সপরিবারে অদূরবর্তী স্থানে ভ্রমণে আনন্দলাভ। কাজকর্মে কমবেশি ভালো। সাহিত্যচর্চায় আনন্দ। ... বিশদ
আমরা ভুলে যাই, অধিকাংশ জনমত সমীক্ষাই কিন্তু বলেছিল যে ২০১৬ সালে পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কোনওক্রমে জিতবে। তারা অনুমান করতে পারেনি তৃণমূলের বিপুল জয়। আবার, ২০১৯-এ পশ্চিমবঙ্গেই বিজেপির ১৮টি আসন লাভের অনুমানে ব্যর্থ হয়েছে অধিকাংশ সমীক্ষা। আসলে গত কয়েক দশকে ওপিনিয়ন পোল মুখ থুবড়ে পড়েছে বার বার। দেশে ও বিদেশে। এর সাক্ষ্য দিতে পারতেন অটলবিহারী বাজপেয়ি কিংবা হিলারি ক্লিন্টন। ব্রিটেনে ২০১৫-র ভোট, ২০১৬-র ব্রেক্সিট গণভোট, ভারতে ২০০৯, ২০১৪ ও ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচন, এমনকী দিল্লির মতো ছোট ও শহুরে রাজ্যের বিধানসভাতেও জনমত সমীক্ষা বার বার দিগ্ভ্রান্ত হয়েছে। তা ভোটে জয়-পরাজয়ের আঁচ বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে। দিগ্ভ্রান্ত করেছে ভোটারদেরও। তবুও ভোটের পারদ চড়তে না চড়তেই সমীক্ষক সংস্থাগুলি হাজির রংবেরঙের অনুমানের পসরা নিয়ে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তার না আছে নমুনা সংগ্রহ বা তথ্য-বিশ্লেষণ পদ্ধতির বর্ণনা, না আছে তথ্যের প্রয়োজনীয় সারসংক্ষেপ। জনমত সমীক্ষা তাই অনেক ক্ষেত্রেই স্ব-আরোপিত ভবিষ্যদ্বাণী। অভিযোগ, এর পিছনে থাকে শক্তিশালী-ক্ষমতাবান রাজনৈতিক দলের অর্থের কারিকুরিও। ওপিনিয়ন পোল গণতন্ত্রের জন্য সত্যিই আশীর্বাদ না অভিশাপ সেই বিচার কালের উপর ছেড়ে দিলেও, এটুকু বলাই যায় যে পরীক্ষার আগেই পরীক্ষার ফল বেরনোর এই সাসপেন্স থ্রিলার আজ গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় বিনোদনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রায় দেড় মাস ধরে চলা সাত দফার লোকসভা নির্বাচন সেটাই প্রমাণিত করেছে।
শুধু পশ্চিমবঙ্গের দিকেই তাকান, ভোট শুরু হওয়ার আগেই সব পূর্বাভাসের ইঙ্গিত ছিল, বিজেপি নাকি এ রাজ্যে বিরাট সাফল্য পেতে চলেছে। কেউ কেউ তো শাসকদল তৃণমূলের আসন সংখ্যা ১৫-র নীচেও নেমে আসার জল্পনা ছড়িয়ে দিয়েছিল। পাত্তা দেয়নি ইন্ডিয়া জোটকেও। আসলে একে বলে ভোটের আগেই ভোটারের মগজ ধোলাই! বোঝাই গিয়েছিল, এই ওপিনিয়ন পোলের মালিকদের সঙ্গে বাস্তবের মাটির সঙ্গে কোনও যোগাযোগ নেই। যেমন ধরুন, এবিপি সি ভোটারের সমীক্ষা রিপোর্ট জানিয়েছিল, ৫৪৩টি আসনের মধ্যে ৩৬৬টি আসন পেতে পারে এনডিএ। ইন্ডিয়া জোট পেতে পারে ১৫৬টি আসন। অন্যান্যরা পেতে পারে ২১টি আসন। ইন্ডিয়া টিভি-সিএনএক্স ভোটের আগেই বিরোধীদের কোমর ভেঙে দিতে চেয়েছিল। তাদের ওপিনিয়ন পোলের হিসেব ছিল, এনডিএ পাবে ৩৭৮ আসন আর ইন্ডিয়া জোট ৯৮। ‘ঈশ্বরের দূত’ নরেন্দ্র মোদিকে খুশি করতে গিয়ে এরা ভুলেই গিয়েছিলেন আঞ্চলিক দলগুলির শক্তির অঙ্ক। ওপিনিয়ন পোলের মাতব্বররা থেকে শুরু করে বিভিন্ন মিডিয়া ভোটের আগেই বিজেপিকে বার্তা দিতে চেয়েছে— আমি তোমাদেরই লোক। ফলে ভোট পর্বে কোটি কোটি টাকার বিজ্ঞাপন
