সপরিবারে অদূরবর্তী স্থানে ভ্রমণে আনন্দলাভ। কাজকর্মে কমবেশি ভালো। সাহিত্যচর্চায় আনন্দ। ... বিশদ
স্থিতাবস্থায় স্বস্তি
অনেক মানুষই পরিবর্তন চান, আমার মনে হয়, আবার এমন অনেক মানুষও আছেন যাঁরা পরিবর্তন চান না। তার কারণ পরিবর্তন-বিরোধীরা ভয় পাচ্ছেন যে পরিবর্তনের ফল তাঁদের জীবনে আরও খারাপ হতে পারে; অথবা অজানা পরিবর্তনটা হতে পারে চেনা বর্তমানের চেয়ে বেশি ভয়ঙ্কর; অথবা কারণটা এই যে, তাঁরা ভয় পাচ্ছেন—একটি দিকের পরিবর্তন জীবনের অন্যান্য দিকগুলির পক্ষে ক্ষতিকারক হবে। যেমন—প্রথা ভঙ্গের পরিণামে গোষ্ঠীগত ক্রোধ ধেয়ে আসতে পারে। স্থিতাবস্থায় বরং নির্দিষ্ট কিছু স্বস্তি আছে।
ভারতের গত তিনটি দশকের একাধিক কালখণ্ডকে নির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা যায়—যেখানে চালিকা শক্তি (মোটিভ ফোর্স) পাল্টে গিয়েছিল এবং কিছু নির্দিষ্ট দফায় বজায় ছিল স্থিতাবস্থা। আবার অন্য সময়ে, এটা ছিল পূর্বগানুকৃতি (অ্যাটাভিজম), অভিধান বিষয়টিকে ‘বিবর্তনের প্রবণতা’ হিসেবে দেখিয়েছে। (অ্যাটাভিস্ট হলেন তাঁরাই, হারিয়ে যাওয়া সময়কে যাঁরা গৌরবময় অতীত হিসেবে দেখতে ভালোবাসেন।)
আমি বিশ্বাস করি যে, ভারতের একটা পরিবর্তন প্রয়োজন এবং সেটা তার প্রাপ্যও। দশ বছর আগে, পরিবর্তনের পক্ষে মানুষ সরব হয়েছিল, এবং তার জন্যই এসেছিল পরিবর্তন—ইউপিএ সরে গিয়ে বসেছিল এনডিএ সরকার। আমি মনে করি, ভারত আবার এমনই একটি মুহূর্তে এসে পৌঁছেছে। গত ১০ বছরে এমন অনেক কিছু ঘটেছে যেগুলি অবশ্যই উল্টে দিতে হবে বা তার জন্য প্রতিকারমূলক পদক্ষেপ করাই সমীচীন। এই প্রসঙ্গে কয়েকটি উদাহরণ দেব:
ভুক্তভোগী মানুষজন
২০১৬ সালের বিমুদ্রাকরণ ছিল একটি হিমালয়প্রমাণ ভুল। নগদ ব্যবস্থা ভয়ানকভাবে ধসে পড়ার (দ্য হিউজ লিকুউইডিটি হোল) কারণে সেবার মানুষের ব্যক্তিজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। ওইসঙ্গে কয়েক হাজার অতিক্ষুদ্র এবং ছোট মাপের শিল্প-বাণিজ্য সংস্থা পড়েছিল একটা টালমাটাল পরিস্থিতির মধ্যে। এই আকস্মিক অস্থিরতার মোকাবিলা করতে না-পেরে অনেক ইউনিট শেষমেশ ঝাঁপ বন্ধ করে দিতেই বাধ্য হয়েছিল।
২০২০ এবং ২০২১, মহামারীর বছরগুলিতে চাপিয়ে দেওয়া অপরিকল্পিত লকডাউন, পরিস্থিতিকে করে তুলেছিল আরও দুর্বিষহ। কোনোরকম আর্থিক প্যাকেজ এবং ঋণসহায়তা দেওয়া হয়নি। ফলে অতিক্ষুদ্র (মাইক্রো) এবং ছোট (স্মল) ইউনিটগুলির পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছিল। বন্ধ হয়ে গিয়েছিল আরও বহু সংস্থা। এই জোড়া আঘাতেই হারিয়ে গিয়েছিল হাজার হাজার মানুষের চাকরি, রুটিরুজি। ভয়াবহ পরিস্থিতিতে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য জরুরি ছিল সরকারের তরফে একটা সাহসী পরিকল্পনা গ্রহণ। তার মধ্যে অবশ্যই থাকার দরকার ছিল—ঋণ মকুব, ব্যাপক মাত্রায় ঋণ প্রদান, সরকারের তরফে কেনাকাটা বৃদ্ধি, রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য ইনসেনটিভ এবং করের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয়
