সপরিবারে অদূরবর্তী স্থানে ভ্রমণে আনন্দলাভ। কাজকর্মে কমবেশি ভালো। সাহিত্যচর্চায় আনন্দ। ... বিশদ
ডকঘাট থেকে প্রথমে মাতলা পেরিয়ে ক্যানিং। তারপর লোকাল ধরে যাদবপুর, ঢাকুরিয়া, বাঘা যতীন নেমে যাই আমরা। আপনাদের বাড়িতে
বাড়িতে সকালে পৌঁছে কেউ রান্নায়, কেউ ঘরের কাজে লেগে পড়ি। ফিরতে প্রায় বিকেল। ফিরতি
ট্রেনে গেটের কাছে ঘুমাই! অথবা উচ্চস্বরে হাসাহাসি করি সকলে মিলে।
আমরা চাঁপাডাঙ্গা থেকে সব্জি কিনে তাড়াতাড়ি তারকেশ্বর এসে চলে যাই শেওড়াফুলি, শ্রীরামপুর। আবার কেউ কেউ মণিরামপুর ঘাট পেরিয়ে বারাকপুরেও। সেইসব বাজারে গিয়ে ওইসব নিয়ে বসি। একটু ভিতরের দিকে। বড় বিক্রেতাদের আড়ালে।
আমাদের অনেকরকম দুঃখ। বাড়ির লোকের সঙ্গে ট্রেনে যেতে যেতে দেখি সারাক্ষণ কোনও না কোনও হকার উঠছে। চুলের ক্লিপ, সেফটিপিন, শশা, পেয়ারা, এমনকী একবার দেখলাম আয়ুর্বেদ শ্যাম্পু। আমাদের চুলে খুব জট পড়ে। তাই এটা মাখলে নাকি ওটা সেরে যাবে। কিন্তু স্বামীর দিকে সেই সময় তাকালে কেমন যেন রাগ রাগ মুখ করে তাকায়। কিনে দেয় না। কেনা হয় না। ‘৫০ রকমের ব্রত কথা’ বই দেখেছিলাম একজনের হাতে। জ্যৈষ্ঠ মাসে জয়মঙ্গলবার ব্রত করার জন্য ওই মঙ্গলচণ্ডী ব্রতও ছিল সেখানে। ওটা পড়তে হয়। আগের বইটা ছিঁড়ে গিয়েছে। তাই নতুন হলে ভালো হয়। দাম অবশ্য একটু বেশি। ৩০ টাকা। কিন্তু ‘এখন কিনতে হবে না এসব’ বলে আমাদের স্বামী ট্রেনের জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকে। তার চোখে বাইরের ঘরবাড়ি গাছ রাস্তার ছবি। আমাদের চোখে গোপন জল। না পাওয়ার। আর অপমানের। নিজের হাতে টাকা থাকলে...।
সেই গুমা থেকে হাবরা লোকাল ধরে আসতে হয় আমাদের দমদম ক্যান্টনমেন্ট অথবা জংশনে। তারপর এদিক ওদিক ছড়িয়ে যাই আমরা। এখান থেকে দমদম, লেকটাউন, কালিন্দী, উল্টোডাঙ্গায়। আবার কেউ কেউ যাই শিয়ালদহে। সেখান থেকে পার্কসার্কাস বা বালিগঞ্জের ট্রেন। ওসব জায়গায় ছোট মাঝারি নার্সিংহোম থাকে। আয়ার ডিউটি। সেন্টারেও নাম লেখানো আছে। তবে সেন্টারে নাম লেখাতেও কমিশন দিতে হয়।
আমাদের সেলাই স্কুলে যাওয়া আছে। মানকরে। স্বনিযুক্তি গ্রুপেও কাজ করি আমরা গলসীতে। আমরা ফুল তুলি পাঁশকুড়া লোকালে। আমাদের কারও স্বামী চলে গিয়েছে আমাদের ছেড়ে। কারও স্বামী হারিয়ে গিয়েছে। কেউ কেউ বিধবা।
আবার আমাদের কেউ কেউ হয়তো কোনও কাজ করি না। শুধুই ঘরের কাজ। সকাল থেকে সারাদিন। কিন্তু সেই কাজকে কেউ গুরুত্ব দেয় না। আমাদের বলা হয় বাড়ির বউ। সব করতেই হবে। আমরা সব ব্যাপারেই অন্যের মুখাপেক্ষী। আনন্দ বলতে সন্ধ্যায় একটু সিরিয়াল দেখা। আমাদের খুব খারাপ লাগে যখন সামান্য ব্যাপারেই বলা হয়, ‘রোজগার করব আমি, তুমি বসে বসে খাবে? যা বলব শুনতে হবে। নয়তো দরজা খোলা আছে, বেরিয়ে যাও। এক পয়সা ঘরে আনার মুরোদ নেই। আর লম্বাচওড়া কথা’...। মা বাবার কথা মনে পড়ে তখন। আমার হাতে যদি টাকা থাকত কিছু। কিন্তু এরা তো বাইরে গিয়ে কাজও করতে দেবে না। বাড়ির বউ নাকি যেতে পারে না বাইরে। হাতখরচের টাকা থাকে না আমার। যখন বাপের বাড়ি যাই। তখন বাবা একটু করে দেয়। টিপে টিপে লুকিয়ে চালাই।