ঢুকেছে সেই সব মিডিয়ার কোষাগারে। ধর্মনিরপেক্ষর তকমা সাঁটা সেইসব মিডিয়ার ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলির রং হয়ে ওঠে গেরুয়া। এ তো প্রায় দেড় মাস ধরে জনগণই দেখেছে। সেই মিডিয়ার মাতব্বররা জানেনই না, গোটা ভোট পর্বে তারা ছিলেন জনগণের হাসির খোরাক। মজার কথা, এই রকম ওপিনিয়ন পোলগুলি যে ডিজিটাল মাধ্যমগুলি জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়, ভোটের ফল উল্টো হলেই সেই সমীক্ষাগুলি উধাও হয়ে যায় সেই ডিজিটাল মাধ্যমগুলি থেকে। উল্টে তারাই সাফল্যে ভাগ বসাতে চায়। এ এক মজার খেলা!
এটা ঠিক, ভোটাররা জনমত সমীক্ষা শোনেন, তাকে গুরুত্ব দেন, ‘পাবলিশড ওপিনিয়ন’-এ অল্পবিস্তর প্রভাবিতও হন। জনতার যেহেতু জয়ীর সঙ্গে থাকার স্বাভাবিক প্রবণতা আছে, তাই সমীক্ষায় এগিয়ে থাকা দলের জনপ্রিয়তার গাড়িতে সওয়ার হতে সেই পক্ষে ভোট দিয়ে ফেলেন অনেকেই। ‘ব্যান্ডওয়াগন এফেক্ট’-এর উল্টোটাও সত্যি, যাকে বলা হয় ‘আন্ডারডগ এফেক্ট’। পিছিয়ে থাকা প্রার্থী বা দলের পক্ষেও বইতে পারে সহানুভূতির হাওয়া। কখনও আবার জনমত সমীক্ষা ভোটারদের নিরুৎসাহও করে দিতে পারে। আর বুথফেরত সমীক্ষা? বিভিন্ন কেন্দ্রে মানুষের ভোট দেওয়া হয়ে গেলে ভোটারদের মধ্যে এই সমীক্ষা চালানো হয়। আনুষ্ঠানিক ফল ঘোষণার আগেই কোথায় কোন দল কতগুলি আসন পাবে, তার ভবিষ্যদ্বাণী করে বুথফেরত সমীক্ষা। সাধারণত, কয়েকটি নির্বাচনী সংস্থা এই ধরনের সমীক্ষার আয়োজন করে থাকে। ভোটারদের ‘মনের কথা’ জানতে তারা ব্যবহার করে বেশ কিছু কৌশল। তার মাধ্যমেই তৈরি করা হয় নির্বাচনের সম্ভাব্য ফল। সমীক্ষার জন্য প্রথমে বিভিন্ন কেন্দ্রের কয়েকটি বুথ বাছা হয়। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকেন সমীক্ষকেরা। ভোট দিয়ে ভোটাররা বেরলে তাঁদের নির্দিষ্ট কিছু প্রশ্ন করা হয়। সেই উত্তরের ভিত্তিতে তৈরি করা হয় সমীক্ষার ফল।
‘অল্টারনেটিভ মিডিয়া’-র বর্তমান আইকন রবীশ কুমার বুথফেরত সমীক্ষাকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, আমরা সবাই একটা সংখ্যা জানতে চাই। আসলে আমাদের চোখের সামনে মোবাইল বা টেলিভিশনের পর্দায় একটা সংখ্যা আসুক, সেই প্রত্যাশা থাকে। সেই সংখ্যায় কেউ কীভাবে পৌঁছলেন, কোন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করে ওই সংখ্যায় উপনীত হলেন, তা জানার চেষ্টা করি না। যখন সেই সংখ্যাটা ভোটের ফলের সঙ্গে মিলে যায় বা আমাদের প্রত্যাশাকে পূর্ণ করে, তখন আমরা খুশি হই। আবার যখন আমাদের প্রত্যাশার সঙ্গে সেই সংখ্যা, আসলে বুথফেরত সমীক্ষায় দেখানো কোনও নম্বর মেলে না, তখন আমরা হতাশ হই, ক্রুদ্ধ কিংবা ক্ষুব্ধ হই। কখনোই ওই সংখ্যায় পৌঁছানোর বিজ্ঞান বা তাত্ত্বিক দিকটাকে অনুসন্ধান করে দেখি না।