ছাড় ঘোষণা। যাঁরা পরিবর্তনের বিপক্ষে তাঁদের তরফে এই বিষয়ে কোনও পরিকল্পনার কথা আমি অন্তত শুনিনি।
সংরক্ষণের উপর নীরব আঘাত এসসি, এসটি এবং ওবিসিদের জন্য সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতিগুলিকে নস্যাৎ করেছে। সরকারি দপ্তরগুলিতে এবং সরকারি ক্ষেত্রে ৩০ লক্ষ শূন্যপদ পূর্ণ না-করার ঘটনাটি অপরাধ হিসেবে গণ্য একটি অবহেলা এবং সংরক্ষণ বিরোধী মনোভাবেরই দৃষ্টান্ত। সংরক্ষণের জন্য ৫০ শতাংশের ঊর্ধ্বসীমা মেনে চলার অঙ্গীকার রয়েছে। কিন্তু স্থিতিশীলতায় আস্থাশীলরা চুপি চুপি ১০ শতাংশ সংরক্ষণের আরও একটি কোটা চালু করেছে। নয়া সংরক্ষণ দেওয়া হয়েছে সমাজে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল অংশের (ইডব্লুএস) জন্য। এটা দেওয়া হয়েছে সংরক্ষিত ৫০ শতাংশকে ছাপিয়ে। তবে এসসি, এসটি এবং ওবিসির মধ্যে ইডব্লুএস’কে সেখানে ব্রাত্য করা হয়েছে! কিন্তু কেন? সরকারি ক্ষেত্রের প্রতিষ্ঠানে চাকরির সুযোগের নিখাদ হ্রাস, চাকরিতে সংরক্ষণের শর্ত ছাড়াই বেসরকারিকরণ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পরিষেবায় সরকারের চেয়ে বেসরকারি ক্ষেত্রকে অগ্রাধিকার প্রদান, প্রশ্নপত্র ফাঁসের কারণে পাবলিক এগজাম বাতিলকরণ, পদোন্নতির সুযোগ হরণ এবং চাকরিতে চুক্তিভিত্তি ও অস্থায়িত্ব—সংরক্ষণের নীতিকে মারাত্মকভাবে ধ্বংস করেছে। যাঁরা স্থিতাবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করবেন পরিবর্তন আসবে কেবলমাত্র তাঁদেরই সৌজন্যে।
ক্ষতিটা উল্টে দিন
আইনকে হাতিয়ার করার কৌশল উল্টে দিতেই হবে। কিন্তু সংসদে পরিবর্তন-বিরোধীদের দাপট চলতে থাকলে তা কীভাবে সম্ভব? অথচ গত ১০ বছরে সরকার পাস করেছে বেশকিছু কঠোর নতুন অথবা সংশোধনী বিল। সরকার পরিবর্তন ছাড়া সেসব খারিজ করা সম্ভব কীভাবে? কে তদন্তকারী সংস্থাগুলির লাগাম টেনে ধরবে এবং সংসদ/ বিধানসভা কমিটিগুলির নিয়ন্ত্রণে সেগুলিকে আনবে? কে সংবিধানের ১৯, ২১, এবং ২২ অনুচ্ছেদের অর্থ ও বিষয়বস্তু পুনরুদ্ধার করবে এবং ফেরাবে আইনের শাসন? কে ইতি টানবে ‘বুলডোজার বিচার’ এবং ‘প্রাক-বিচার কারাগার’ সংস্কৃতিতে? জনগণের মধ্যে আইনের ভীতি দূর করে আইনের প্রতি শ্রদ্ধা জাগাবার ব্যবস্থা কে করবে? আইনের ‘ডিউ প্রসেস’ বা ‘যথা প্রক্রিয়াকে’ ফৌজদারি আইনের একটি অপরিবর্তনীয় নীতিতে পরিণত করবে কে? ‘জামিনই নিয়ম, জেলই ব্যতিক্রম’ আইনে এই নীতির অন্তর্ভুক্তির জন্যই এটা জরুরি। এই পরিবর্তনগুলি শুধুমাত্র নির্ভীক আইন প্রণেতাদের একটি দলের পক্ষেই করা সম্ভব। তাঁরা অবশ্যই হবেন বাবাসাহেব আম্বেদকর প্রণীত সংবিধানের মৌলিক মূল্যবোধ এবং নীতিগুলির রূপায়ণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