এই আমরা কারা? যাদের আপনারা ৪ জুন থেকে অশিক্ষিত আর ভিখারি বলেন। কেন? কারণ আমরা লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের টাকা পেয়েছি। আপনাদের সন্দেহ সেই কারণে আপনাদের ভোট দিইনি। তাই সেই টাকার নাম আপনাদের কাছে ভিক্ষা। আর আমরা ভিখারি। আপনারা ক্রমাগত বলে চলেছেন, আমরা এতটাই অশিক্ষিত মূর্খ যে চোরদের ভোট দিয়ে দিয়ে জেতাই। কারণ ওই ভিক্ষা। আজকাল যেহেতু মোবাইল থেকে অনেক কিছু জানা যায়, তাই আমাদের সন্ধ্যাদি বলছিল, এরকম টাকা নাকি দেশের প্রায় সব রাজ্যের মেয়েরাই পায়। মধ্যপ্রদেশে পায় লাডলি বহেনা নামের স্কিমে। মহারাষ্ট্রে একঝাঁক নাকি প্রকল্প আছে। দিল্লি আর কর্ণাটক তো বড়লোক শহর। সেখানে বাস ফ্রি মেয়েদের জন্য। কর্ণাটকের মেয়েদের বাস ফ্রি হওয়ার জন্য তীর্থক্ষেত্র, দর্শনীয় স্থানগুলিতে ব্যবসা উপচে পড়ছে ভিড়ের কারণে। মেয়েদের ভিড়। ওইসব ধনী রাজ্যের মেয়েরাও অশিক্ষিত ভিখারি?
আপনাদের ভাষায় আমরা অশিক্ষিত আর ভিখারি। কেন? কারণ আপনারা ভোটে হেরে গিয়েছেন বলে। আচ্ছা, এই যে দেশের বাকি রাজ্যগুলিতে এরকম সব টাকাপয়সার নানারকম সুবিধা দেওয়া হয়, সেখানে যে দল হেরে যায়, তারা কি নিজেদের জাতির নিজেদের রাজ্যের মহিলাদের এরকম অশিক্ষিত, ভিখারি, মূর্খ বলে ডাকে? কখনও তো শুনিনি যে, মধ্যপ্রদেশের কংগ্রেস শূন্য হয়ে গিয়ে বলছে, ভিখারি আর অশিক্ষিতগুলো আমাদের হারিয়ে দিল? আবার দিল্লিতেও তো আম আদমি পার্টি বলছে না যে, ভিখারিদের বাসে ফ্রি চড়ার সুযোগ দিলাম, তাও আমাদের ভোট দিল না! দেশজুড়ে বিরোধী দলগুলি কিন্তু একবারও বলছে না যে, ফ্রি রেশন পেয়ে ভিখারি ভোটার এবারও মোদিকে ভোট দিয়েছে। না হলে ২৪০টা আসনও পেতেন না উনি? এই রাজ্যে আপনারা কিন্তু বলছেন অনায়াসে! কতটা উগ্র মানসিকতা হলে সহনাগরিকদের সম্পর্কে ‘অশিক্ষিত’ ‘ভিখারি’ ‘মূর্খ’ শব্দগুলো বলা যায়? কতটা সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে নির্বোধ হলে ‘আমিই ঠিক, অন্যরা ভুল’ ভাবা যায়?
আপনাদের কোনও ধারণা আছে এক হাজার কিংবা বারোশো টাকার কতটা দাম আমাদের কাছে? কতটা দরকারি সংসারে? কীভাবে আমাদের ভিতরটাকে বদলে দিয়েছে? জানেন? খুব ছোট ছোট ইচ্ছা কীভাবে পূরণ হচ্ছে? জানেন? আপনারা ভদ্রভাবে বলুন যে, কর্মসংস্থান জরুরি। কাজের সুযোগ বৃদ্ধি হলে সকলেই সম্মানের সঙ্গে রোজগার করবে। সেটাই উচিত। এসব বলুন না, কে বারণ করেছে! কিন্তু এরকম অপমানের কথা কেন বলছেন? এবার তৃণমূল পেয়েছে কমবেশি ১ কোটি ৪০ হাজার মহিলা ভোট। রাজ্যে ১ কোটি ৯৮ হাজার মহিলা লক্ষ্মীর ভাণ্ডার পায়। ওই যে কমবেশি ১ কোটি ৪০ লক্ষ মহিলা, যারা এবার আপনাদের বিরুদ্ধে ভোট দিলেন, এরা সবাই তাহলে অশিক্ষিত আর ভিখারি? আর সব মিলিয়ে রাজ্যে ৪৬ শতাংশ মানুষই অশিক্ষিত আর ভাতাজীবী? কারণ ওটাই তৃণমূলের ভোট। আমরা কিন্তু সকলেই তৃণমূলকে ভোট দিইনি। হয়তো সিংহভাগই দিয়েছে। কিন্তু এই যে আপনারা লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, কন্যাশ্রী নেওয়া মানুষদের সরাসরি ভাতাজীবী ভিখারি বলছেন, চোখের পাতা না কাঁপিয়ে বরং উচ্চকণ্ঠে, জিহ্বায় ঘৃণা আর তাচ্ছিল্য এনে এই বিপুল সংখ্যক মানুষকে অশিক্ষিত তকমা দিয়ে ফেলছেন, আমরা কিন্তু এটা মনে রাখছি।
আমাদের বাড়িতে যারা বয়স্ক মানুষ, তারা আমাদের বলছিল যে, ১৯৭৮ সালের পর থেকে নাকি বেকার ভাতা, বয়স্ক ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, কৃষক ভাতা, শ্রমিক ভাতা এসব একে একে চালু হয়। সেগুলো কি ভিক্ষাই ছিল? ২ টাকা কেজি চাল দেওয়া কি ভিক্ষা ছিল? বন্ধ কলকারখানা আর চা বাগানের শ্রমিকদের ভাতা দেওয়া হয়েছিল। ভিক্ষা ছিল?