ঠিক যেমন হয়েছে এবারের লোকসভা ভোটেও। এবিপি নিউজ-সি ভোটার বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোটের ৪০০ আসনে জেতার পূর্বাভাস না দিলেও ইন্ডিয়া টুডে-অ্যাক্সিস মাই ইন্ডিয়া এবং নিউজ ২৪- টুডেজ চাণক্যের বুথ ফেরত সমীক্ষায় বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোটকে ‘৪০০ পার’ স্বপ্নপূরণের বার্তা দিয়েছিল। এবিপি নিউজ-সি ভোটারের পূর্বাভাস ছিল, এনডিএ ৩৫৩-৩৮৩, ‘ইন্ডিয়া’ ১৫২-১৮২ এবং অন্যেরা ৪-১২টি লোকসভা আসনে জিততে পারে। নিউজ ২৪- টুডেজ চাণক্যের মতে এনডিএ ৪০০, ‘ইন্ডিয়া’ ১০৭ এবং অন্যদের ৩৬টি লোকসভা আসনে জেতার সম্ভাবনা। এর মধ্যে একাই ৩৩৫টিতে জিততে পারে। কংগ্রেস জিততে পারে ৫০টিতে। ইন্ডিয়া টুডে-অ্যাক্সিস মাই ইন্ডিয়ার ইঙ্গিত ছিল, এনডিএ ৩৬১-৪০১, ‘ইন্ডিয়া’ ১৩১-১৬৬ এবং অন্যেরা ৮-২০টি আসনে জিততে পারে। উল্টোদিকে, বিরোধীরা এবং আজকের দুনিয়ায় যাদের, ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট’ সাংবাদিক বলে চিহ্নিত করা হচ্ছে, তাঁদের বক্তব্য ছিল, শেয়ার বাজারকে চাঙ্গা রাখার জন্যেই কেন্দ্রের শাসক দল নিজেদের মতো করে বুথফেরত সমীক্ষাকে গড়েপিটে নিয়েছে। এই অভিযোগ যে কতটা ঠিক তা টের পাওয়া গিয়েছিল ফল প্রকাশের পরই।
লক্ষ্য করুন, খোদ নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, ৪ জুনের পরে শেয়ার বাজার এত দৌড়বে যে হাঁফ ধরবে। অমিত শাহ মন্তব্য করেছিলেন, ৪ জুনের আগে শেয়ার কিনে রাখুন। তারপরে বাজার চড়বে। বাস্তবে বুথ-ফেরত সমীক্ষাও মোদি সরকারের বিপুল আসনে জিতে প্রত্যাবর্তনের ইঙ্গিত দেওয়ার পরে নজিরবিহীন উচ্চতায় পৌঁছে গিয়েছিল সূচক। কিন্তু সেই প্রত্যাশা পূরণ না হওয়ায় ফল বেরনোর দিন ৪০০০ পয়েন্টের বেশি পড়ে যায় সেনসেক্স। লগ্নিকারীদের ৩১ লক্ষ কোটি টাকা লোকসান হয়। রাহুল গান্ধীর কথায়, এ যাবৎকালের ‘সবচেয়ে বড় শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির’ ঘটনা। রাহুলের প্রশ্ন, ‘প্রধানমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কেন পাঁচ কোটি পরিবারকে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের পরামর্শ দিয়েছিলেন? এমন পরামর্শ দেওয়া কি তাঁদের কাজ? কেন তাঁরা এমন এক ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর মালিকানাধীন সংবাদমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন, শেয়ারবাজারে কারসাজির অভিযোগে যে গোষ্ঠীটির বিরুদ্ধে তদন্ত করছে সেবি?’ প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, এটাই কি ছিল এবারের বুথফেরত সমীক্ষার খেলা?
