সপরিবারে অদূরবর্তী স্থানে ভ্রমণে আনন্দলাভ। কাজকর্মে কমবেশি ভালো। সাহিত্যচর্চায় আনন্দ। ... বিশদ
এদিকে গবেষণায় বলা হয়েছে ১৮৫৯ ও ১৯২১ সালে পৃথিবীতে এমন সৌরঝড় হয়েছিল। বিজ্ঞানীদের হিসাব অনুযায়ী মোটামুটিভাবে ৮০ থেকে ১০০ বছরে একবার সূর্যের প্রাকৃতিক জীবনচক্রের জন্য সৌরঝড় বৃদ্ধি পায়। আর এটি পৃথিবীকে আচ্ছন্ন করে রাখে। সম্প্রতি যে সৌরঝড় পৃথিবীতে আছড়ে পড়েছে তা গত ৫০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ও বিপজ্জনক বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা। সূর্যের মধ্যেকার সেই তীব্র ঝড়ের ছবি তুলেছে ইসরোর সৌরযান আদিত্য এল-১ এবং চন্দ্রযান-২। যা চন্দ্রের কক্ষপথে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ইসরোর মতে, ২০০৩ সালের পর এটাই ছিল সবচেয়ে শক্তিশালী সৌরঝড়। ২০০৩ সালের অক্টোবরে হ্যালোউইনের সময় শেষবার যখন সৌরঝড় পৃথিবীতে পৌঁছায় তখন প্রায় ভূত দেখার অবস্থা হয়েছিল অনেক দেশের। সুইডেনে বিদ্যুৎ বিপর্যয় ঘটে, ট্রান্সফর্মার নষ্ট হয়ে যায় দক্ষিণ আফ্রিকায়। এবারের শক্তিশালী সৌরঝড়টি জিওম্যাগনেটিক সূচকে ৯-এ পৌঁছিয়েছিল, যা সৌরঝড়ের সর্বোচ্চ স্তর। বলা হচ্ছে জি-ফাইভ গোত্রের জিওম্যাগনেটিক স্টর্ম। এই ঝড়ের জেরে পৃথিবীর টেলি যোগাযোগ, ইন্টারনেট পরিষেবা, জিপিএস সিস্টেম ও মোবাইল নেটওয়ার্ক-এর উপর কিছুক্ষণের জন্য প্রভাব পড়েছিল। এই সৌরঝড় প্রশান্ত মহাসাগরীয় এবং আমেরিকান অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছিল। এর আগে ১৯২১ সালে সৌরঝড়ে যে ক্ষতি হয়েছিল তা অকল্পনীয়। বিজ্ঞানের পরিভাষায় যার নাম ‘ব্যারিংটন এফেক্ট’। তখন ঝড়ের কবলে পৃথিবীকে ঘিরে থাকা বিশালাকৃতির চৌম্বক ক্ষেত্রে বড় বড় ফাটল ধরেছিল। এ সবের ফাঁকা জায়গা দিয়ে বিষাক্ত সৌরকণা আর মহাজাগতিক রশ্মি প্রবেশ করেছিল। এমনকী ১৯৮৯ সালের মার্চে পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসা সৌরঝড়ের ঝাপটায় কানাডায় পুরো কুইবেক প্রদেশে টানা ৯ ঘণ্টা ‘ব্ল্যাক আউট’ হয়ে গিয়েছিল।
যে সৌড়ঝড়কে ঘিরে বিজ্ঞানীরা প্রমাদ গুনছেন, তা আসলে কী? প্রতিনিয়ত সূর্যগহ্বরে ঘটে চলেছে নানারকম ছোট বড় বিস্ফোরণ। