প্রেম-প্রণয়ে কিছু নতুনত্ব থাকবে যা বিশেষভাবে মনকে নাড়া দেবে। কোনও কিছু অতিরিক্ত আশা না করাই ... বিশদ
কল্পনা করুন, আপনি সীমান্তের সৈন্য, মেশিনগান হাতে পাহারা দিচ্ছেন। দেখলেন শত্রুসৈন্যরা এগিয়ে আসছে। কী করবেন? অবশ্যই গুলি করবেন। গুলি করলেন, শত্রুরা নিহত হল, আর কেউ আসছেও না। তখনও কি মেশিনগান চালাতেই থাকবেন? অবশ্যই না। একইভাবে ভাইরাস হল শত্রুসৈন্য, আর অ্যান্টিবডি হল শরীরের রোগ-প্রতিরোধ ব্যবস্থার গুলি। ভাইরাস যখন নিকেশ হয়ে গিয়েছে, তখনও কেন অ্যান্টিবডি বানাতেই থাকবেন? লাভটা কী? অ্যান্টিবডি তৈরি করতে শরীরের এনার্জি খরচ হয় না? কিন্তু আবার ভাইরাস এলে? চিন্তা নেই, কারণ শরীর ভাইরাসকে চিনে রেখেছে। এলে আবার অ্যান্টিবডি বের হবে। জীবনবিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠিত সত্য হল, রোগ সারলে, শরীরে ভাইরাস আর অবশিষ্ট না থাকলে, অ্যান্টিবডিও আজীবন বেশি বেশি থাকে না। কমতে থাকে। সেটাই স্বাভাবিক। তাই কয়েক মাসের মধ্যে অ্যান্টিবডি কমে যাচ্ছে বলে হাহুতাশ করার কিছু নেই।
কীভাবে জীবাণু ধ্বংস হয়?
১. রক্তের শ্বেত কণিকাদের অন্যতম হল লিম্ফোসাইট (দেখবেন টিসি/ডিসি রিপোর্টে এদের উল্লেখ থাকে)। লিম্ফোসাইটরা দু’ধরনের। একদলের নাম টি-লিম্ফোসাইট, অন্যদল বি-লিম্ফোসাইট। বি-লিম্ফোসাইটদের কাজই হল শরীরে রোগজীবাণু প্রবেশ করলে তাকে প্রথমে চিনতে পারা এবং প্রচুর অ্যান্টিবডি বানিয়ে ধ্বংস করতে সাহায্য করা।
২. শরীরে হাজার হাজার জীবাণু ঘুরে বেড়াচ্ছে (এমনকী নতুন করোনা ভাইরাসের মতো আনকোরা নতুন জীবাণুও আসতে পারে)। তাদের প্রত্যেককে নির্দিষ্টভাবে চেনার জন্যে আলাদা আলাদা বি-লিম্ফোসাইট তৈরি থাকে। রক্তের অন্যান্য কোষের মতো এরাও তৈরি হয় অস্থিমজ্জায়। তারপর পৌঁছে যায় শরীরের বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত লিম্ফ নোডে এবং চুপচাপ যেন ছিপ ফেলে বসে থাকে।
৩. শরীরের ভিতরের রাস্তাঘাট-নদীনালা এমনভাবে সাজানো, সাধারণত কোনও জীবাণু ঢুকলে সে কোনও না কোনও লিম্ফ নোডে গিয়ে পড়বে। তখনই চাবি-তালা খাপে খাপ লেগে যাবার মতো জীবাণুর কোনও একটা অংশ আটকাবে ওর জন্য নির্দিষ্ট বি-লিম্ফোসাইটের গায়ে। ব্যস্! ওই বি-লিম্ফোসাইট সক্রিয় হয়ে উঠবে আর একটা বি-লিম্ফোসাইট থেকেই কয়েক হাজার নতুন কোষ তৈরি হবে। এদের নাম প্লাজমা কোষ। অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে মাত্র এক সপ্তাহে একটি বি-লিম্ফোসাইট থেকে পাঁচ হাজার প্লাজমা কোষ তৈরি হতে পারে। এরা সবাই ওই প্রথম বি লিম্ফোসাইটের হুবহু এক। বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় যাকে বলে ‘ক্লোন’। ওরাও ওই জীবাণুকে চেনে। প্রতিটি প্লাজমা-কোষ অসংখ্য অ্যান্টিবডি তৈরি করতে পারে, যেগুলি রক্ত ও কোষকলার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে ওই জীবাণুকে ধ্বংস করে। আরও অনেক কোষের ভূমিকা আছে। যেমন টি-লিম্ফোসাইট। ভাইরাস প্রতিরোধে টি-লিম্ফোসাইটও গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে। এই হল অ্যান্টিবডি তৈরি করে জীবাণুকে হারাবার মূল ব্যাপার।
