্রধান ডাঃ সৌমিত্র ঘোষ।
 পরিসংখ্যান কখন চিন্তার— প্রথমেই একটা কথা বলি, অতিমারির সংক্রমণের সংখ্যার তুলনায় সেই অতিমারিতে সময়ের সঙ্গে মৃত্যুর হার বাড়ছে কিনা, সেটা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ৩১ আগস্টের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ভারতে দৈনন্দিন আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ৮০ হাজার ছুঁয়েছে। নিঃসন্দেহে চিন্তার বিষয়। উল্টোদিকে এটাও দেখতে হবে যে দৈনন্দিন কোভিড পরীক্ষার সংখ্যাও বেড়ে হয়েছে প্রায় সাড়ে আট লক্ষ। তার মানে একসময়ে যেখানে আক্রান্তের হার ১৫ শতাংশ পেরিয়েছিল, তা এখন কমে হয়েছে ৯.৩৮ শতাংশ। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে সেটা এখন ৭ শতাংশেরও নীচে নেমেছে। অন্যদিকে করোনা আক্রান্তদের সেরে ওঠার হার বেড়ে হয়েছে প্রায় ৭৬ শতাংশ। মৃত্যুর আশঙ্কা এখন কমে হয়েছে ১.৭৮ শতাংশে।
যে কোনও রোগেই মৃত্যুর হার ২ শতাংশের নীচে থাকাটা কিন্তু ভালো ইঙ্গিত। একটু পিছিয়ে গেলে দেখা যাবে, সার্স বা ইবোলা ভাইরাসের ক্ষেত্রে রোগী মৃত্যুর হার ছিল যথাক্রমে প্রায় ৩৫ শতাংশ ও প্রায় ৫০ শতাংশ! তাই বলাই যায়, করোনাকে নিয়ে আতঙ্কে ভোগার দরকার নেই। এখনও পর্যন্ত দেশের মোট জনসংখ্যার ১ শতাংশেরও কম মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। করোনা ভাইরাসের রিপ্রোডাক্টিভ রেট বা ‘আর ভ্যালু’ বা বৃদ্ধির হারও এখন ১ শতাংশের নীচে। তাই এই পরিসংখ্যানগুলো দেখে আমি তো বলব, এটা একটি ‘ওভার হাইপড’ এপিডেমিক।
 দেশে করোনা পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে— দেশে করোনা পরিস্থিতি এখন ভালো না খারাপ, এই প্রশ্নও অবান্তর। কারণ যত দিন যাবে আরও বেশি পরিসংখ্যান ও নতুন নতুন তথ্য সামনে আসবে। তবে হ্যাঁ, ভবিষ্যতে আরও বেশি সংখ্যক মানুষকে যদি চিকিৎসার মাধ্যমে সারিয়ে তোলা যায়, তাহলে অবশ্যই পরিস্থিতি ভালো হবে। অন্যদিকে এটাও ঠিক যে এখনও পর্যন্ত দেশের বড় শহরগুলোতেই করোনা আক্রান্তের হার বেশি। কিন্তু আগামী দিনে পরিবহণ ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে শুরু হওয়ার পর গ্রাম- শহর যোগসূত্র তৈরি হলে, গ্রাম ও মফস্‌সলে সংক্রমণ আরও বাড়তে পারে। তার পরেও মৃত্যুর হার যদি না বাড়ে, তাহলে পরিস্থিতি যে একেবারে নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে, তা বলা যাবে না।
 বাজার হাট ও গোষ্ঠী সংক্রমণ— গোষ্ঠী সংক্রমণ নিয়েও বিভিন্ন মত শুনছি। উৎস খুঁজে না পেলে সেক্ষেত্রে গোষ্ঠী সংক্রমণের কথা বলা যেতে পারে। তার উপরে এখনও সব জায়গায় সেরো সার্ভে করা হয়নি। করোনার ক্ষেত্রে সংক্রমণের একটা বড় উৎস কিন্তু আমরা খুঁজে পেয়েছি। সেটা হল স্থানীয় বাজার। বিগত কয়েক মাসে বাজারের অতিরিক্ত ভিড়ের ছবি তো সকলেরই জানা। তাই এখনও সাবধান না হলে নিজের বিপদ নিজেই ডেকে আনবেন। এরকমও শুনছি যে শীতকালে নাকি করোনা শেষ হবে। ফলে অনেকেই ধরে নিচ্ছেন, চলতি বছরের শেষে ভাইরাসের হাত থেকে মুক্তি মিলবে। অনুরোধ করছি, এরকম অযৌক্তিক দাবির ফাঁদে পা দেবেন না। এক ব্যক্তির দেহ থেকে অন্য ব্যক্তির দেহে করোনা সংক্রামিত হয়। শরীরের মধ্যেই ভাইরাসের বংশবৃদ্ধি হয়। তাই পারিপার্শ্বিক আবহাওয়া বা তাপমাত্রার পরিবর্তনের সঙ্গে মানুষ থেকে মানুষে এই ভাইরাসের সংক্রমণ বাড়া-কমার সম্পর্কের প্রামাণ্য নথি এখনও মেলেনি।
 পরিস্থিতি যেমনই হোক, স্বাস্থ্যবিধি মানুন— আসা যাক ভ্যাকসিন প্রসঙ্গে। ভাইরাস কিন্তু আমাদের চারপাশেই থেকে যায়। অবশ্যই তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলা যেতেই পারে। প্রতি বছর জ্বর-সর্দি-কাশি তো ভাইরাসেরই ফল। তাই টিকা আবিষ্কার হলেও যে সম্পূর্ণভাবে করোনা বিলুপ্ত হবে, এই কথাটা এখনই বলে দেওয়া খুব কঠিন। টিকাকরণের পরেও মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। কারণ টিকা কতটা ক্ষমতাশালী, সেটাও সময় বলবে। আমেরিকা, রাশিয়া বা ভারতের টিকাগুলো যতক্ষণ পর্যন্ত তৃতীয় পর্যায়ের পরীক্ষাপর্ব অতিক্রম করবে, ততক্ষণ কিছু বলা কঠিন।
সবশেষে একটা কথা মাথায় রাখতেই হবে যে আগের তুলনায় এখন করোনা পরিস্থিতির যেটুকু উন্নতি হয়েছে, তার সবটাই কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি মানার সুফল। মাস্ক ও স্যানিটাইজারের ব্যবহার, সামাজিক দূরত্ব মানা বা আক্রান্ত হলে নির্দিষ্ট সময় নিজেকে ঘরে আলাদা রাখা ইত্যাদি। ফলে অকারণে আতঙ্কিত হওয়ার কোনও কারণ নেই। গুজব থেকে দূরে থাকুন। চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীদের উপর ভরসা রাখুন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরে আসুন। সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন।
লিখেছেন অভিনন্দন দত্ত