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন বিস্ফোরণের ফলে সূর্য থেকে প্রচুর পরিমাণে আয়নিত কণা এবং ইলেকট্রনের মিশ্রণ, সৌরপ্লাজমা স্রোতের আকারে মহাশূন্যে ছড়িয়ে পড়ে, যা ঘণ্টায় ৩০ লক্ষ মাইল গতিতে পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসে, ওই শক্তিকেই সৌরঝড় বলা হয়। এই সৌরঝড় পৃথিবীতে পৌঁছতে কয়েক মিনিট বা ঘণ্টা লাগতে পারে। আবার দু-একটা দিনও লাগতে পারে। সৌরঝড়ের পাশাপাশি সূর্য থেকে পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসে সৌরবায়ু, সৌরশিখা ও সৌরকণা। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল এবং চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের (ম্যাগনেটোস্ফিয়ার) সামনে সেগুলি বাধাপ্রাপ্ত হয়। তবে বাধা পেলেও, নিরক্ষীয় অঞ্চলের চেয়ে মেরু অঞ্চলে ঢোকার রাস্তা সহজ। সমান্তরাল গতিপথই রাস্তা বাতলে দেয়। সৌরঝড় মানেই আধানযুক্ত কণার বা আয়নের স্রোত। তা পৃথিবীতে বায়ুমণ্ডলের আয়নোস্ফিয়ার এবং মাধ্যাকর্ষণ শক্তির কারণে এই আয়নগুলি জমা হয় পৃথিবীর উত্তর এবং দক্ষিণ গোলার্ধে। সুতরাং পৃথিবীতে ঢুকতেই ইলেকট্রনের সঙ্গে বায়ুমণ্ডলের আয়নিত অক্সিজেন ও নাইট্রোজেনের সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটে। এর ফলে ইলেকট্রনের শক্তির হাতবদল, বায়ুমণ্ডলকে পরিবর্তন এবং তারই চূড়ান্ত ফলাফল আকাশ জুড়ে আলোর মেলা। যাকে বাংলায় বলা হয় ‘মেরুজ্যোতি’ বা মেরুপ্রভা। ইংরেজিতে ‘অরোরা’। ১৬১৯ সালে ইতালীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী গ্যালিলিও এই মেরুজ্যোতির নামকরণ করেন।
এ বারের আলোর মেলা দিগদিগন্তে ছড়িয়ে পড়েছিল। তার কারণ একটাই—শক্তিশালী সৌরঝড়ের প্রভাব। পৃথিবী পৃষ্ঠ থেকে ৯৭-১০০০ কিলোমিটার বায়ুমণ্ডল পর্যন্ত আকাশ জুড়ে এঁকে দিয়েছিল আলোর মেলা। লাল, সবুজ নীলের মতো বাহারি রঙের নীচে চাপা পড়ে গিয়েছিল রাতের কালো অন্ধকার আকাশ। পৃথিবীর উত্তর ও দক্ষিণ মেরুতে নৃত্যরত এই আলোকচ্ছটা যা মানুষের চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছিল। আর এর জেরেই সুদূর তাসমানিয়া (অস্ট্রেলিয়া) থেকে শুরু করে ব্রিটেন ও আমেরিকার আকাশে বর্ণিল আলো বা মেরুজ্যোতি দেখতে পাওয়া গিয়েছিল। এমন বিরল দৃশ্যের সাক্ষী হয়েছিল ভারতও। ওই দিন ভারতের লাদাখের প্রান্তবর্তী গ্রাম হ্যানলের আকাশেও দেখা গিয়েছিল লাল আলোর মেরুজ্যোতি। ভৌগোলিক অবস্থানের নিরিখেই লাদাখের মতো জায়গায় মেরুজ্যোতির দর্শন পাওয়া প্রায় বিরল ঘটনা বলে মনে করা হচ্ছে। যে সুইজারল্যান্ডে কখনই মেরুজ্যোতি দেখা যায় না, ওই দিন সেই সুইজারল্যান্ডের আকাশেও চলেছিল আলোর খেলা। মেরুজ্যোতির ছটা দেখল আমেরিকার টেক্সাস, ক্যারোলিনা, জর্জিয়ার