আপনারা এত শিক্ষিত, অথচ এই দূরদৃষ্টি নেই যে, এটাই শেষ ভোট নয়? আবার পুরসভা, বিধানসভা, পঞ্চায়েত নানারকম ভোট আসবে। আজ যাদের ভিখারি আর অশিক্ষিত বলছেন, আবার আগামী ভোটগুলিতে তাদের পাড়া আর বাড়ির সামনে এসে ভোট চাইবেন তো! সেই সময় এখন যা বলছেন, এগুলো মনে থাকবে? যদি আপনাদের প্রশ্ন করি তখন,যে, আমরা তো ভিখারি, অশিক্ষিত। আমাদের ভোট চাইছেন কেন? কী উত্তর দেবেন? আসলে আপনারা জিতলে আমরা উন্নত চেতনাসম্পন্ন। আপনারা হারলে আমরা ভিখারি!
একটি বিশেষ উন্নত চিন্তার দলকে আমাদের মতো সামান্য ক্ষুদ্র মানুষদের প্রশ্ন যে, আপনাদের জনপ্রিয় কৃষক নেতা কে এখন? শ্রমিক নেতা কে? শেষ কবে কোথায় শ্রমিক আন্দোলন হয়েছে? কৃষকদের দাবি নিয়ে কবে হয়েছে বড়সড় কর্মসূচি? আপনারা এবার ভোটে যে প্রার্থীদের নিয়ে সবথেকে বেশি মাতামাতি করেছেন, তাঁরা সকলেই নাগরিক শিক্ষিত মিডল বা আপার মিডল ক্লাসের মানুষ কেন? তাঁরা সকলেই উচ্চবর্ণ এবং উচ্চবর্গের কেন? এরকম তো হওয়ার কথা ছিল না! গ্রামীণ কেন্দ্রের কোনও কৃষক প্রার্থী, শ্রমিক প্রার্থী, অনগ্রসর প্রার্থীদের নিয়ে তো এরকম মাতামাতি এবং পরাজিত হওয়ার পর হা-হুতাশ শোনা গেল না? কেন?
যাঁরা জয়ী হয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধেও তো বিপুল অংশের মানুষের ভোট পড়েছে। সম্মিলিতভাবে বিরোধীরা কাঁটায় কাঁটায় ভোট পাচ্ছে। সুতরাং সব পক্ষের সমর্থক ও ভোটার আছে। তাহলে মানুষকে অপমান করতে হচ্ছে কেন? মানুষের কাছে যে গ্রহণযোগ্য মনে হচ্ছে, আজ তাকে ভোট দিচ্ছে। আগামী কাল মনে না করলে বিরুদ্ধে ভোট দেবে! এটা তো সহজ সংসদীয় গণতন্ত্রের অঙ্ক। কিন্তু নিজেদের ব্যর্থতার জন্য আপনারা এত রেগে যাচ্ছেন কেন যে, নিজেদের মনুষ্যত্ব আর শিক্ষাদীক্ষাকেই অসম্মান করছেন? আপনারা বেশি বোঝেন, মানুষ কম বোঝে এটা কে ঠিক করে দিল? আপনারা বুদ্ধিমান, প্রায় ৩ কোটি মানুষ বোকা, এটা কীভাবে বোঝা গেল? কোন মেশিনে মাপা হয় এটা?
গণতন্ত্রের কাছে একটা অদৃশ্য মেশিন আছে। ঔদ্ধত্য, অহঙ্কার আর দম্ভ পরিমাপের যন্ত্র। তার প্রমাণ আপনারা অতি সম্প্রতি দেশজুড়ে পেয়েছেন। অতএব আপনারাই স্থির করুন, কোন পথে হাঁটবেন! গণতন্ত্রের সেই মেশিন সদাজাগ্রত! ৭৭ বছর ধরে!