ফল প্রকাশের পর দেখা যায়, একাই তিনশোর বেশি এবং জোটে সাড়ে তিনশোর বেশি আসনের কৈলাস পর্বত থেকে ভোটাররা ‘পরমাত্মা’ নরেন্দ্র মোদিকে টেনে নামিয়েছেন জোট রাজনীতির মাটিতে। গোদি মিডিয়ার কেষ্ট-বিষ্টুদেরও উলঙ্গ করে দিয়েছে নির্বাচনের ফল। কারণ, মাত্র তিনদিন আগে তাঁদেরই চ্যানেলে চ্যানেলে বুথফেরত সমীক্ষায় ৩০০-৪০০ আসন দিয়ে জিতিয়ে দেওয়া হয়েছিল মোদিকে। সেদিন গোদি মিডিয়া অবশ্য সেখানেই থামেনি। বুথফেরত সমীক্ষায় ইন্ডিয়া জোট তথা কংগ্রেস গোহারান হারছে দেখানোর সঙ্গে সঙ্গে মোদি তৃতীয় মেয়াদে কী কী করবেন, ভারতকে কোন উচ্চতায় নিয়ে যাবেন– এসব গভীর আলোচনাও চালানো হয়েছিল ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে। আজতক নেটওয়ার্কের অ্যাঙ্কর অঞ্জনা ওম কাশ্যপ রীতিমত নাক ফুলিয়ে লাইভ অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, তাঁদের মতো বড় চ্যানেলে বিরোধীদের কোনও পরিসরই দেওয়া উচিত নয়। গত এক দশকে ভারতের প্রায় প্রত্যেক সংবাদমাধ্যমের মালিক এই ধরনের মেধাহীন, অর্ধশিক্ষিত সাংবাদিকদেরই দায়িত্বপূর্ণ পদে উন্নীত করেছেন। শেষ দফার নির্বাচনের পরে তাঁর ইউটিউব চ্যানেলে আপলোড করা ভিডিওতে রবীশ কুমার বলেছিলেন, চ্যানেলগুলিতে খরচ কমাতে রিপোর্টার যত কমানো হয়েছে, তত রমরমা হয়েছে অঞ্জনা ওম কাশ্যপদের মতো অ্যাঙ্করদের। খবরকে এক ধরনের অসুস্থ বিনোদনে পরিণত করে মানুষের মন বিষিয়ে দেওয়া এবং মোদিকে দোষগুণের অতীত এক সত্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার কাজই করে গিয়েছে টিভি চ্যানেলগুলি। দিনরাত মোদিকে দেখানো, বিরোধীদের প্রায় না দেখানো, দেখালেও তাদের বক্তব্য এমনভাবে বিকৃত করা যাতে মোদির সুবিধা হয়— এইসব কৌশল দেশবাসীও বুঝে ফেলেছিলেন। ফলে ৪ জুন ইন্ডিয়া টুডের স্টুডিওতে অ্যাক্সিস-মাই ইন্ডিয়া সংস্থার প্রধান প্রদীপ গুপ্তা এসে নিজের পাহাড়প্রমাণ ভুলের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে কেঁদেই ফেলেছিলেন। কারণ, ততক্ষণে গোটা দেশে উদোম হয়ে গিয়েছে তাঁদের খেলা। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘পেইড পোল’!
আর এই বাংলায়, একমাত্র কাগজ— যারা ফল প্রকাশের আগের দিনও লিখেছিল: মোদির বারাণসীতে ‘উল্টো ম্যাজিক’! এটা একটা উদাহরণ মাত্র। বাকিটা মিলিয়ে নিন দেড় মাসের ‘বর্তমান’ কাগজের খবরগুলি থেকেই।