মতো দক্ষিণী প্রদেশ, ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইতালি ইত্যাদি। আমেরিকার ন্যাশনাল ওসানিক অ্যান্ড অ্যাটমসস্ফেরিক অ্যাড মিনিস্ট্রেশন জানিয়েছে সূর্যের যে অঞ্চলে সৌরঝড় হচ্ছে, তা পৃথিবীর ব্যাসের ১৫ গুণ। অর্থাৎ ১৫টা পৃথিবীকে পাশাপাশি রাখলে যে প্রস্থ হয় ততগুণ। সূর্যের ওই তল্লাটের মোট পরিধির প্রায় ১৪ শতাংশ। প্রায় ২ লক্ষ কিলোমিটার অঞ্চল জুড়ে এই সানস্পটের ক্লাস্টার। এতদিন পৃথিবী থেকে স্পষ্ট দেখা গেলেও, সম্প্রতি চোখের আড়াল হয়েছে সে। কিন্তু যাওয়ার আগে ফের পৃথিবীর দিকে দু-দু’টি সৌরঝড় নিক্ষেপ করে গিয়েছে। মেরুজ্যোতি বা অরোরা ঘিরে জড়িয়ে আছে নানা পৌরাণিক কাহিনি। উত্তর মেরুর এই আলোককে অরোরা বোরিয়ালিস এবং দক্ষিণ মেরুতে অরোরা অস্ট্রালিস নামে অভিহিত করা হয়! রোমানদের ভোরের দেবী ‘অরোরা’, গ্রিকদের উত্তরের বাতাসের দেবী ‘বোরিয়ালিস’ এবং দক্ষিণা বাতাসের দেবতা ‘নটুস’ বা ‘অস্টার’-এর সঙ্গে মিল রেখে এই নামকরণ হয়। আর আক্ষরিক অর্থেই ইংরাজিতে এই আলো উত্তর মেরুতে নর্দার্ন লাইটস এবং দক্ষিণ মেরুতে সাউদার্ন লাইটস নামে পরিচিত। তবে নানাকারণে সাউদার্ন লাইটসের চেয়ে নর্দার্ন লাইটস-এর জৌলুস বরাবরই বেশি।
ফিনো ইউগ্রিকদের মতে, অরোরা ছিল অশনি বা দুর্ভাগ্যের সঙ্কেত। ফিনো ইউগ্রিকরা মনে করত মৃতদের আত্মা ফিরে আসত এই আলো হয়ে। তারা বিশ্বাস করত, তাদের কোনও কাজে আত্মারা অসন্তুষ্ট হলে তুলে নিয়ে যাবে কিংবা শিরচ্ছেদ করবে জীবিতদের। ফিনল্যান্ডে এই অরোরার সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক ‘শিয়াল’ এর গল্প। তাদের মতে, পাহাড়ের ফাঁকফোঁকর দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময়ে পাহাড়ের গায়ে লেজ লেগে আবহাওয়া ভেদে আগুনের ফুলকি কিংবা তুষারপাতের কারণে সৃষ্টি হতো এই আলোর।
সৌরঝড় পৃথিবীর সীমানায় আসার সঙ্গে সঙ্গে বায়ুমণ্ডলের উপরের দিকে থাকা অক্সিজেনের সঙ্গে সৌর আয়নের সমন্বয়ে নিঃসৃত হয় লাল আলোক রশ্মির, একটু নিচু উচ্চতায় অক্সিজেনের সঙ্গে সমন্বয় হলে বিকিরণ হয় সবুজাভ ও হলুদাভ বর্ণের এবং অরোরা নীচের অংশ লালচে ও নীলচে বর্ণ তৈরি হয়। নাইট্রোজেনের সঙ্গে সৌর আয়নের সমন্বয়ে। আর এ সবের জেরেই রাতের দিগন্তে দেখা যায় বর্ণালীর আলোকচ্ছটা। অসংখ্য তারার ভিড়ে এমনই নৈসর্গিক দৃশ্য যা দেখে চোখ জুড়ায় সকলেরই। এক ঝলক দেখলে মনে হবে যেন কোনও স্বপ্নের রাজ্য, যা কোনও দিন বাস্তবে দেখা যাবে না।