উদারীকরণ, একটি উন্মুক্ত অর্থনীতি, প্রতিযোগিতা এবং বিশ্ব বাণিজ্য ভারতীয় অর্থনীতিতে দুর্দান্ত উন্নতি এনে দিয়েছে। তবে অর্থনৈতিক নীতিগুলির পুনঃস্থাপন ছাড়া সেগুলির প্রাসঙ্গিকতা রক্ষা পেতে পারে না। বেড়ে চলা নিয়ন্ত্রণ, ছদ্ম লাইসেন্স ব্যবস্থা, ক্রমবর্ধমান মনোপলি ও প্রোটেকশনিজম এবং দ্বিপাক্ষিক ও বহু-পাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তির ভয়ে বৃদ্ধির হার অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এই জিনিস ঘটতে বাধ্যও বটে। শ্রমের প্রাপ্য মূল্য অস্বীকার করে পুঁজির প্রতি পক্ষপাতিত্বের (আমাদের একটি পিএলআই আছে কিন্তু একটি ইএলআই নেই) নীতিতে কর্মসংস্থান এবং মজুরির দিকটি চাপা পড়ে গিয়েছে। ভারতে ক্রমবর্ধমান বৈষম্যের এটা একটা কারণ। ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়ালিটি ল্যাব অনুসারে, ভারতে সর্বোচ্চ পর্যায়ের বৈষম্য চলে আসছে সেই ১৯২২ সাল থেকে!
মাঝামাঝি স্তরের আয় (মিডিয়ান ইনকাম) বৃদ্ধির ফলে অনেকেই প্রতারিত হচ্ছেন। উল্লেখ্য, মিডিয়ান ইনকামের নীচে রয়েছেন ভারতীয় জনগণের অর্ধেক বা ৫০ শতাংশ, সংখ্যার বিচারে ৭১ কোটি মানুষ! এঁদের মধ্যে আছেন জনসংখ্যার নীচের দিকের ২০ শতাংশ বা ২৮ কোটি, যাঁরা আরও বেশি গরিব। স্থিতাবস্থা রক্ষার পক্ষের লোকজন কি নীচের দিকের ২০ শতাংশের পক্ষে কথা বলবেন? ভাববার মতো আর-একটি তথ্য এই যে, ভারতের প্রাপ্তবয়স্ক (১৫-৬৪ বছর) জনসংখ্যা ৯২ কোটির মধ্যে মাত্র ৬০ কোটি মানুষ শ্রমশক্তি (লেবার ফোর্স) হিসেবে যুক্ত রয়েছেন। শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের হার (এলএফপিআর) সর্বাধিক হল—পুরুষের ক্ষেত্রে ৭৪ শতাংশ এবং ৪৯ শতাংশ মহিলাদের ক্ষেত্রে।
এবার অসন্তোষজনক এলএফপিআর, বেকারত্বের উচ্চ হার এবং বার্ধক্যপীড়িত জনসংখ্যা একত্র করুন। তাহলে অবশ্যই দেখা যাবে যে, ডেমোগ্রাফিক অ্যাডভান্টেজ বা জনবিন্যাসের সুবিধাগুলি আমরা দ্রুত হারাচ্ছি। বর্তমান অর্থনৈতিক নীতিগুলিকে চ্যালেঞ্জসহ পুনঃস্থাপনের সাহস কে দেখাবেন? নিশ্চয় স্থিতাবস্থা রক্ষায় মরিয়া লোকজন নন।
যে বাধাবিঘ্ন উপস্থিত হয়েছে, এবার সেটাই পরিবর্তন এনে দেবে। ব্যাঘাত ও পরিবর্তনের জন্য অনেক সুবিধা এবং কিছু ক্ষতি আমাদের হবে। তবে ওই ক্ষয়ক্ষতির সংশোধনও সম্ভব। ১৯৯১ সাল আমাদের মূল যে শিক্ষা দিয়ে গিয়েছে তা হল—শুধু সাহসীরাই জয়ী হয়। স্থিতাবস্থা রক্ষা যাঁরা চান—তাঁরা কোনোভাবেই পরিবর্তনকামী নন। জয়ী হওয়ার মূল পাঠ তাঁরা শেখেননি এবং শিখবেনও না।