সপরিবারে অদূরবর্তী স্থানে ভ্রমণে আনন্দলাভ। কাজকর্মে কমবেশি ভালো। সাহিত্যচর্চায় আনন্দ। ... বিশদ
—উইলিয়াম শেকসপিয়র
আজ, সোমবার আপনি এই লেখাটি যখন পড়ছেন, নরেন্দ্র মোদি তার আগেই তৃতীয় বারের জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী পদে বসে গিয়েছেন। মোদিজির এই ফিরে আসার ব্যাপারটা কিন্তু আগের মতো একইরকম নয়। তাঁর পক্ষে এটা হল এক প্রকার প্রস্থান। এতদিন তিনি ছিলেন একটি একদলীয় সরকারের এক স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রী। আর এবার তাঁর প্রবেশ ঘটল মাত্র ২০ আসনের সংখ্যাগরিষ্ঠতা বিশিষ্ট এবং অনেকগুলি দলের একটা জোটের প্রধানমন্ত্রী রূপে। উল্লেখ্য, এই জোট সরকারে এমপিদের মধ্যে টিডিপির ১৬ জন এবং জেডিইউয়ের ১২ জন থাকছেন। মোদিজির জন্য এটা হতে চলেছে একটা সম্পূর্ণ নতুন অভিজ্ঞতা। প্রচারক, বিজেপির সাধারণ সম্পাদক, গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সর্বমোট প্রায় ৫৫ বছরের পাবলিক লাইফে মাননীয় নরেন্দ্র মোদি এই ভূমিকার জন্য নিশ্চয় প্রস্তুত ছিলেন না। অতএব, এবার এমন একটি খেলা তাঁকে খেলতে হবে যার সঙ্গে তাঁর কোনও পূর্ব পরিচয় নেই।
গণতন্ত্রের আংশিক পুনরুদ্ধার
সদ্য সমাপ্ত লোকসভা নির্বাচনের মাধ্যমে ভারতের জনগণ এমন অনেক কিছু পেয়েছন যা কয়েক সপ্তাহ আগে পর্যন্তও প্রায় অসম্ভব বলে মনে করা হয়েছিল:
• সংসদের দুটি কক্ষই পরিচালিত হবে বিধি ও সংসদের ঐকমত্য অনুসারে—আগের মতো প্রিসাইডিং অফিসার ও সংসদীয় নেতার মর্জিমাফিক আর নয়।
• সংসদের অভ্যন্তরের বিভিন্ন কমিটির গঠনেও এবার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা পাবে এবং গুরুত্বপূর্ণ কমিটিগুলির পদ রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে বণ্টিত হবে সুচারুরূপে।
• লোকসভায় বিরোধী দলের একজন স্বীকৃত নেতা থাকবেন যাঁর সঙ্গে থাকবে পর্যাপ্ত সংখ্যক সাংসদের সমর্থন;
• সংসদে ট্রেজারি বেঞ্চ বা সরকার পক্ষ এবং বিরোধী পক্ষের মধ্যে ঐকমত্য ছাড়া ভারতের সংবিধান আর সংশোধন করা যাবে না।
• ক্যাবিনেট বা মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকগুলি আর নামমাত্র হবে না। কোনও খেয়ালখুশির সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রী আর চাপিয়ে দিতে পারবেন না। ইতিমধ্য্যেই এমন অনেক সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন ঘটেছে। উদাহরণস্বরূপ বিমুদ্রাকরণ বা নোটবাতিলকরণের ঘটনার উল্লেখ করা যায়। মন্ত্রিসভা ‘অবহিত’ ছিল বলে দায়টি এড়িয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। এই অন্যায় আর চলবে না।
• রাজ্যগুলির অধিকার এবার কেন্দ্রকে স্বীকার করে নিয়েই পদক্ষেপ করতে হবে। ফলে রাজ্যগুলির অধিকার এবং স্বাধীনতা এবার সুরক্ষা পাবে বলেই আশা করা যায়।
• রাজ্যগুলিকে তহবিল হস্তান্তর ও মন্ত্রক বা বিভাগ এবং প্রকল্প ভিত্তিক তহবিল বরাদ্দের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাচারিতায় নিশ্চয় লাগাম পড়বে। জোটের শরিক দলগুলিকে খুশি রাখতে সরকার এটা করতে বাধ্য থাকবে।
• সংসদে উপস্থিত থেকে প্রশ্নের উত্তর দিতে এবং গুরুত্বপূর্ণ বিতর্কে অংশ নিতে প্রধানমন্ত্রী এবার অন্তত বাধ্য হতে পারেন।
মানুষের রায় থেকে শিক্ষা
জনগণ কথা বলেছে। তারা স্বাধীনতা, বাক ও মত প্রকাশের অধিকার, গোপনীয়তার অধিকার এবং প্রতিবাদ করার অধিকারকে মূল্য দেয়। ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’ এবং ‘মানহানির’ জন্য মিথ্যা মামলা দায়ের করার প্রিয় খেলা সরকারকে অবশ্যই ছাড়তে হবে। অবশ্যই পরিত্যাগ করতে হবে ‘এনকাউন্টার’ এবং ‘বুলডোজার জাস্টিস’। বিশেষ করে, উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের জন্য এটা একটা বড় শিক্ষা। রামমন্দির জিনিসটা রাজনীতির ঊর্ধ্বেই। এটাকে আর কখনোই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের চিন্তা করা উচিত নয়। কেন? ব্যাপারটা দু’জনকে জিজ্ঞাসা করুন, পরিষ্কার হয়ে যাবে। একজন হলেন অবদেশ প্রসাদ। ৭৭ বছর বয়সি এই নেতা ফৈজাবাদ আসন থেকে সমাজবাদী পার্টির প্রার্থী হিসেবে এবার জয়ী হয়েছেন। অযোধ্যা অঞ্চলটি ফৈজাবাদ আসনেরই অন্তর্গত। অন্যজন হলেন সাকেত মিশ্র। তিনি প্রধানমন্ত্রীর প্রাক্তন প্রধান সচিব নৃপেন্দ্র মিশ্রের পুত্র। মন্দির নির্মাণ ট্রাস্টের শীর্ষকর্তাও তিনি। এহেন সাকেতও এই ভোটে ইউপির শ্রাবস্তী আসনে গোহারা হয়েছেন! জনগণ একটি সত্যিকারের মুক্ত গণমাধ্যম চায়। আর ম্যানুফ্যার্চড বা মনগড়া এক্সিট পোল তারা চায় না। প্রধানমন্ত্রীর প্রতিটি ভ্রুকুঞ্চনের বিভ্রান্তিকর এবং বিরক্তিকর নিউজ কভারেজ চায় না দেশবাসী। আগেভাগেই লিখে রাখা উত্তরের পিঠে প্রশ্ন করার নাটক আর দেখতে চায় না কেউ। অনুগত ইডি এবং সিবিআইয়ের প্রেস বিবৃতি পাঠেও ইতি পড়ুক এবার। জনগণ চায় আঞ্চলিক দলগুলিও তাদের মূল বিশ্বাসের প্রতি নিষ্ঠাবান হবে। জনগণ চায়, দিল্লিতে তাদের এক মুখ এবং রাজ্যের রাজধানীতে অন্য মুখ আর দেখাবে না আঞ্চলিক দলগুলি। অসম গণ পরিষদ (অগপ), শিরোমণি অকালি দল (এসএডি), জননায়ক জনতা পার্টি (জেজেপি), ভারত রাষ্ট্র সমিতি (বিআরএস) এবং জনতা দল (সেকুলার)-এর মতো দলগুলির শাস্তি চায় মানুষ। তারা চায় নিদেন পক্ষে বিজু জনতা দল (বিজেডি) এবং যুবজন শ্রমিক রায়তু কংগ্রেস পার্টি (ওয়াইএসআরসিপি)-কে যেমন কড়কে দেওয়া হয়েছে এই নির্বাচনে, তেমনই চরমভাবে সমঝে দিতে হবে ওই দলগুলিকেও। এই ভোটে তেলুগু দেশম পার্টি (টিডিপি) এবং জেডিইউয়ের জন্যও একটা শিক্ষা রয়েছে।
অবশ্যই থাকবে বিরোধী এজেন্ডা
বিরোধী দলগুলি ১০ বছর পর যথার্থ সংসদীয় বিরোধী দলের মতো আচরণ করার সুযোগ পেয়েছে। তারা নিশ্চয় সংসদের ভিতরে এবং বাইরে তাদের এজেন্ডা বা কর্মসূচি স্থির করবে। এখানে কিছু আইডিয়া রাখছি যার মধ্যে রয়েছে জনগণের চাওয়া-পাওয়া এবং যার ভিত্তিতে তারা ‘ইন্ডিয়া’ পক্ষের অনেক প্রার্থী ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছে:
• আর্থ-সামাজিক এবং জাতিভিত্তিক সমীক্ষা এবার করা হোক।
• সংবিধান (১০৬তম সংশোধন) আইনটি অবিলম্বে কার্যকর করা হোক। ২০২৫ সাল থেকে যেসব আইনসভায় সদস্য নির্বাচন হবে সেখানে মহিলাদের জন্য এক-তৃতীয়াংশ আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
• সব ধরনের কাজে দৈনিক ন্যূনতম মজুরি ৪০০ টাকা চালু করতে হবে, তার মধ্যে অবশ্যই রাখতে হবে একশো দিনের কাজের গ্যারান্টি (মনরেগা) স্কিমের শ্রমিকদেরকেও।
• কৃষিঋণ সংক্রান্ত একটি স্থায়ী কমিশন নিয়োগ করতে হবে এবং তার সুপারিশ অনুযায়ী মকুব করা দরকার কৃষিঋণ।
• সরকারি দপ্তরগুলিতে এবং সরকার নিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন সংস্থায় যে ৩০ লক্ষ শূন্যপদ রয়েছে সেগুলি পূরণ করতে হবে অতিদ্রুততার সঙ্গে।
• অবিলম্বে কার্যকর করার তাগিদে শিক্ষানবিশ আইন প্রয়োজনে সংশোধন করতে হবে। প্রতিটি উপযুক্ত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে শিক্ষানবিশ নিয়োগে বাধ্য করতে হবে। তাদের স্টাইপেন্ড বা ভাতা প্রদানের আর্থিক দায়ভারের একটা অংশ বহন করতে হবে সরকারকে।
• অন্যদিকে অগ্নিবীর প্রকল্পটি বাতিল করা হোক।
• যতক্ষণ না নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের (সিএএ) সাংবিধানিকতার বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টে ফয়সালা হচ্ছে, আইনটির বাস্তবায়ন ততদিন স্থগিত রাখতে হবে।
• সিবিআই, ইডি, এনআইএ, এসএফআইও, এনসিবির মতো কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলিকে একটি যৌথ সংসদীয় কমিটির তত্ত্বাবধানে আনা হোক এবার।
একটি নতুন খেলা
গতকাল, ৯ জুন একটি নতুন খেলা শুরু হয়েছে। নতুন খেলোয়াড়রা আছেন সামনের সারিতে। এখন প্রস্থান এবং প্রবেশের মজা দেখতে থাকুন।