৪. জীবাণু সংহার করতে অ্যান্টিবডি তৈরি করতে হয়। জীবাণুরা সব ধ্বংস হলে তখন আর অত অ্যান্টিবডির দরকার নেই। বরং তাতে সমস্যা হতে পারে। তাছাড়া প্রতিটি অ্যান্টিবডি অণু বানাতে এনার্জি লাগে। শুধু শুধু নষ্ট করে কী লাভ? তাই, শরীর সুস্থ হলে প্লাজমা কোষগুলির সিংহভাগও দু’সপ্তাহ পরে মারা যায়। ওদের তৈরি অ্যান্টিবডি অবশ্য আরও কিছুদিন রক্তে ঘুরতে থাকে। কারণ, এই অণুগুলির আয়ুষ্কাল তিন থেকে চার সপ্তাহ মতো। কিন্তু, সব মিলিয়ে এক মাস বা তার কিছু পরে স্বাভাবিকভাবেই শরীরে ওই অ্যান্টিবডির মাত্রা কমতে থাকে।
৫. সব প্লাজমা কোষ অবশ্য মরে না। একটা ছোট্ট দল নিজেদের আদি ভিটে অস্থিমজ্জায় গিয়ে বাসা বাঁধে। সেখানেই বহু বছর থাকে। এদের নাম দীর্ঘায়ু প্লাজমা কোষ। এরা অল্প পরিমাণে হলেও অ্যান্টিবডি তৈরি করতে থাকে। কতটা করবে, কতদিন করবে, সেটায় এক জীবাণু থেকে অন্য জীবাণু তফাত করে দেয়। যেমন, হামের মেয়াস্লেস ভাইরাসের বিরুদ্ধে এরা আজীবন কাজ করে, কিন্তু করোনার ক্ষেত্রে নাও হতে পারে।
দুরন্ত মেমরি কোষ
বি-লিম্ফোসাইট যখন জীবাণুর সংস্পর্শে এসে সক্রিয় হয়েছিল, তখন আরেকদল কোষ তৈরি হয়েছিল। এদের নাম ‘মেমরি কোষ’ (বা স্মৃতিশক্তি-সম্পন্ন কোষ)। এরা অ্যান্টিবডি তৈরি করে না। কিন্তু, ঠিক যেমন আমাদের মস্তিকের স্নায়ুকোষ নানা স্মৃতি ধরে রাখে, মেমরি কোষও জীবাণুটিকে মনে রাখে। বহু বছর পরও যদি দেখা হয় (মানে ফের সংক্রমণ হয়), খুব দ্রুত ওই মেমরি কোষ থেকে হাজার হাজার প্লাজমা সেল তৈরি হয়ে ‘হা রে রে রে রে’ বলে অ্যান্টিবডি বানিয়ে যুদ্ধে নেমে পড়ে। তখন ফের অ্যান্টিবডির মাত্রা বাড়তে থাকে।
৬. ভ্যাকসিনের প্রধান কাজ হল আগে থেকে নির্জীব জীবাণু প্রবেশ করিয়ে তার বিরুদ্ধে মেমরি কোষ তৈরি করতে সাহায্য করা। যাতে ভবিষ্যতে আসল জীবাণু ঢুকলে পড়লে তাকে নিকেশ করা যাবে।
কেন ভয়ের কিছু নেই?
৭. তাহলে ‘অ্যান্টিবডি কমে যাচ্ছে, সর্বনাশ হয়ে গেল’ এই কথা ঘুরছে কেন? আসলে গত ক’মাস যে দুরন্ত গতিতে গবেষণা চলছে, তাতে কয়েকজন বিজ্ঞানীর নজরে এসেছে, তিন মাসের মাথায় করোনা-বিরোধী অ্যান্টিবডির মাত্রা অল্প হলেও কমে। এটাই স্বাভাবিক। গবেষণাপত্রে সে কথা তাঁরা লিখেওছেন। আরেকদল বিজ্ঞানী লক্ষ করেছেন যে ১১৫ দিন পর্যন্ত করোনা-বিরোধী অ্যান্টিবডির মাত্রা ভালোই আছে। কিন্তু, এমনিতেই ‘অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্করী’! আর আমরা এখন দুমদাম ‘ব্রেকিং নিউজ’-এর যুগে বাস করছি! তাই, সব রসাতলে গেল গোছের খবর ছড়িয়ে পড়েছে। মানুষ অযথা আতঙ্কিত হচ্ছেন।
সত্যি বলতে কী, অল্পের ওপর কোভিড হয়ে সেরে গেলে, একদিকে ভালোই। কারণ, আক্রান্তের শরীরে মেমরি এবং দীর্ঘায়ুযুক্ত প্লাজমা কোষ তৈরি হয়ে গেল। যেন প্রকৃতিই তাঁদের ভ্যাকসিন দিয়েছে! ফের আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা নেই বললেই চলে। এমনকী আগামী বছর যখন ভ্যাকসিন বাজারে আসবে, এঁদের কিছুদিন পরে তা দিলেও চলতে পারে। ভেবে দেখুন, যদি কয়েক কোটি মানুষকে কয়েক মাস পরে ভ্যাকসিন দিলে চলে, তাহলে স্বাস্থ্য দপ্তর, হাসপাতাল, ডাক্তার, নার্স, ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারক, পরিবহণ ব্যবস্থা সকলেরই কিছুটা সুবিধে হবে। অবশ্য সেটা বিজ্ঞানসম্মত কি না আরও গবেষণাই বলতে পারবে। তবে হলে মন্দ হয় না। আসল কথা হল, বিজ্ঞানই সত্য। তা ছাড়া গতি নেই।